পাথেয়

আত্মহত্যার প্রতিষেধক বিশ্বাস: তিন প্রশ্নের উত্তর

আজকের দুনিয়ায় আত্মহত্যার চিন্তা বাড়ছে। কেউ চিন্তা করে, কেউ চেষ্টা করে, কেউ সফল হয়। এক আলোচনায় একজন বললেন, ‘বিশ্বাস আত্মহত্যা রোধ করে না। প্রাচ্যে ধর্মপালনের নানা রূপ আছে, তবু আত্মহত্যার হার বেশি। সমস্যা বললে বলা হয়, দুই রাকাত নামাজ পড়ো, কোরআন পড়ো, কিন্তু এতে কি আত্মহত্যার মতো জটিল সমস্যার সমাধান হয়।’

এই কথায় একটি ভুল ধারণা আছে। ধর্ম, কোরআন, নামাজকে সঠিকভাবে না বুঝলে এমন হয়। কোরআন সঠিক তেলাওয়াত, নামাজ সঠিক আদায়, বিশ্বাসের প্রভাব জীবনে–এগুলো সঠিকভাবে অনুভব করলে জীবনে পরিবর্তন আসতে বাধ্য। আসুন ধর্মপালন, নামাজের প্রভাব, কোরআনের সমাধান নিয়ে আলোচনা করা যাক।

রমজান আসে-যায়, কেউ রোজা রাখে কি না বোঝা যায় না। নামাজের সময় হয়, কেউ যায় না। জুমা আসে, ছুটির দিনে বন্ধুর সঙ্গে থাকে, কিন্তু মসজিদে যায় না। বোঝা যায়, ধর্ম শুধু তার নামেই আছে।

১. ধর্মচর্চা কি আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করে

কেউ ইসলাম গ্রহণ করে জন্মগত বা পরিবেশের কারণে, বাহ্যিক আচার পালন করে। কিন্তু ধর্মের প্রভাব মন-অন্তর-আচরণে পড়ে বললেই চলে।

দুই ব্যক্তির উদাহরণ দিই: একজনের সঙ্গে ২০ বছরের বন্ধুত্ব। দুজনের আলাদা ধর্ম, কিন্তু কেউ লক্ষ্য করে না। রমজান আসে-যায়, কেউ রোজা রাখে কি না বোঝা যায় না। নামাজের সময় হয়, কেউ যায় না। জুমা আসে, ছুটির দিনে বন্ধুর সঙ্গে থাকে, কিন্তু মসজিদে যায় না।

বোঝা যায়, ধর্ম শুধু তার নামেই আছে। যে ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মে আছে সে এবং যে মুসলিম, দুজনের মধ্যে বাহ্যিকভাবে ইসলামের কোনো প্রভাব নাই, তাই কোনো তফাৎও দেখা যায় না। ধর্ম তো শুধু আধ্যাত্মিক সম্পর্ক নয় নামাজ, হারাম ত্যাগ, আল্লাহর নৈকট্য, শরয়ি-নৈতিক অবলম্বন, সৃষ্টির প্রতি ইহসান–এগুলো ছাড়া ধর্ম অসম্পূর্ণ।

প্রাচ্যে ধর্মানুরাগী বেশি বলে সেটাই সঠিক মাপকাঠি মনে করলে ভুল হবে। বরং শরয়ি মাপকাঠিতে যাচাই করতে হবে। এমন ধর্মপালন কি আত্মহত্যা রোধ করবে? নাকি জীবনের সাধারণ ধাক্কায় ভেঙে পড়বে?

ইসলামকে সঠিকভাবে পালন করা হলে তা মানুষের হৃদয়কে মজবুত করে, সমস্যায় ধৈর্য দেয়। নবীদের জীবন অনুসরণ করলে দেখা যায়, ধর্ম তাদের জীবনে কীভাবে পথ দেখিয়েছে।

২. নামাজ কি আত্মহত্যা থেকে বাঁচায়

নামাজ জমিন-আসমানের সেতু, অন্তরকে আল্লাহর সঙ্গে জুড়ে দিতে নামাজের ভূমিকা সীমাহীন। সঠিকভাবে নামাজ আদায় করলে আল্লাহর নৈকট্য বাড়ে। বলা হয়, ‘খুশু নামাজের রূহ।’ খুশু মানে:

  • আল্লাহর সঙ্গে কথা বলা: কষ্টে ডুবে থাকা মানুষ আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে। আল্লাহ শোনেন, জানেন। অভিজ্ঞতা ও বিজ্ঞান বলে, সমস্যা বললে মন হালকা হয়–সাহায্য না পেলেও। আল্লাহ তো সবকিছুর ক্ষমতাবান।

  • মনোযোগ: কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, দোয়া, রুকু-সিজদায় পূর্ণ একাগ্রতা। মানসিক রোগীদের ছটফটানি, একাগ্রতাহীনতা কমে। সব দরজা বন্ধ দেখলে আল্লাহর সামনে দাঁড়ালে নির্ভার লাগে মন, আশ্বাস জাগে অন্তরে।

  • প্রশান্তিদায়ক নামাজ: নবীজির (সা.) জন্য নামাজ প্রশান্তির উৎস। বলতেন, ‘হে বিলাল, নামাজ কায়েম করো, নামাজের মাধ্যমে আমাদের প্রশান্তি দাও।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৯৮৫)

সুতরাং যাদের হৃদয়ে অস্থিরতা, তারা একাগ্রচিত্তে নামাজ পড়লে শান্তির দেখা পেতে পারেন।

কেউ নামাজ পড়েও কষ্টে থাকে, আত্মহত্যার কথা ভাবে। কেন? নামাজের শরীর আছে, রূহ আছে। সবাই দেখা যায় শরীরটা পালন করে, রূহ খুঁজে পায় না।

কিন্তু কেউ নামাজ পড়েও কষ্টে থাকে, আত্মহত্যার কথা ভাবে। কেন? নামাজের শরীর আছে, রূহ আছে। সবাই দেখা যায় শরীরটা পালন করে, রূহ খুঁজে পায় না। নবীজির যুগে এক লোক নামাজ পড়ল, কিন্তু সঠিক হয় নি। নবীজি বললেন, ‘ফিরে গিয়ে নামাজ পড়, কারণ তুমি নামাজ পড়নি’। পর পর তিন বার এমন হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৫৭)।

কেউ কেউ নামাজে ঢোকে, ইমাম সালাম ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু কোথায় সে ছিল, কিংবা তার মন কোথায় পড়ে ছিল সে জানে না। জীবনের চিন্তায় ডুবে থাকে। এমন নামাজ প্রশান্তি দেয় না।

৩. কোরআন কি আত্মহত্যার সমাধান দেয়

কেউ কোরআনকে শুধু পুণ্যের জন্য পড়ে। কিন্তু এটা আল্লাহর বাণী, পড়ে, বুঝে, আমল করার জন্য কোরআন এসেছে, শুধু পাঠ করার জন্য। ‘আমি কোরআন নাজিল করিনি তোমার কষ্টের জন্য’ (সুরা ত্বহা, আয়াত: ২)। ‘আমি কোরআন নাজিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ৮২)। ‘এই কোরআন সঠিক পথ দেখায়’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ৯)।

আত্মহত্যার বিষয়টি ভাবলে কোরআনের কয়েকটা সত্য স্মরণ করুন:

  • জীবন কষ্টের: ‘আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি কষ্টের মধ্যে।’ (সুরা বালাদ, আয়াত: ৪)। জীবন সহজ নয়, সমস্যা আসবেই।

  • পরীক্ষা: ‘আমি তোমাদের পরীক্ষা করি মন্দ ও ভালো দিয়ে।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৩৫)।

  • অপছন্দে ভালো: আল্লাহ বলেছেন, ‘অনেক কিছু এমন আছে তোমরা অপছন্দ করো, কিন্তু তা তোমাদের জন্য ভালো; আবার যা পছন্দ করো, তা তোমাদের জন্য মন্দ। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৬)।

  • চেষ্টা করো: মারইয়াম (আ.)-এর প্রসবকষ্টে আল্লাহ বলেন, ‘খেজুর গাছ নাড়াও, তাজা খেজুর পড়বে।’ (সুরা মারইয়াম, আয়াত: ২৫)। তাওয়াককুল মানে নিষ্ক্রিয়তা নয়।

সুতরাং সঠিকভাবে ইসলাম পালন, হালাল উপভোগ, ইবাদতে মনোযোগ, আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা এবং জান্নাত কামনা করা এসব অবশ্যই মানুষকে আশাবাদী করে এবং আত্মহত্যা করার মতো হতাশা থেকে তাকে বের করে নিয়ে আসতে পারে।

আত্মহত্যা হয় যখন সমস্যা ঘিরে ধরে, সমাধান ভাবা যায় না, একাকীত্ব লাগে। কিন্তু যে আল্লাহকে চেনে, সে তাঁর কাছে ফিরে, অতীতের নাজাতের কথা স্মরণ করে।

ধর্ম, নামাজ, কোরআন সঠিকভাবে পালন করলে আত্মহত্যার চিন্তা দূর হয়। জীবনের কষ্টে ধৈর্য, সমাধান, আশা দেয়। চলুন, সঠিক ধর্মপালন করে জীবন গড়ি।