ইসলামের ইমারত পাঁচটি মূল স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, “ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের ওপর স্থাপিত: এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, হজ করা এবং রমজানের সিয়াম পালন করা।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬)।
এই পাঁচটি স্তম্ভই একজন মুসলিমের ইমান ও আমলের পূর্ণতা দান করে।
ইসলামে প্রবেশের প্রথম শর্ত হলো শাহাদাত বা সাক্ষ্য দেওয়া। এটি কেবল মুখে উচ্চারণ নয়, বরং অন্তরের গভীর বিশ্বাস। এর দুটি অংশ রয়েছে:
তওহিদ: আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে স্বীকার করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “আপনার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না।” (সুরা ইসরা, আয়াত: ২৩)।
রিসালত: মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসুল হিসেবে গ্রহণ করা। কোরআনের ঘোষণা, “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারও পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী।” (সুরা আহজাব, আয়াত: ৪০)।
কালেমার পর ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো নামাজ। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ একজন মুমিনকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।" (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৪৫)
নামাজ কেবল ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, এটি সামাজিক সংহতিরও প্রতীক। জামাতে নামাজ পড়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, “ব্যক্তি এবং শিরক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত ত্যাগ করা।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮২)
জাকাত হলো ইসলামের আর্থিক স্তম্ভ। এটি ধনীদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি হক, যা দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়। জাকাত শব্দের অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। এটি সম্পদকে পবিত্র করে এবং সমাজে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখে। আল্লাহ বলেন, “তাদের সম্পদ থেকে সদকা (জাকাত) গ্রহণ করো, যার মাধ্যমে তুমি তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে।” (সুরা তাওবা, আয়াত: ১০৩)
জাকাত কোনো দয়া বা দান নয়, বরং এটি প্রাপকের অধিকার। ড. ইউসুফ আল-কারজাভি তার 'ফিকহুয জাকাত' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, জাকাত ব্যবস্থার সঠিক বাস্তবায়ন একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের প্রধান হাতিয়ার।
রমজান মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও পাপাচার থেকে বিরত থাকাই হলো রোজা। এটি খোদাভীতি অর্জনের প্রধান মাধ্যম। আল্লাহ বলেন, “হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
রোজা মানুষের নফস বা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা পালন করে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯০১)
শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এটি বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য নিদর্শন, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মুসলিম একই পোশাকে আল্লাহর দরবারে হাজির হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, “মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই ঘরের হজ করা তার ওপর আবশ্যক।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)
হজ মানুষকে নির্ভেজাল তওবার সুযোগ করে দেয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করল এবং অশ্লীল কথা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকল, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৫২১)।
ইসলামের এই পাঁচটি স্তম্ভ একটি দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মতো। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। কালেমা হলো প্রাণ, নামাজ হলো মেরুদণ্ড, জাকাত হলো জীবনীশক্তি, রোজা হলো ঢাল এবং হজ হলো আনুগত্যের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
এই পাঁচটি স্তম্ভের যথাযথ পালনের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি পেতে পারেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার 'আল-ইমান' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এই স্তম্ভগুলো কেবল বাহ্যিক আমল নয়, বরং এগুলো মুমিনের হৃদয়ের ইমানের সত্যতার প্রমাণ।