আধুনিক মুসলিম নারীদের জন্য একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারেন নবীজি (সা.)–এর সাহাবি আবু দারদা (রা.)-এর স্ত্রী উম্মে দারদা (রহ.)। তাঁর মূল নাম ছিল হুজাইমাহ আল আওয়াসাবিয়্যাহ, তবে ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন জ্ঞানসাধক উম্মে দারদা নামেই। ইসলামি শিক্ষায় পাণ্ডিত্য অর্জন এবং পরবর্তী সময় শিক্ষক হিসেবে তাঁর অবদান ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
উম্মে দারদা (রহ.)-এর মা-বাবা কে ছিলেন, সে ব্যাপারে ইতিহাস নিরব। তবে ছোটবেলায় তিনি মা-বাবাকে হারান। এ সময় মদিনার আবু দারদা (রা.) উম্মে দারদাকে এতিম শিশু হিসেবে গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী সময় তাঁকে সঙ্গে করে দামেস্কে নিয়ে যান। পরিণত বয়স হলে তাঁকে বিয়ে করেন।
যখন বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে উঠেন, একদিন মসজিদে গিয়ে আবু দারদা তাঁকে বলেন, এখন থেকে তুমি ওই পাশে নারীদের কাতারে গিয়ে নামাজ পড়বে।
ইবনে জাবির ও উসমান ইবনে আবু আতিকাহ বলেন, ‘অল্প বয়সে যখন উম্মে দারদা এতিম হয়ে যান, আবু দারদা স্নেহ ও মমতাভরে তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন।
মেয়েটি সব সময় আবু দারদার সঙ্গে থাকতেন। তিনি যখন নামাজ পড়তে যেতেন, তিনি তাঁর সঙ্গে পুরুষদের কাতারে নামাজ পড়তেন। মসজিদে ছেলেদের সঙ্গে বসে কোরআন পড়া শিখতেন এবং কোরআন মুখস্থ করতেন।
তবে তিনি যখন বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে উঠেন, একদিন মসজিদে গিয়ে আবু দারদা তাঁকে বলেন, এখন থেকে তুমি ওই পাশে নারীদের কাতারে গিয়ে নামাজ পড়বে।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইমাম জাহাবি, ৪/২৭৮)
আবু দারদা (রা.) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) সময়কালে মদিনা থেকে দামেস্কে চলে যাওয়ার ইচ্ছা করেন। তিনি স্বেচ্ছায় এ প্রবাসজীবন বেছে নিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে খলিফার কাছে দামেস্কে যাওয়ার অনুমতি চাইলে খলিফা ওমর তাঁকে বললেন, ‘তুমি যদি দামেস্কে যেতেই চাও, তবে রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্ব নিয়ে যাও।’
আবু দারদা বললেন, ‘শাসক হওয়া আমার পছন্দ নয়।’
খলিফা রাগ করে বললেন, ‘তাহলে আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই। তুমি তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী যেখানে খুশি যেতে পারো।’
নিরুপায় হয়ে আবু দারদা বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি সেখানে মানুষকে কোরআন ও হাদিস শেখাব এবং তাদের নামাজ পড়া শেখাব।’
তাঁর উত্তরে খুশি হয়ে খলিফা তাঁকে দামেস্কে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। (তাবাকাতে ইবনে সাদ ও হায়াতুস সাহাবা সূত্রে মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ প্রণীত আসহাবে রাসুলের জীবনকথা, ৩/২০৫)
আবু দারদা যখন মারা যান, তখন উম্মে দারদার বয়স খুব বেশি ছিল না। আবু দারদার মৃত্যুশয্যায় তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি পরকালে তোমাকে কেবল নিজের জন্য রাখতে চাই।’
আবু দারদা (রা.) দামেস্কের উমাইয়া মসজিদে প্রতিদিন শত শত শিশু-কিশোরকে কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা দিতেন। উম্মে দারদা এখানেই তাঁর ইসলামি জ্ঞানের ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। পরে তিনি আয়েশা (রা.) ও সালমান ফারসি (রা.) থেকে তিনি হাদিস সংগ্রহ ও রপ্ত করেছিলেন। এ ছাড়া তৎকালীন দামেস্কে অবস্থানরত একাধিক সাহাবি থেকে তিনি হাদিস শোনেন।
আবু দারদার প্রতি উম্মে দারদার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। আবু দারদা যখন মারা যান, তখন উম্মে দারদার বয়স খুব বেশি ছিল না। আবু দারদার মৃত্যুশয্যায় তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি পরকালে তোমাকে কেবল নিজের জন্য রাখতে চাই।’
আবু দারদার মৃত্যুর পর মুআবিয়া (রা.) তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মুআবিয়া (রা.) তখন দামেস্কের প্রশাসক। কিন্তু উম্মে দারদা তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তোমাকে গ্রহণ করার চেয়ে আমি বরং রোজা রাখাকে প্রাধান্য দেব।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইমাম জাহাবি, ৪/২৭৮)
৬৫২ খ্রিষ্টাব্দে আবু দারদার মৃত্যুর পর তিনি নিজেও উমাইয়া মসজিদে দামেস্কের শিশু-কিশোরদের শিক্ষা প্রদান শুরু করেন। তিনি ছেলে ও মেয়ে দুই ধরনের শিক্ষার্থীদেরই ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করতেন। পরবর্তীকালে প্রতাপশালী উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানও তাঁর ছাত্র ছিলেন।
অনেক সময় পড়াতে পড়াতে তিনি ক্লান্ত হয়ে যেতেন। একদিন তাঁর এক ছাত্র তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমরা কি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তোমরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছ? আরে না! আমি অনেকভাবে আল্লাহর ইবাদত করেছি। কিন্তু আলেম ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে জ্ঞান আদান-প্রদানের চেয়ে প্রশান্তিময় স্বাদ আর কিছুতে পাইনি।’
ইমাম বুখারি (রহ.) তাঁর সহিহ বুখারি গ্রন্থে উম্মে দারদা সম্পর্কে বলেন, ‘উম্মে দারদা ছিলেন একজন অভিজ্ঞ হাদিসবেত্তা।’ ইবনে আবদুল বার (রহ.) তাঁকে ‘নারীদের মধ্যে হাদিস বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ পণ্ডিত এবং ধর্মতত্ত্ববিদ, একই সঙ্গে অত্যন্ত ধার্মিক ও ইবাদতগুজার’ বলে অভিহিত করেছেন।
অনেক সময় পড়াতে পড়াতে তিনি ক্লান্ত হয়ে যেতেন। একদিন তাঁর এক ছাত্র তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমরা কি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি?’
উম্মে দারদা দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ এবং ফিলিস্তিনের জেরুজালেম—দুই স্থানে ইসলামি জ্ঞানের দরস প্রদান করতেন। তিনি দরস প্রদানের বিনিময়ে কোনো পারিতোষিক গ্রহণ করতেন না। তিনি দানশীল নারী ছিলেন কিন্তু অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
ইবনে আসাকির (রহ.) তারিখে দিমাশক গ্রন্থে লিখেছেন, উম্মে দারদা একবার জেরুজালেমে কয়েকজন দরিদ্র মহিলার সঙ্গে বসে ছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তি এসে তাঁকে একটি রুপার দিরহাম দান করে গেল। তিনি দিরহামটি তাঁর খাদেমের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা দিয়ে উটের গোশত কিনে আনো। খাদেমা জিজ্ঞাসা করলেন, এটা তো সদকার দিরহাম! এটা আপনি কীভাবে গ্রহণ করবেন? তিনি উত্তর দিলেন, যেহেতু এটা আমি না চাইতেই আমাকে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং এটা দান নয়।’
আগে যেমনটা বলা হয়েছে, খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান ছিলেন তাঁর একান্ত ছাত্র। আবদুল মালিক নিজেও হাদিসের অনেক বড় ইমাম ছিলেন। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তাঁকে যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম বলে অভিহিত করেছিলেন। আবদুল মালিক খলিফা হওয়ার পরও অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে উম্মে দারদার দরসে উপস্থিত হতেন।
খলিফা আবদুল মালিক অনেক সময় তাঁর শিক্ষাগুরু উম্মে দারদাকে দাওয়াত করে নিজ প্রাসাদে নিয়ে যেতেন। এমন এক রাতে খলিফা শেষ রাতে জেগে তাঁর দাসীকে ডাকলেন। দাসীর আসতে কিছুটা দেরি হলে তিনি তাঁকে বকাঝকা করলেন ও অভিশাপজনিত কিছু বাক্য বললেন। উম্মে দারদা তাঁর এমন কথা শুনে খলিফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘অভিশাপ দিয়ো না। আমি আবু দারদাকে বলতে শুনেছি, তিনি নবীজি (সা.) থেকে শুনেছেন, যারা অভিশাপ দেয়, কেয়ামতের দিন তাদের কোনো সাক্ষী বা সুপারিশকারী থাকবে না।’
তিনি দরস প্রদানের বিনিময়ে কোনো পারিতোষিক গ্রহণ করতেন না। তিনি দানশীল নারী ছিলেন কিন্তু অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
উম্মে দারদা সাহাবি ছিলেন কি না, এ ব্যাপার নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। এক দল গবেষকের মতে, সাহাবি আবু দারদার (রা.) দুজন স্ত্রী ছিলেন, দুজনকেই আবু দারদার মেয়ে ‘দারদা’র নামানুসারে উম্মে দারদা বলে ডাকা হতো। একজনকে ডাকা হতো উম্মে দারদা কুবরা এবং অন্যজনকে উম্মে দারদা সুগরা। উম্মে দারদা কুবরার মূল নাম ছিল খায়রা বিনতে আবু হাদরাদ। তিনি যে সাহাবি ছিলেন, এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। উম্মে দারদা সুগরা নামে যিনি পরিচিত এবং যাঁর ব্যাপারে এতক্ষণ আলোচনা করা হলো, তাঁর নাম হুজাইমাহ আল আওয়াসাবিয়্যাহ। তিনি সাহাবি নন বলেই অধিকাংশের মতামত।
তবে কোনো কোনো ইমাম দুজন নয়, বরং একজন উম্মে দারদার নাম উল্লেখ করেন এবং দুজনকে একই ব্যক্তি বলে অভিহিত করেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইমাম জাহাবি, ৪/২৭৭)
ক্যামব্রিজ মুসলিম কলেজের ডিন ড. আকরাম নদভি নারী মুহাদ্দিসদের নিয়ে লেখা তাঁর ৪৩ খণ্ডের আল-মুহাদ্দিসাত গ্রন্থে উম্মে দারদার আলোচনা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।