Thank you for trying Sticky AMP!!

তাবলিগের নানান দাওয়াত

তাবলিগ জামাতের দাওয়াত বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। নিজ এলাকায় মসজিদে যেমন দাওয়াতের কাজ করা হয়, তেমনি বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্য একটি মসজিদে অবস্থান করে সেই মসজিদের আশপাশের এলাকার মানুষের কাছেও দাওয়াত পৌঁছানো হয়ে থাকে। দাওয়াতের সময়গত দৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে এর নামকরণ করা হয়। যেমন সবচেয়ে ছোট দৈর্ঘ্যের জামাত হলো তিন দিনের। আরও একটি দাওয়াতের ব্যবস্থা আছে, যেখানে মানুষ সাত দিনের জন্য অন্য একটি এলাকায় গিয়ে দাওয়াত দিয়ে থাকে।

Also Read: সুরা কাহাফে বাগানের মালিকের সম্পদের ঘটনা

এরপরের বড় দৈর্ঘ্যের যে দাওয়াতের কথা বলা হয় সেটি হলো চিল্লা। চিল্লা সাধারণত ৪০ দিনের হয়ে থাকে। এ কারণেই এই দাওয়াতকে চিল্লা বলে। এরপরের জামাতকে বলা হয় তিন চিল্লার জামাত বা ১২০ দিনের টানা দাওয়াতের জামাত। সবচেয়ে বড় দৈর্ঘ্যের জামাত হলো এক বছরের, যাকে তাবলিগ জামাতের ভাষায় বলা হয় ‘সাল লাগানো’।

প্রত্যেক সাথি বা সদস্যকে এসব জামাতে অংশগ্রহণ করতে হলে দাওয়াতের নানা রকম ধাপ অতিক্রম করে আসতে হয়। তাবলিগ জামাত মূলত কোনো মসজিদ ও এলাকাভিত্তিক দাওয়াতের কাজ করে থাকে। এলাকার মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অন্য সাথিদের সঙ্গে এমনভাবে মেলামেশা করে থাকেন যে তাঁরা খুব সহজেই একে অন্যকে চিনতে পারেন।

একজন সাথির বড় দৈর্ঘ্যের জামাতে যাওয়ার একটি পূর্বশর্ত হলো তার পূর্ববর্তী দাওয়াতের কাজের অভিজ্ঞতা থাকা। এ কারণে তাদের বড় দৈর্ঘ্যের জামাতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার আগে তার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাগুলো সম্পর্কে আগে শোনা ও ধারণা নেওয়া হয়। দাওয়াতে যাওয়ার জন্য একজন সাথিকে নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এমন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এর সঙ্গে একজনের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যস্ততা এবং কর্মজীবী হলে তাঁর ছুটির বিষয়গুলোও বিবেচনা করা হয়। ফলে যখন-তখন হুটহাট বড় দৈর্ঘ্যের জামাতে কেউ যেতে পারেন না। তবে একটি কথা খুব ভালোভাবে সবাইকে বলা হয় যে প্রতি মাসে একবারের জন্য হলেও তাঁরা যেন জামাতে যান।

Also Read: তাবলিগ জামাতের ছয় উসুল গুরুত্বপূর্ণ

আর একটি বিশেষ দাওয়াতের ধরন তাবলিগ জামাতে দেখা যায়, যাকে মাস্তুরাত জামাত বলা হয়। মাস্তুরাত জামাত হয় সাধারণত দম্পতিদের নিয়ে। এর মধ্য দিয়ে নারীরাও তাবলিগ জামাতের দাওয়াতের কাজে যুক্ত হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কেবল বিবাহিত মেয়েরাই এই সুযোগ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ নারীরা তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে এই জামাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এ ধরনের জামাত সাধারণত সাত দিনের হয়ে থাকে।

জামাতের সদস্যরা যখন অন্য এলাকায় যান, তখন পুরুষেরা মসজিদে ও নারীরা কোনো এক নিবেদিতপ্রাণ তাবলিগ জামাতের সাথির বাড়িতে অবস্থান করেন। এ ক্ষেত্রে সাধারণত একজন অভিজ্ঞ সাথির বাড়িকেই বেছে নেওয়া হয়। এই জামাতে নারীদের জন্য বয়ানের সুযোগও রাখা হয়। নারীরা নিজেরাও বয়ান করে থাকেন এবং তাঁদের আসরে অভিজ্ঞ পুরুষ সাথিদের দিয়েও বয়ান করানো হয়। সে ক্ষেত্রে পর্দার বিষয়টা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। সাধারণত পুরুষেরা যখন অন্য একটি কক্ষ থেকে তাদের বয়ান করে থাকেন, তখন নারীরা একটি কক্ষে থাকেন। সব আয়োজন এমনভাবে করা হয় যাতে নারীরা পাশের ঘর থেকে বয়ান শুনতে পান। অন্য ঘরে বসে নারীরা যাতে পুরুষদের বয়ান স্পষ্ট শুনতে পান, সে জন্য অনেক সময় মাইকের ব্যবহারও করা হয়।

একটি মসজিদে তিন দিনের বেশি সাধারণত থাকা হয় না। তাঁদের এই প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, কত বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে দাওয়াতের কাজ নিয়ে পৌঁছানো যায়, সেটি।

দাওয়াতের অন্যতম একটি পদ্ধতি হচ্ছে চিল্লা। চিল্লা মানে হচ্ছে টানা ৪০ দিন দাওয়াতের কাজের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে একটি ভিন্ন এলাকার মসজিদে অবস্থান করে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। এখানে পরিকল্পিতভাবেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে দাওয়াতের কাজ করার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়।

Also Read: আখেরি মোনাজাতের মহিমা

চিল্লার সময় তাবলিগের সাথিরা তিন দিন করে একটি মসজিদে অবস্থান করেন। এরপর তাঁরা অন্য একটি মসজিদে চলে যান। এভাবে ৪০ দিনে যতগুলো মসজিদে যাওয়া যায়, তাঁরা সে চেষ্টাই করে থাকেন। চিল্লা দেওয়ার জন্য প্রথমত স্থানীয়ভাবে একটি দল গঠন করা হয়। যদি একটি সম্পূর্ণ দল গঠিত না-ও হয়, তাহলে তাঁরা কয়েকজন মিলেই কাকরাইল মসজিদে চলে যান। সেখান থেকে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় সদস্যরা তাঁদের জন্য একটি জামাতের ব্যবস্থা করেন। আবার এমনও হয় যে স্থানীয়ভাবেই মানুষদের উৎসাহী করে একটি দল গঠন করে কাকরাইল মসজিদে গিয়ে তাঁরা কেন্দ্রীয় সদস্যদের অনুমতি সাপেক্ষে চিল্লা দেওয়ার জন্য একটি এলাকায় চলে যান।

চিল্লা দেওয়ার জন্য সদস্য সংগ্রহ-প্রক্রিয়ায় একধরনের রেফারেন্স পদ্ধতির চর্চা দেখা যায়। এর অর্থ হলো কেউ যদি চিল্লায় যেতে চান, তাহলে তাঁকে স্থানীয় একজন তাবলিগের মুরব্বি (অভিজ্ঞ সাথি বা সদস্য) কর্তৃক মনোনীত হতে হবে। এর উদ্দেশ্য হলো, তাঁর সম্পর্কে তাবলিগ জামাতের কোনো না কোনো সাথি বিস্তারিতভাবে জানেন।

Also Read: তাবলিগের দাওয়াত

এরপর প্রতিটি জামাতের নামের লিস্ট তাঁদের মসজিদে জমা বা লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দাওয়াতের সময়কালে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধ করা সহজ হয়। তবে আগে তাবলিগ জামাতের চিল্লা দেওয়ার বিষয়টি এতটা নিয়মতান্ত্রিক ছিল না। সাম্প্রতিক কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার ফলে তাঁরা এ ধরনের নিয়মতান্ত্রিক কিছু বিষয় মেনে চলছেন। তাবলিগ জামাতের মধ্যে এ রকম তিনটি চিল্লার কথা বা দাওয়াতের কাজের কথা বলা আছে, যেখানে নিয়ম করা আছে ১২০ দিন দাওয়াতের কাজে সময় ব্যয় করার কথা। এই তিন চিল্লার জামাত সাধারণত একটানা হয়ে থাকে। তবে তাঁরা এক চিল্লা হয়ে যাওয়ার পর আবার কাকরাইল মসজিদে চলে আসেন। কাকরাইল মসজিদে এসে তাঁরা আবার কিছু নির্দেশনা নিয়ে অন্য একটি এলাকায় চলে যান। এমন করে একটি চিল্লা সম্পন্ন করে তাঁরা অন্য একটি চিল্লার জন্য বের হয়ে যান। এভাবে তাঁরা তিন চিল্লা সম্পন্ন করে থাকেন। সবচেয়ে বড় দৈর্ঘ্যের যে জামাতের কথা জানা যায়, সেটি চলে এক বছর ধরে। তবে এই এক বছর ধরে চলা জামাত প্রযোজ্য বিশেষভাবে মাদ্রাসা থেকে পাস করে আসা ছাত্রদের বেলায়। তবে সাধারণ মানুষেরাও এতে অংশ নিতে পারেন। এ জন্য একজনকে আগে নিবেদিতপ্রাণ সদস্য বা সাথি হতে হয়। মাদ্রাসার ছাত্ররা যদি টানা এই এক বছর সময় ধরে দাওয়াতের কাজে অংশ নিতে পারেন, তাহলে ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে তাঁরা যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী হবেন, তাঁকে তাবলিগ জামাতের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পদ হিসেবে ভাবা হয়ে থাকে। ফলে তাঁরা দাওয়াতের কাজে আরও বেশি প্রভাব রাখতে পারবেন বলে মনে করা হয়। আবার যেহেতু তাঁদের লেখাপড়ার বিষয়ই হলো ইসলাম ধর্ম, তাই সমাজে তাঁদের বৈধতাও অন্যদের চেয়ে বেশি। ফলে তাঁদের তাবলিগের সদস্য হিসেবে তৈরি করতে পারলে সমাজে তাঁরা অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে পারবেন। এ কারণেই মাদ্রাসার ছাত্রদের এক সাল মেয়াদি দাওয়াতের কাজে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, উৎসাহিতও করা হয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে অন্যরাও চাইলে এতে অংশ নিতে পারবেন না।

Also Read: ইজতেমা শুরু হয় যেভাবে

বড় দৈর্ঘ্যের জামাতে যাওয়ার জন্য হুট করেই কেউ একজন নির্বাচিত হতে পারবেন না। ছোট ছোট কাজ করতে করতে যখন একজনকে মনে করা হয় যে তিনি এখন জামাতে যেতে পারবেন, তখনই তাঁকে নির্বাচিত করে জামাতে পাঠানোর জন্য উৎসাহিত করা হয়। চিল্লাকে একটি প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র হিসেবেও দেখা হয়। ধারণা করা হয় যে চিল্লায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তাবলিগ জামাতের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে যোগদান করবেন। যদিও এখানে বলে রাখা ভালো যে তাবলিগ জামাতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদ নির্ধারণ করা হয় না। বরং বলা যায় যে এখানে যে কেউ সদস্য হতে পারেন এবং যে কেউ যেকোনো মুহূর্তে চলেও যেতে পারেন। অনুসারী হওয়া বা সদস্য হওয়ার বিষয়টি কাগজে-কলমে লেখা বা নিবন্ধিত হয় না। এ বিষয়টিকে যেমন তাবলিগ জামাতের একটি দুর্বল জায়গা হিসেবে দেখা হয়, তেমনি এই সহজ-সরল নিয়মের কারণেই অনেক মানুষ জামাতের কর্মী বা সাথি হিসেবে যোগদান করে থাকেন। কারণ, এখানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা নেই। তবে নৈতিক একটি বাধ্যবাধকতা এখানে থেকেই যায়। চিল্লা থেকে আসার পর একজন ব্যক্তিকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হয়। কারণ, চিল্লা দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য একটি কাজ, যেখানে একজনের অনেক বেশি উদ্দীপনা থাকা জরুরি। পাশাপাশি চিল্লা দেওয়াকে মর্যাদাকর ও তাবলিগের একজন সাথির একধরনের বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। চিল্লা দেওয়ার পর সেসব সদস্যের দায়দায়িত্ব অনেকটাই বেড়ে যায়। কেননা, তাঁদের তখন নিজ নিজ এলাকায় তাবলিগ জামাতের কাজগুলোকে আরও শক্তিশালী করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে তাঁরা যেন নিজ নিজ এলাকায় ঠিকভাবে আরও বেশি কাজ করতে পারেন, সেই দায়িত্বটা তাঁদের ওপর বর্তায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নিজের এলাকার আরও পাঁচটি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা। এর অর্থ তাঁদের জিম্মাদারি বৃদ্ধি পাওয়া। নির্দিষ্ট দায়িত্বের পাশাপাশি তাঁদের কাঁধে চেপে বসে আরও কিছু করণীয়। সূত্র: তাবলিগ জামাত: বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিসরে, বুলবুল সিদ্দিকী, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯

Also Read: সুরা বুরুজে আছে এক বুদ্ধিমান বালকের ঘটনা