ইতিহাসের প্রতিটি যুগে মহান আল্লাহ মানবজাতিকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য নবী ও রাসুলকে প্রেরণ করেছেন। মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন আল্লাহর সর্বশেষ রাসুল এবং তাঁর আগমন ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি কেন আরব ভূমিতে আগমন করলেন, তার পেছনের কারণ ও তাৎপর্য নিম্নে তুলে ধরা হলো।
রাসুল (সা.)-এর আগমনের আগে আরব সমাজ নৈতিক অবক্ষয় ও অরাজকতার চরমে পৌঁছেছিল। তৎকালীন আরব সমাজের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল:
মূর্তিপূজা ও কুসংস্কার: আরবরা মূর্তিপূজা, কুসংস্কার ও জাহিলিয়াতের (অজ্ঞতার) গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।
নারীর অবমাননা: নারীদের কোনো মর্যাদা ছিল না। তাদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। তারা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। কন্যাসন্তানদের লালন-পালনের ব্যয়ভার, যুদ্ধে পরাজিত হলে শত্রুদের হাতে দাসত্বের শিকার হওয়া বা বিয়ের পর জামাতার কাছে অপমানিত হওয়ার ভয়ে আরবরা কন্যাদের জীবন্ত কবর দিত।
যুদ্ধে পরাজিত হলে শত্রুদের হাতে দাসত্বের শিকার হওয়া বা বিয়ের পর জামাতার কাছে অপমানিত হওয়ার ভয়ে আরবরা কন্যাদের জীবন্ত কবর দিত।
সামাজিক অপরাধ: যুদ্ধবিগ্রহ, মদ্যপান, জুয়া ও অন্যান্য অপরাধ সমাজে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আরব গোত্রগুলোর মধ্যে প্রায়ই মহাযুদ্ধ বাধত, যা ঐতিহাসিকেরা ‘আয়্যামুল আরব’ নামে অভিহিত করেছেন। এসব যুদ্ধ কখনো কখনো বংশানুক্রমে চলত।
নিরক্ষরতা: কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ আরব ছিল নিরক্ষর। তবে তাদের মন ও চিন্তা ছিল স্বাধীন, যা ইসলামের বার্তা গ্রহণে সহায়ক ছিল। মহান আল্লাহ সহস্র বছর আগে তাওরাতে উম্মি (নিরক্ষর) জাতির মধ্যে একজন উম্মি নবী প্রেরণের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আরবদের এই স্বাধীন চিন্তা ও মানসিকতা ইসলামের আহ্বানে দ্রুত সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মদ্যপান ও জুয়া: মদ্যপান আরব সমাজে গৌরবের বিষয় ছিল। কবিরা তাদের কবিতায় মদ্যপানের রঙিন বর্ণনা দিয়ে গর্ব করত। মদমত্ত অবস্থায় নির্লজ্জতা ও পাশবিকতার নানা ঘটনা ঘটত। জুয়ার মাধ্যমে উটের লটারি খেলা হতো, যেখানে জয়ী ব্যক্তি উট জবাই করে উপস্থিত জনতাকে কাবাব, বিরিয়ানি বা কিমা খাওয়াত। এমনকি মদের নেশায় আস্তাবলে প্রবেশ করে জীবিত উট কেটে টুকরো করা হতো।
আরব ভূমি ভৌগোলিকভাবে তিন মহাদেশ—এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত। বিশেষত মক্কা নগরী ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে। এ অবস্থান ইসলামের বার্তা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আদর্শ ছিল।
স্থলপথ: ইরাক হয়ে ইরান, তুর্কিস্তান, খোরাসান, কাবুল ও ভারতবর্ষে পৌঁছানো যেত। সিরিয়া হয়ে মিসর, তিউনিসিয়া, মরক্কো ও স্পেন পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল।
জলপথ: আফ্রিকা, ইউরোপ, ভারতবর্ষ, জাভা, সুমাত্রা ও চীন পর্যন্ত সুগম পথ বিদ্যমান ছিল।
এ ছাড়া তৎকালীন পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিশ্বে অশান্তির প্রধান কারণ ছিল। আরব ভূমি এই দুই শক্তির মধ্যে কৌশলগত অবস্থানে ছিল, যা ইসলামের মাধ্যমে বিশ্বকে তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে সহায়ক হয়।
‘হে রাজন, এ ঘোটকী অত্যন্ত দামি ও সুন্দর। এটি ধার বা বিক্রি করা যায় না। আপনি এটি নেওয়ার কোনো ফন্দি আঁটবেন না, কারণ এটি রক্ষা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
নৈতিক অবক্ষয়ের মধ্যেও আরবদের মধ্যে কিছু উত্তম গুণ ছিল, যা ইসলামের বার্তা গ্রহণে তাদের প্রস্তুত করেছিল:
অতিথিপরায়ণতা: আরবরা অতিথিসেবায় অত্যন্ত উদার ছিল। তারা মূল্যবান উট জবাই করে অপরিচিত মেহমানদের আপ্যায়ন করত। জুয়া, প্রতিযোগিতা বা ভোজসভায় বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা এবং আশ্রিতদের সাহায্যে নিজেদের জানমাল উৎসর্গ করা তাদের চিরাচরিত প্রথা ছিল।
কবিতা ও ভাষার দক্ষতা: আরবরা কবিতা ও ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল। তাদের স্বাধীনতা, আত্মসম্মান ও মর্যাদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তারা রাজা-বাদশাহের কাছেও তাদের মতামত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করত। একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায়, বনি তামীমের এক ব্যক্তি রাজার কাছে তার মূল্যবান ঘোটকী দিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন: ‘হে রাজন, এ ঘোটকী অত্যন্ত দামি ও সুন্দর। এটি ধার বা বিক্রি করা যায় না। আপনি এটি নেওয়ার কোনো ফন্দি আঁটবেন না, কারণ এটি রক্ষা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
এই গুণাবলি আরবদের ইসলামের আহ্বান গ্রহণে সহায়ক হয়েছিল।
সবচেয়ে বড় কারণ ছিল আল্লাহর ইচ্ছা ও হিকমত। তিনি যাকে ইচ্ছা, যেখানে ইচ্ছা, নবী হিসেবে প্রেরণ করেন। রাসুল (সা.)-কে ‘সর্বজনীন রাসুল’ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আনবিয়া, আয়াত: ১০৭)
এই হিকমতের মাধ্যমে আরব ভূমিকে ইসলামের কেন্দ্র হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
রাসুল (সা.)-এর আগমন শুধু আরবদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য ছিল। আরব ভূমির কৌশলগত অবস্থানের কারণে ইসলাম দ্রুত এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
রাসুল (সা.)-এর আগমন শুধু আরবদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য ছিল। আরব ভূমির কৌশলগত অবস্থানের কারণে ইসলাম দ্রুত এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর আগমন মানবজাতির জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করে, যা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, মিথ্যা থেকে সত্যের পথে এবং অন্যায় থেকে ন্যায়ের পথে নিয়ে আসে।
রাসুল (সা.)-এর আরব ভূমিতে আগমন ছিল আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। তিনি একদিকে নৈতিকভাবে অধঃপতিত আরব সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন, অন্যদিকে আরবের ভৌগোলিক অবস্থান কাজে লাগিয়ে ইসলামের আলো বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর আগমন মানবজাতিকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোয়, অন্যায় থেকে ন্যায়ের পথে নিয়ে এসেছে।
মাসরুরুল হাসান: এমফিল গবেষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়