
বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সিংহভাগ লেনদেন ইন্টারনেট (ই-কমার্স), ক্যাটালগ এবং অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে ‘আল-আইন আল-গাইবাহ’ বা ‘অনুপস্থিত পণ্যের বিক্রয়’–সম্পর্কিত ফিকহি বিষয়টি বর্তমান যুগে একটি অত্যন্ত জরুরি আলোচ্য বিষয়।
ফিকহবিদদের পরিভাষায় ‘অনুপস্থিত পণ্যের বিক্রয়’ হলো এমন পণ্যের বেচাকেনা, যা বিক্রেতার মালিকানাধীন এবং বাস্তবে অস্তিত্বশীল, কিন্তু চুক্তির মজলিসে (বৈঠকে) ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই তা চোখে দেখতে পাচ্ছে না। এ প্রকার বিক্রয় ‘অবিদ্যমান বস্তুর বিক্রয়’ থেকে ভিন্ন। কারণ, এ ক্ষেত্রে পণ্যটি অস্তিত্বশীল ও বিক্রেতার মালিকানাধীন, কিন্তু দৃষ্টির আড়ালে বা অনুপস্থিত।
ফিকহি মতপার্থক্য আলোচনার আগে অনুপস্থিত পণ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নীতিমালা সম্পর্কে অবগত হওয়া আবশ্যক:
১. শারীরিক ইঙ্গিত বা ইশারা: ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে বিক্রীত পণ্যকে সংজ্ঞায়িত ও নির্দিষ্ট করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হলো শারীরিক ইঙ্গিত বা ইশারা। যদি পণ্যটি চুক্তিকারী উভয়ের সামনে উপস্থিত থাকে এবং ইশারার মাধ্যমে ক্রেতা তা দেখে ও নিশ্চিত হয়, তবে সেই বিক্রয় অবশ্যই ‘লাজিম’ বা বাধ্যতামূলক হয়।
২. বর্ণনা প্রসঙ্গে নিয়ম: মনে রাখতে হবে। উপস্থিত পণ্যের বর্ণনা ততটা জরুরি নয়, কিন্তু অনুপস্থিত পণ্যের বর্ণনা মূল্যবান।
উপস্থিত পণ্যে: যদি বিক্রেতা উপস্থিত একটি পণ্যের দিকে ইশারা করে, কিন্তু এমন একটি বর্ণনা দেয়, যা ক্রেতার দেখা বস্তুর বিপরীত (যেমন একটি লাল কাপড় দেখিয়ে বলল এটি নীল), আর ক্রেতা তা দেখে সন্তুষ্ট হয়, তবে পরবর্তীকালে ক্রেতা বর্ণনার ভিত্তিতে দাবি করতে পারে না। কেননা, সে যা দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে, তা–ই গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে বর্ণনা নিরর্থক।
অনুপস্থিত পণ্যে: যদি পণ্য অনুপস্থিত থাকে, তবে তা হয় ‘বায়-সালাম’ (অগ্রিম বিক্রয়) পদ্ধতিতে পূর্ণাঙ্গ বর্ণনার মাধ্যমে, অথবা স্থান উল্লেখ করে বিক্রি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বর্ণনা অত্যন্ত মূল্যবান এবং যদি পণ্য বর্ণনার সঙ্গে না মেলে, তবে ক্রেতার জন্য ‘খিয়ারু ফাওয়াতিল ওয়াস্ফ’ বা ‘বর্ণনা ছুটে যাওয়ার কারণে বাতিল করার অধিকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. পণ্যের প্রকারভেদ (জিন্স) ও গুণের (ওয়াস্ফ) ভুল
পণ্যের প্রকারভেদে ভুল: যদি বিক্রেতা ‘আমি আপনার কাছে এই ঘোড়া বিক্রি করলাম’ বলে একটি উটের দিকে ইশারা করে, তবে বিক্রয় বাতিল হবে। কারণ, নাম (জিন্স) গণ্য হবে। জিন্সের পার্থক্য পণ্যটিকে অবিদ্যমানের পর্যায়ে নিয়ে আসে। কাফি (রহ.) স্পষ্ট বলেছেন, যদি বিক্রিতে জিন্সের নাম উল্লেখ না করা হয় (যেমন আমি একটি কাপড় বিক্রি করলাম বলে চুপ থাকে), তবে সর্বসম্মতিক্রমে বিক্রয় অবৈধ।
অস্পষ্ট গুণ বা বিশেষণে ভুল: যদি এমন কোনো গুণ যা সরাসরি দৃষ্টি দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না (যেমন গরুটি বেশি দুধ দেয়), তা চুক্তিতে শর্ত করা হয় এবং পরবর্তীকালে তার বিপরীত প্রমাণিত হয়, তবে ক্রেতার জন্য বিকল্পের অধিকার (খিয়ার) থাকে, যদিও পণ্যটি চুক্তির মজলিসে উপস্থিত থাকে।
অনুপস্থিত পণ্য বিক্রয়ের বিষয়ে ফিকহবিদেরা প্রধানত দুটি দিকে বিভক্ত:
প্রথম অভিমত: অনুপস্থিত পণ্য বিক্রয় জায়েজ। এটাই জুমহুর বা অধিকাংশ ফকিহ্র মত। হানাফি, মালেকি, হাম্বলি (প্রকাশ্য মতে) এবং শাফেঈ মাজহাবের পূর্বের (কাদিম) মতে এই বিক্রয় জায়েজ। তবে এর সঙ্গে বিভিন্ন শর্ত ও বিস্তারিত নিয়ম যুক্ত করা হয়েছে:
হানাফি: শর্তহীনভাবে জায়েজ। খিয়ারুর রুইয়া (দেখার পর বাতিলের অধিকার) প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রেতা দেখার পর চাইলে গ্রহণ করতে পারে বা বাতিল করতে পারে। যদি ক্রেতা দেখার আগেই মারা যায়, তবে উত্তরাধিকারীর জন্য এই অধিকার থাকে না এবং চুক্তি বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। (ইবনে নুজাইম, আল-বাহরুর রায়েক্ব, ৬/৫-৭, বৈরুত: দারুল কিতাবিল ইসলামি, ১৯৯৭)
মালেকি: নির্দিষ্ট বর্ণনার ভিত্তিতে জায়েজ। ১. পণ্য যেন অতিরিক্ত কাছে না থাকে (যা সহজেই দেখা সম্ভব)। ২. পণ্য যেন অতিরিক্ত দূরে না থাকে (যা হস্তান্তরের আগেই পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে)। ৩. বিক্রেতাকে অবশ্যই সালামের মতো বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হবে। যদি বর্ণনার সঙ্গে না মেলে, তবে ক্রেতার খিয়ারুল খালাফ (বর্ণনা ছুটে যাওয়ার কারণে বাতিলের অধিকার) থাকবে। (আল-কুরতুবি, আল-জামি’লি আহকামিল কুরআন, ৩/৩১০, কায়রো: দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যাহ, ১৯৩৮)
হাম্বলি: বিস্তারিত বর্ণনার ভিত্তিতে জায়েজ। শুধু যদি বর্ণনা না মেলে, তবেই ক্রেতার বাতিল করার অধিকার থাকবে। বর্ণনা মিলে গেলে বিক্রয় বাধ্যতামূলক। (হানাফিদের মতের বিপরীতে, যারা মিললেও খিয়ার দেন)। (ইবনে কুদামা, আল-মুগনি, ৪/১৪৭-১৪৮, রিয়াদ: মাকতাবাতুল কায়রো, ১৯৬৮)
দ্বিতীয় অভিমত: অনুপস্থিত পণ্য বিক্রয় জায়েজ নয়। এটি শাফেঈ মাজহাবের নতুন (জাদিদ) ও প্রসিদ্ধ মত এবং ইমাম আহমাদের থেকেও একটি বর্ণনা রয়েছে।
শাফেয়ি মাজহাব: এই বিক্রয় সহিহ নয়, এমনকি যদি বিস্তারিত বর্ণনাও দেওয়া হয়। ইমাম শাফেঈ (রহ.) মজনিকে (তাঁর ছাত্র) বলেছেন, ‘এ ধরনের কোনো বিক্রয়ই জায়েজ নয়। কারণ, বর্ণনাভিত্তিক বিক্রয় তখনই জায়েজ হয়, যখন তা বিক্রেতার পক্ষ থেকে গ্যারান্টিযুক্ত হয়।’ এর কারণ হলো, বিক্রয়টি গ্বারাআর (অনিশ্চয়তা বা ধোঁকা) নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে। কারণ, পণ্যটির দৃশ্যমানতা অনিশ্চিত।
শাফেয়ি ব্যতিক্রম: তাঁরা শুধু একটি ক্ষেত্রে জায়েজ বলেছেন, যখন পণ্যটি ‘আল-বারনামাজ’ (তালিকা বা ক্যাটালগ) বা ‘আল-উন্মুজাজ’ (নমুনা) অনুসারে বিক্রি হয় এবং শর্ত থাকে যে এই নমুনা বিক্রয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে (যেমন ‘আমি আপনাকে এই ঘরের গম বিক্রি করলাম, আর এটি তার নমুনা’)।
হাম্বলি (অপ্রসিদ্ধ মতে): ‘আল-মুগনি’ গ্রন্থের লেখক হাম্বলি মাজহাবের ইমাম আহমদ (রহ.) থেকে একটি অসহিহ বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যা এ বিক্রয়কে নিষিদ্ধ করে। আল-মারদাভি এ বর্ণনাকে মাজহাবের সঠিক মত বলে গণ্য করেছেন।
১. ‘গ্বারার’ (অনিশ্চয়তা/ধোঁকা) সম্পর্কিত হাদিসের আলোচনা:
নিষেধকারীদের দলিল: তাঁরা ‘গ্বারার’ (অনিশ্চয়তা) থেকে নিষেধকারী হাদিসকে দলিল হিসেবে পেশ করেন, যেহেতু পণ্য দেখা যাচ্ছে না, তাই এতে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
পর্যালোচনা: এই যুক্তি দুর্বল। কারণ, যদি পণ্যটির বর্ণনা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং বিস্তারিতভাবে দেওয়া হয়, তবে গ্বারার দূর হয়ে যায়। তখন পণ্যটি যেন দেখা পণ্যের মতোই নিশ্চিত হয়। শরিয়তের বিভিন্ন নস (আয়াত/হাদিস) প্রমাণ করে যে বর্ণনা (ওয়াস্ফ) দেখার স্থান দখল করতে পারে।
২. ‘তোমার নিকট যা নেই, তা বিক্রি করো না’ হাদিসের আলোচনা:
নিষেধকারীদের দলিল: তাঁরা এই হাদিসকে (লা তাবি’মা লাইসা ‘ইনদাকা) দলিল হিসেবে পেশ করেন এই যুক্তিতে যে অনুপস্থিত পণ্য বিক্রেতার ‘কাছে নেই’।
পর্যালোচনা: এই হাদিস অনুপস্থিত পণ্য বিক্রয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, যা বিক্রেতার মালিকানাধীন। হাদিসে ‘কাছে নেই’ দ্বারা মালিকানা ও হস্তান্তরের সক্ষমতা বোঝানো হয়েছে, চুক্তির মজলিসে শারীরিক উপস্থিতি নয়। যে ব্যক্তি অনুপস্থিত পণ্যের মালিক, সে বলতে পারে যে বস্তুটি তার ‘কাছে আছে’, যা সে মালিক নয়, এমন বস্তুর ক্ষেত্রে বলতে পারে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০৭৩)
৩. ‘খেজুরের ভেতরের আঁটির বিক্রয়ের’ ওপর কিয়াসের আলোচনা:
নিষেধকারীদের দলিল: তাঁরা অনুপস্থিত পণ্যকে খেজুরের ভেতরের আঁটি বিক্রয়ের সঙ্গে কিয়াস (তুলনা) করেন, যা দৃষ্টির বাইরে।
পর্যালোচনা: এটি ‘কিয়াসে মা’আল-ফারিক’ (পার্থক্য সত্ত্বেও কিয়াস)। কারণ, অনুপস্থিত পণ্যটি মালিকানাধীন ও বর্ণিত, যা খেজুরের ভেতরের আঁটির মতো সম্পূর্ণ অজ্ঞাত বা অ-বিদ্যমান বস্তুর সমতুল্য নয়।
৪. অনুমোদনকারীদের দলিলের সমালোচনা
অনুমোদনকারীদের দলিল হিসেবে পেশ করা খিয়ারুর রুইয়া–সম্পর্কিত হাদিসগুলো (আবু হুরায়রা ও মাকহুলের হাদিস) মুহাদ্দিসদের ঐকমত্যে দুর্বল এবং দলিলের জন্য যথেষ্ট নয় বলে সমালোচনা করা হয়েছে।
উল্লিখিত দলিল ও পর্যালোচনা শেষে জুমহুরের (অধিকাংশের) মতটিই প্রাধান্য পায়, যা বিস্তারিত বর্ণনার ভিত্তিতে অনুপস্থিত পণ্য বিক্রয়কে জায়েজ বলে। এর কারণসমূহ হলো:
এই মতের অনুকূল দলিলের শক্তিমত্তা।
নিষেধকারীদের দলিলগুলোর যৌক্তিক পর্যালোচনা ও খণ্ডন।
বর্ণনার পর্যাপ্ততা: একটি নিখুঁত বর্ণনা একটি এলোমেলো দেখার চেয়েও অনেক বেশি সত্য হতে পারে। অতএব বর্ণনা (ওয়াস্ফ) অজ্ঞতা দূরীকরণে দেখার স্থান দখল করে।
জুমহুরের বৈধতার মতামতের ভিত্তিতে আধুনিক উপায়ে অনুপস্থিত পণ্য বিক্রয়ের নিম্নলিখিত দিকগুলো শরিয়া পরিপালন করে:
১. ইলেকট্রনিক বর্ণনা ও ক্যাটালগ: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে (যেমন অ্যামাজন, নুন) প্রদর্শিত ছবি ও পণ্যের বিবরণ হলো ‘আল-বারনামাজ’ বা ক্যাটালগের সমতুল্য। যদি ছবি ও বিবরণ নিখুঁত হয় এবং পর্যবেক্ষণজনিত চরম অজ্ঞতা দূর করে, তবে তা দেখার স্থান দখল করে এবং এই বিক্রয় জায়েজ।
২. যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে বিক্রয় (ফোন/ইন্টারনেট/টিভি): এই ক্ষেত্রে মৌখিক বা দৃশ্যমান (স্ক্রিনের মাধ্যমে) বর্ণনার ওপর নির্ভর করা হয়। যদি বর্ণনাটি চরম অজ্ঞতা দূর করতে যথেষ্ট হয়, তবে এই বিক্রয় বৈধ।
৩. ব্র্যান্ড বা ট্রেডমার্ক (Branding): ট্রেডমার্ক পণ্যের গুণমান ও প্রকারের একটি অন্তর্নিহিত বর্ণনা হিসেবে বিবেচিত হয়, যার ওপর ক্রেতা নির্ভর করে। এটিও গ্বারার (অনিশ্চয়তা) কমাতে সাহায্য করে।
৪. স্থাবর সম্পত্তি ও গাড়ি বিক্রয়ের বর্ণনা: জমি বিক্রির ক্ষেত্রে প্রকৌশল নকশা বা গাড়ি বিক্রির ক্ষেত্রে বিস্তারিত প্রযুক্তিগত বর্ণনা অনুপস্থিত পণ্যের বর্ণিত বিক্রয়ের বিধানের আওতায় পড়ে।
সূত্র: ইসলাম অনলাইন ডট নেট