হজের অংশ মিনায় অবস্থান, মক্কা
হজের অংশ মিনায় অবস্থান, মক্কা

হজ সফর ১৮

মিনায় ফিরতে ট্রেনে ওঠার বিপত্তি

পশ্চিম দিক দিয়ে নেমে মিনায় ফেরার রাস্তা ধরলাম। ততক্ষণে মাথার ওপর সূর্য গণগণ করছে। গরম বাড়ছে। আমি হেঁটে মিনায় ফিরতে চাচ্ছিলাম। আমার সহধর্মিণী বললেন যে ট্রেনে চেপে ফিরবেন। কিন্তু স্টেশন কোথায়? কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে সামনে এগোলাম। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হবে। অর্ধেক উঠতেই দম ফুরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। মাথার ওপর তপ্ত রোদ। এক পর্যায়ে আমার সহধর্মিণী একটা সিঁড়িতে ধপ করে বসে পড়লেন। ওর বুকে চাপ পড়েছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পাশেই এক ভারতীয় মহিলা হাজি প্রায় হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে গেলেন। পুলিশতো অপেক্ষা করতে দেবে না। তবে সিঁড়ির একপাশে চেপে যেতে বলল।

খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর আল্লাহর নাম নিয়ে আবার ওঠা শুরু করলাম। সব মিলিয়ে মনে হয় ১০ তলার মতো সিঁড়ি ভেঙেছি। এ সময় এক বাংলাদেশি পরিচ্ছন্নতা কর্মীর দেখা হলো। তিনি আমাদের এক পাশে নিয়ে দাঁড় করালের ও পানি দিলেন। হজের এই কয়েক দিন তারা বাংলাদেশি অনেক হাজির খেদমত করে থাকেন নিজেদের কাজের বাইরে। কেউ দলছুট হলে তাকে দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেওয়া থেকে আরম্ভ করে কতো খেদমতই না তারা করেন। ওই কর্মী আমাদের স্টেশন দেখিয়ে দিলেন। দেখলাম, যেখানে আমরা আছি, সেখান থেকে ঢাল বেয়ে হাঁটার রাস্তা দিয়ে প্রথমে পশ্চিমে, তারপর খানিকটা দক্ষিণে আর খানিকটা পুবে যেতে হবে। তবে রাস্তার বেশির ভাগ ছাউনি দেওয়া।

স্টেশনের ঊর্ধ্বমুখী ঢালু পথে উঠে দেখি প্রাথমিক চিকিৎসার একটি দল হাজিদের সেবা দিচ্ছে। ওখানে আমার সহধর্মিণীকে বসালাম। ওর এক পায়ে আঘাতও লেগেছিল। সেবকেরা পায়ে স্প্রে করে ওষুধ লাগিয়ে দিল। এরপর আমরা হাঁটা দিলাম। একটু পর পর পুলিশদের কেউ কেউ স্বেচ্ছাসেবকেরা স্প্রে করে চোখেমুখে ও মাথায় পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে গরমের তাপ থেকে স্বস্তি দিতে।

মিনা ও আরাফার প্রায় প্রতিটি রাস্তার দু ধারে একটু পরপর স্বয়ংক্রিয় ফোয়ারা থেকে ক্রমাগত পানি ছিটানো হতে থাকে হজের দিনগুলোয়। পাশাপাশি সেবক ও হজকর্মীরা হাতে স্প্রে নিয়ে পানি ছিটায়। রাস্তার দুধারে একটু পরপরই খাবার পানির ব্যবস্থাও আছে।

সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার পরও বোধ হয় দু কিলোমিটার ঊর্ধ্বমুখী ঢালু রাস্তা হেঁটে জামারর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলাম। এটা মিনার তিন নম্বর স্টেশনও বটে। সঙ্গে আরো অনেক ভারতীয় ও পাকিস্তানি হাজি। কেউ কেউ বলাবলি করছিলেন যে ট্রেনে না উঠতে এসে নিচ দিয়ে হেঁটে গেলে এতক্ষণে মিনার তাঁবুতে পৌঁছে যাওয়া যেতো।

তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ট্রেনে চাপার পর প্রথম স্টেশনেই নামতে হলো যেটা মিনার দ্বিতীয় স্টেশন। প্ল্যাটফর্ম থেকে লিফট দিয়ে নিচে নেমে এলাম। টয়লেট সেরে নিলাম এখানেই। কিন্তু কিছুই ঠাওর করতে পারছিলাম না কোনদিকে কীভাবে যাব। আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজ দেওয়ার পর সামী ও সানোয়ার দুজনই ফোন করে রাস্তা চেনানোর চেষ্টা করল। ওদিকে তানজীর গুগল লোকেশন লিংক পাঠাল। আরও কয়েকজন হাজিকে দেখে জানতে চাইলাম যে তাঁরাও আট নম্বর মক্তবের হাজী কি না। জানলাম যে তারা সাত নম্বর মক্তবের। দুটো মক্তবের তাবুগুচ্ছ পাশাপাশি। তাদের সঙ্গেই হাঁটা দিলাম। পুলিশকে ও দুতিনজনকে জিজ্ঞাসা করে এবং সঙ্গে থাকা ম্যাপ দেখে এক নম্বরে পেডেস্ট্রিয়ান রোড বা টিনশেডের রাস্তায় উঠলাম। এখানে এক বাংলাদেশি কর্মীকে পেলাম। তিনি নিশ্চিত করলেন যে আমরা যে পথ ধরে যাচ্ছি, সেটা দিয়ে গেলে সামনেই বাংলাদেশ হজ মিশন তাঁবু পাব। ওটার উল্টোদিকে আমাদের তাঁবু।

মিনিট ১৫ হেঁটে অবশেষে আমরা বাংলাদেশ হজ মিশনের তাঁবুর কাছে চলে এলাম। ওখানেই হাজিদের শুশ্রূষার জন্য একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেবাকেন্দ্র ছিল। আমরা দুজন প্রথমে ওখানে ঢুকলাম। আমাদের দেখে সেবকেরা ছুটে এলো। সোফায় বসিয়ে পানি দিল। কী সমস্যা জানতে চাইল। আমি বললাম যে আমরা খুব ক্লান্ত। আর আমার সহধর্মিণীর পায়ে ব্যথা। ওরা বলল যে হুইল চেয়ার দিয়ে তাঁবুতে পৌঁছে দেবে। সেবকেরা বেশির ভাগই কলেজের ছাত্র। একজন একটা হুইল চেয়ারে আমার সহধর্মিণীকে বসিয়ে চেয়ার ঠেলে একেবার তাঁবুর কাছে নিয়ে এল। ওদের এই খেদমতে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার সহধর্মিণী ছেলেটা মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিল। ছেলেটা হাসিমুখে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিল।

দুই

আমি যে তাঁবুতে ছিলাম, সেখানে ঢুকে দেখি আমার বিছানায় অন্য আরেকজন হাজি শুয়ে আছেন। তাঁর আশেপাশেরগুলোতেও অন্য কয়েকজন। আমাদের দলের পরিচিত কাউকে দেখলাম না। তানজীরকে ফোন দিতেই ও পাশের তাঁবুতে যেতে বলল। ওখানে গিয়ে জানলাম যে আমাদের বেশ কয়েকজনের বিছানা পাটি অন্য হাজিদের দখলে। তাই বিকল্প হিসেবে পাশের তাঁবুতে আপাতত অবস্থান নিতে হচ্ছে।

আমাদের খাবার আগেই চলে এসেছিল। আর তানজীর তা রেখে দিয়েছিল। আমি হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিলাম। ভাত ও মুরগি। খাওয়ার পরে বসে বসেই বিশ্রাম নেওয়া। একটু পরেই আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেল। মক্কা ও মদিনায় তথা গোটা সৌদি আরবেই ওয়াক্ত হওয়া মাত্র আজান দেয় এবং ১০ থেকে মিনিটের মধ্যে সালাতের জামাত দাঁড়িয়ে যায়। আউয়াল ওয়াক্তে বা ওয়াক্ত শুরু হওয়ার প্রথমভাগেই সালাত আদায়ের এই প্রথা বাংলাদেশে বেশিরভাগক্ষেত্রেই অনুসরণ করা হয় না।

সে যাই হোক, তাঁবুর ভেতরে একজন আজান দিলেন। পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ইমামতি করলেন। তিনি আরও কয়েকবার হজ করেছেন। আবার মিনায় নিজ হাতে দমে শোকরের হাদী জবাই করেছেন। আসরের সালাতের পর তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমলের বয়ান করলেন ও আমাদের তাতে শরিক হতে বললেন।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক