‘অপরিণত নবজাতকের সঠিক শুরুতে নিশ্চিত করি সুন্দর ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে  অংশগ্রহণকারীরা ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে
‘অপরিণত নবজাতকের সঠিক শুরুতে নিশ্চিত করি সুন্দর ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে  অংশগ্রহণকারীরা ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে

অপরিণত নবজাতকের সঠিক শুরুতে নিশ্চিত করি সুন্দর ভবিষ্যৎ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘অপরিণত নবজাতকের সঠিক শুরুতে নিশ্চিত করি সুন্দর ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ১৭ নভেম্বর ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে।

আলোচনা

 শেখ ছাইদুল হক

অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

দম্পতিরা সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আগে থেকেই তাঁদের সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি থাকা দরকার। মাতৃস্বাস্থ্য প্রস্তুতি ও মাতৃস্বাস্থ্যের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারলে অপরিণত জন্ম অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এর সঙ্গে মানসম্মত প্রসবপূর্ব সেবা-ডব্লিউএইচও অনুমোদিত এএনসি প্রোটোকল-যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে ইতিবাচক ফল পাওয়া সম্ভব। পাশাপাশি ইউনিসেফের সহায়তায় আমরা মাল্টিপল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্ট চালু করেছি। এটি আরও বিস্তৃত ও টেকসই করতে পারলে প্রিম্যাচিউরিটি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হবে।

আমরা যদি প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব নিশ্চিত করতে পারি এবং জনসচেতনতা বাড়াতে পারি, তাহলে মাতৃমৃত্যুর পাশাপাশি নবজাতকের অসুস্থতা ও মৃত্যুহার কমবে। একই সঙ্গে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি স্তরের সেবাগুলো আধুনিক করা জরুরি। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাবসেন্টার ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছি। তবে এই তিন সেবাকে এখনো পুরোপুরি সমন্বিত করা সম্ভব হয়নি। সমন্বিত সেবা নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হবে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে জনবলসংকট এখনো বড় সমস্যা। বিশেষ করে যেসব জেলায় মেডিকেল কলেজ নেই, সেখানে নবজাতক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ খুবই জরুরি। মেডিকেল কলেজ থাকা জেলাগুলোতে এই সংকট তুলনামূলক কম।

জনবল নিয়োগের পাশাপাশি তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কার্যকর মনিটরিং জোরদার করা দরকার। আমরা কী আউটপুট চাই, তা স্পষ্ট জানিয়ে নিয়মিত তদারকি না করলে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। অপরিণত নবজাতকদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার থাকা প্রয়োজন। এ জন্য স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটালাইজেশন এবং ইউনিক হেলথ কার্ড বাস্তবায়ন জরুরি। এতে প্রতিটি নবজাতককে ট্র্যাক করা সম্ভব হবে এবং তথ্যভিত্তিক নীতিনির্ধারণ সহজ হবে। বর্তমানে অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। ইউনিসেফের সহায়তায় আমরা কিছু সরঞ্জাম দিয়েছি। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক যন্ত্র অচল হয়ে পড়ে। এ জন্য বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাতে যন্ত্রগুলো দীর্ঘদিন কার্যকর থাকে।

মাতৃস্বাস্থ্য ও অপরিণত নবজাতকের সমস্যার সমাধান সরকার একা করতে পারবে না। সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও উন্নয়ন–সহযোগীদের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগই পারে এটি মোকাবিলা করতে। সবাই মিলে প্রতিরোধ, প্রচার ও চিকিৎসামূলক ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে একটি সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দিতে পারব।

ফিরোজা বেগম

প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

অপরিণত জন্ম কেন হচ্ছে, সেটি আগে আমাদের বুঝতে হবে। এই সমস্যার কারণ একাধিক। আমি যদি প্রধান কারণগুলোর কথা বলি, তাহলে প্রথমেই আসে মায়ের বয়স। খুব কম বয়সে বা বয়স একটু বেশি হয়ে গেলে গর্ভধারণ করলে অপরিণত জন্মের ঝুঁকি বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, যাঁরা নিয়মিত প্রসবপূর্ব সেবা নেন না, তাঁদের ঝুঁকি বেশি। একইভাবে যাঁদের শরীরের ওজন খুব কম বা খুব বেশি, তাঁদেরও এই ঝুঁকি রয়েছে।

আরেকটি বড় কারণ হলো চিকিৎসাবিহীন সংক্রমণ। উপসর্গহীন প্রস্রাবের সংক্রমণ, যোনি সংক্রমণ বা ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিসের চিকিৎসা না হলে ঝিল্লি ফেটে গিয়ে অপরিণত প্রসব হতে পারে। পাশাপাশি মাতৃ–মানসিক চাপও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আজকের কর্মজীবী নারীদের মধ্যে যাঁরা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকেন বা নিয়মিত নাইট ডিউটি করেন, তাঁদের মধ্যে অপরিণত জন্মের ঝুঁকি বেশি দেখা যায়।

এ ছাড়া কিছু জরায়ু-সংক্রান্ত সমস্যাও দায়ী। যেমন ইউনিকর্নুয়েট বা বাইকর্নুয়েট জরায়ু, জরায়ুমুখের অক্ষমতা ইত্যাদির কারণে ঝিল্লি ফেটে অপরিণত প্রসব হতে পারে। বাংলাদেশে সিজারিয়ান বেড়ে যাওয়ার কারণে প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার ঘটনাও বাড়ছে, যা অনেক সময় জরুরি অপারেশন করাতে বাধ্য করে। একাধিক গর্ভধারণের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বেশি থাকে।

এখন প্রশ্ন, কীভাবে প্রতিরোধ করব? এর মূল চাবিকাঠি হলো সঠিক প্রসবপূর্ব সেবা। কিন্তু সমস্যা হলো, অনেক গর্ভবতী নারী নিয়মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন না। যাঁরা আসেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব হলো সঠিক ইতিহাস নেওয়া। আগে কখনো অপরিণত জন্ম হয়েছে কি না, কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগ আছে কি না; যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হৃদ্‌রোগ, এসএলই—এসব মূল্যায়ন করতে হবে।

প্রসব সব সময় নবজাতক বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে হওয়া জরুরি। যেখানে শিশুর যত্নের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, সেখানে শিশুকে নয়, মাকেই দ্রুত স্থানান্তর করা ভালো। এ জন্য কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুবই প্রয়োজন, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের আগেভাগে শনাক্ত করে সঠিক কেন্দ্রে পাঠানো যায়।

মো. মাহবুবুল হক

সভাপতি, বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম (বিএনএফ)

শিশু জন্মের পর প্রথম কে তাকে সামলায়, কে তার প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা করে—এই মুহূর্তটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে এই জায়গাটাতেই বড় ঘাটতি আছে। ডেলিভারি রুমে দক্ষ কর্মীর অভাব প্রকট। এই জায়গাটায় নজর দিতে হবে।

নিওনেটাল ফোরাম থেকে আমরা স্বাস্থ্যকর্মী ও স্টাফদের প্রশিক্ষণ দিতে পারি, যেন বাচ্চা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ হাতে ব্যবস্থাপনা পায়। সরকার চাইলে এই কাজে আমাদের ব্যবহার করতে পারে। কারণ, সময়মতো ও সঠিকভাবে শিশুর প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা হলে তার ফল অনেক ভালো হয়।

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো অপ্রয়োজনীয় রেফার। আমি দেখি, ১,৯০০ গ্রাম বা ২,০০০ গ্রামের বাচ্চাকেও রেফার করা হচ্ছে, অথচ সাধারণভাবে ১,৭০০-১,৮০০ গ্রামের নিচের বাচ্চাদেরই উচ্চতর কেন্দ্রে নেওয়া দরকার। বাংলাদেশের বাস্তবতায় রেফার মানেই বিশাল ঝামেলা। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়। অপ্রয়োজনীয় রেফার শিশুর জন্য ঝুঁকি আরও বাড়ায়। এটাও কমাতে হলে চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দরকার—কাকে রেফার করব, কাকে করব না, সে সিদ্ধান্ত যেন তাঁরা সঠিকভাবে নিতে পারেন।

রেফার করলেও উচ্চতর কেন্দ্রে জায়গা পাওয়া যায় না। দেশে ৬২টি স্ক্যানু হয়েছে, কিন্তু জন্মহারের তুলনায় সেই বেড একেবারেই অপ্রতুল। যেখানে এক বেডে একজন রোগী থাকার কথা, সেখানে পাঁচ-ছয়জন বাচ্চা রাখতে হচ্ছে। ফলে সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। মানসম্মত সেবায় প্রবেশাধিকারের অভাব এবং সেবায় সমতার ঘাটতি একেবারে বাস্তব।

আরেকটা বড় সমস্যা হলো বেসরকারি ক্লিনিক। সরকারি হাসপাতালের বাইরে অধিকাংশ মানুষ প্রাইভেট ক্লিনিকে যায়, কিন্তু সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের বড় অংশই প্রশিক্ষণের বাইরে। অনেক সময় তারা আনুষ্ঠানিকভাবে নার্সও না, কিন্তু তারাই সেবা দিচ্ছে। আমি তাদের সরাতে পারব না, কিন্তু তাদের প্রশিক্ষিত করা তো সম্ভব। এই চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে এগোতে পারলে আমাদের অগ্রগতি আরও দৃঢ় হবে।

মো. আব্দুল মান্নান

চেয়ারম্যান, নিওনেটোলজি বিভাগ, বিএমইউ; মহাসচিব, বিপিএস

সারা পৃথিবীর তুলনায় বাংলাদেশে অপরিণত প্রসবের হার খুব বেশি। প্রতিবছর দেশে প্রায় ৩০ লাখ প্রসব হয়, যার মধ্যে প্রায় ৬ লাখই অপরিণত। নবজাতকের মৃত্যু কমাতে হলে আমাদের মূলত এই অপরিণত নবজাতকদের দিকেই নজর দিতে হবে। কারণ, প্রতি ১০০টি নবজাতকের মৃত্যুর মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশই ঘটে অপরিণত জন্মের কারণে।

এই মৃত্যুর কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। একটি হলো হাইপোথারমিয়া, অর্থাৎ বাচ্চা খুব বেশি ঠান্ডা হয়ে যাওয়া। আরেকটি হলো হাইপোগ্লাইসেমিয়া, অর্থাৎ বাচ্চার খাবার না পাওয়া বা রক্তে শর্করার ঘাটতি। এরপর রয়েছে শ্বাসকষ্ট এবং সংক্রমণ। জন্মগত ত্রুটি থাকলেও সেটার হার তুলনামূলক কম। আমাদের দেশে মাতৃমৃত্যু, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু আর নবজাতকের মৃত্যুহার কমেছে—এটা আমাদের বড় অর্জন। সরকার, পেশাজীবী সংগঠন এবং ইউনিসেফসহ উন্নয়ন-সহযোগীরা সবাই মিলে এই অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে। তবে এই অর্জনগুলো শুধু বড় হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে জেলা, এমনকি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর একটি হস্তক্ষেপ হলো ক্যাঙারু মাদার কেয়ার বা কেএমসি, যার আরেক নাম ‘জিরো সেপারেশন’ বা ‘নো সেপারেশন’। অর্থাৎ জন্মের পর বাচ্চাকে মায়ের বুকের ওপর রেখে দেওয়া, আলাদা না করা। যে শিশুর লাইফ সাপোর্ট লাগছে না, এমন সব অপরিণত শিশুকেই এভাবে মা-শিশু কাছাকাছি রাখা সম্ভব। এর জন্য বাড়তি খরচও নেই, বিশেষ যন্ত্রপাতিও লাগে না।

এ ছাড়া বিলম্বিত কর্ড ক্ল্যাম্পিং করলে বাচ্চা অতিরিক্ত রক্ত পায়, এতে তার অসুস্থতা কম হয় এবং ভবিষ্যৎও ভালো হয়। ডব্লিউএইচও নতুনভাবে আইকেএমসি ও ‘মাদার স্ক্যানু’ ধারণা সামনে এনেছে, যেখানে অসুস্থ নবজাতকের সঙ্গে মা-ও হাসপাতালে থাকবেন। এতে সংক্রমণ কমবে, বুকের দুধ সহজ হবে, শ্বাসকষ্ট কমবে, হাসপাতালে থাকার সময় ও খরচ কমবে।

নবজাতক যেন শুধু বেঁচে না থাকে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকে, সে লক্ষ্যই আমাদের সামনে রাখতে হবে। অন্ধত্ব, শ্রবণশক্তি হারানো বা মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যার মতো জটিলতাও আমাদের গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

আমাদের দেশে দক্ষ সেবাদানকারী দ্বারা দক্ষ প্রসবের হার এখন ৭৮ শতাংশ। তবু বাড়িতে প্রসব হচ্ছে ২৯ শতাংশ। প্রসবপূর্ব সেবা বা এএনসি ওয়ান কভারেজ দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশে। আর প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার ৭১ শতাংশ। সংখ্যার দিক থেকে এগুলো ইতিবাচক অগ্রগতি, কিন্তু গুণগত দিক থেকে এখনো বড় ঘাটতি রয়ে গেছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, দ্রুত বুকের দুধ খাওয়ানো এবং স্কিন টু স্কিন কন্টাক্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ কমে যাওয়া। এর প্রধান কারণ সিজারিয়ান ডেলিভারির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।

বর্তমানে মোট সি সেকশনের হার ৫২ শতাংশ, শহরে ৫৬ শতাংশ এবং গ্রামে ৫০ শতাংশ। এর ফলে মায়ের সঙ্গে নবজাতককে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে এবং তাতেই এই গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ আরলি ইনিসিয়েশন অব ব্রেস্টফিডিং এবং স্কিন টু স্কিন কন্টাক্ট নবজাতকের জন্য অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু স্কিন টু স্কিন কন্টাক্ট হচ্ছে মাত্র ৬.৬ শতাংশ ক্ষেত্রে।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ মা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। কৈশোরকালীন গর্ভধারণের হার বিডিএইচএস-এ ছিল ৮৩ শতাংশ, যা এমআইসিএসে বেড়ে ৯২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ কভারেজ বাড়লেও এর সমান্তরালে কিছু ঝুঁকিও বেড়েছে।

ইউনিসেফের কৌশল হলো শুধু কভারেজ বাড়ানো নয়, বরং মানসম্মত ও কার্যকর কভারেজ নিশ্চিত করা এবং সমতার ওপর জোর দেওয়া। এ জন্য তথ্য-প্রমাণভিত্তিক হস্তক্ষেপকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে সর্বজনীন কভারেজে নিয়ে যেতে হবে।

‘রিচিং এভরি মাদার নিউবর্ন স্ট্র্যাটেজি’র মাধ্যমে এএনসি কভারেজ এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে ট্রিপল এলিমিনেশন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং শিশুদের রক্তে অতিরিক্ত লেডের মাত্রার দিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে এসেনশিয়াল নিউবর্ন কেয়ার ও কমিউনিটিভিত্তিক ক্যাঙারু মাদার কেয়ার দেওয়া সম্ভব। ফ্যাসিলিটি পর্যায়ে সরকারকে স্ক্যানু স্থাপনে ইউনিসেফ সহায়তা করছে। বর্তমানে ৫১ জেলায় ৬২টি হাসপাতালে স্ক্যানু রয়েছে। তবে এখানে অতিরিক্ত চাপ এবং বেডস্বল্পতার সমস্যা রয়েছে। শুধু স্ক্যানুর সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, সেখানে মানসম্মত পরিচর্যাও নিশ্চিত করতে হবে।

মাতৃ পুষ্টি উন্নয়নের জন্য মাল্টিপল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্টেশন কর্মসূচি জাতীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণে আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। পাশাপাশি স্ক্যানু থেকে ছাড়পত্র পাওয়া শিশুদের ফলোআপ নিশ্চিত করতে ওপেন এমআরএস ও ওপেন এসআরপির মাধ্যমে ডিজিটাল ফলোআপ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে।

নবজাতকের মৃত্যু কমাতে হলে আমাদের মাতৃস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। কারণ, অধিকাংশ নবজাতকের মৃত্যু ঘটে প্রসবের সময়, আর সেই সময় যদি আমরা মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হবে না।

সৈয়দ কামরুল ইসলাম

পরিচালক (প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা),স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

স্বাস্থ্যসেবার ধারাবাহিকতা, কার্যকারিতা ও উন্নয়নের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে অপারেশন প্ল্যানের মাধ্যমে নয়, বরং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলধারার মাধ্যমে এটি পরিচালিত হবে।  ধীরে ধীরে যা প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি মডেলের মাধ্যমে পরিচালিত হতো, তা মূল ব্যবস্থায় স্থানান্তর করা হবে। এর মধ্যে প্রাইমারি হেলথকেয়ারের পরিচালক হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো—যেসব কার্যক্রম আগে এমএনসি এএইচ অপারেশন প্ল্যানে ছিল, বিশেষ করে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশু স্বাস্থ্য এবং এডলেসেন্ট হেলথ সংক্রান্ত কার্যক্রম—সেগুলো উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় পিএসসির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।

বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন একক সংস্থা বা ব্যক্তি করতে পারবে না; এটি সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্ভব। তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উন্নয়ন সহযোগী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, পেশাজীবী সংগঠন—যেমন বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম, ওজিএসবি এবং বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটি—এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে আমরা একযোগে কাজ করছি।

ডব্লিউএইচও, ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, আইসিডিআরবি, সেভ চিলড্রেন, প্রজন্ম রিসার্চ ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আমরা তথ্য-প্রমাণ ভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। এর ফলে স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভালো অভিজ্ঞতা ছড়ানো, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গবেষণা ও নীতি প্রণয়নে সহায়তা হচ্ছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় মেডিসিন ও সরঞ্জাম সরবরাহ, এবং প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।

উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় আমরা গ্রামীণ ও শহরের দুর্গম এলাকায় সেবা পৌঁছে দিচ্ছি। কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রসবপূর্ব সেবা, নিরাপদ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব এবং নবজাতক ও শিশুর মানসম্মত প্রাথমিক সেবার গুরুত্ব জনগণকে জানাচ্ছি।

আমাদের অংশীদারিত্ব —বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও যারা আছেন, এবং যারা পেশাজীবী সংগঠন আছেন—তাঁদের সাথে আমরা সমন্বয়ের মাধ্যমে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারব বলে আমি মনে করি। এবং আমি আশাবাদী যে আমাদের দেশে মাতৃ এবং নবজাতক স্বাস্থ্যের মান আরও উন্নত করতে পারব।

নাসির আহমেদ

পরিচালক (মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

আমরা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য উইংয়ের মাধ্যমে সারা দেশে মূলত মাঠপর্যায়ে কাজ করি। যদিও ঢাকা শহরে আমাদের তিনটি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো আছে, প্রধান কাজ মাঠপর্যায়ে।

তবে আমাদের প্রিভেন্টিভ দিকের ওপর জোর দিতে হবে। ইউনিয়ন এবং বাড়ি বাড়ি পর্যন্ত আমাদের অ্যাকসেস রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন ও ওজিএসবি স্টাফদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, কিন্তু তারা নির্দিষ্ট সময় পর অন্যত্র চলে যায়, আর দক্ষ জনবলের ঘাটতি দেখা দেয়।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, চার-পাঁচ বছর ধরে ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর (এফডব্লিউভি) নিয়োগ দিতে পারিনি। তারা ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র। অনেকে মাসে ১০০-১৫০টি ডেলিভারি করেন। তাদের প্রতিশ্রুতি ও মানুষের বিশ্বাসেই আমরা প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম চালাতে পারি। আগে ট্রেডিশনাল বার্থ অ্যাটেনডেন্টের কারণে অদক্ষ হাতে ডেলিভারি হতো, কিন্তু এখন প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে স্কিন-টু-স্কিন কন্টাক্ট ও ব্রেস্টফিডিং পরামর্শ দেওয়া যায়।

বর্তমানে ভিজিটরের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে বাংলাদেশে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এফডব্লিউভি অথবা মিডওয়াইফ দেওয়াটা একটা বিশাল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এটিই প্রধান ফোকাসিং পয়েন্ট হওয়া উচিত। কারণ, যাদের অপরিণত জন্মের মাধ্যমে শিশু আছে, সেই পরিবারগুলো বোঝে ট্রিটমেন্ট নিতে গিয়ে তাদের কত আর্থিক ব্যয় এবং কত সমস্যা। জেলা পর্যায়ে বা ঢাকা শহরে এসে সেবা নেওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের সবার নেই।

প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোরও একটি নীতিমালা থাকা উচিত। তারা যেন এনআইসিইউতে বা কম জন্ম ওজনের শিশুদের জন্য তাদের আর্থিক ব্যাপারে একটি ঘোষণা দেয়। তারা এক্সপার্ট জনবল তৈরি করতে চাইছে, তাদের একটা ভূমিকা থাকা উচিত। তারা বিশেষজ্ঞ জনবল তৈরি ও কম জন্ম ওজনের শিশুদের জন্য আর্থিক ঘোষণা করলে সরকারি হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে। সরকার ও উন্নয়ন–সহযোগীর সমন্বয়ে স্ক্যানু সাপোর্ট, প্রশিক্ষণ এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে, নীতিমালা এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া দেশের মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্য কার্যক্রম সফল হবে না।

নাসরীন আখতার

উপপরিচালক (প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা), সাপোর্ট সার্ভিস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুহারের মূল কারণ হলো অপরিণত জন্ম (প্রি–ম্যাচিউরিটি) এবং কম ওজনের জন্ম। অপরিণত জন্মের ঝুঁকি মূলত কম বয়সে গর্ভধারণ, বাল্যবিবাহ, মাতৃ অপুষ্টি, সংক্রমণ, উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-একলাম্পসিয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ সিজারিয়ান হার—যা এখন ৫২ শতাংশ এবং সীমিত প্রসবপূর্ব সেবা।  দক্ষ সেবা, কার্যকর স্বাস্থ্যসুবিধা এবং শক্তিশালী রেফারেলব্যবস্থা নবজাতকের বেঁচে থাকার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

প্রমাণভিত্তিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মানসম্মত প্রসবপূর্ব সেবা, দক্ষ প্রসব সহায়ক, জরুরি প্রসূতি সেবা, এক মিনিটের মধ্যে শ্বাস নেওয়ানো, এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো ও এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং।  

অগ্রগতি হিসেবে ২০১৬ থেকে ৪৫০টি কেন্দ্রে কেএমসি, ৬২টি বিশেষ নবজাতক পরিচর্যা ইউনিট ৫১ জেলায় চালু হয়েছে। কিছু কেন্দ্রে মাদার স্ক্যানু শুরু হয়েছে এবং কমিউনিটি ফলোআপ কার্যক্রম চলছে। চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সীমিত প্রবেশাধিকার, অপর্যাপ্ত নবজাতক ইউনিট, বাড়িতে উচ্চ প্রসব, আউট অব পকেট খরচ, অপর্যাপ্ত মানবসম্পদ, প্রশিক্ষণ ও তথ্যের ঘাটতি এবং বাজেটের সীমাবদ্ধতা।

প্রয়োজন মানসম্মত প্রসবপূর্ব ও নবজাতক পরিচর্যা, দক্ষ সেবা, কেএমসি সম্প্রসারণ, জেলা স্তরের মানবসম্পদ নিশ্চিতকরণ এবং সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, পেশাজীবী সংস্থা ও কমিউনিটির যৌথ অংশীদারত্ব। স্বাস্থ্য বাজেট জিডিপির ২ শতাংশ করা খুবই জরুরি।

ফারুক আহমেদ

মেডিকেল ডিরেক্টর, ল্যাবএইড

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, সরকারি খাতের সীমাবদ্ধতা, জনবল ও অবকাঠামোর চ্যালেঞ্জ দেখেছি। তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো নিজেদের শক্তি কাজে লাগিয়ে সেবা প্রসারিত করছে। ১৯৯০ সালে শরীয়তপুরে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, তখন টিবিএ বা ট্র্যাডিশনাল বার্থ অ্যাটেনডেন্টদের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা হতো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কমিউনিটিভিত্তিক কেয়ারগিভার সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব। ডাক্তার, নার্স, দাদি, নানি বা স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করলে স্বাস্থ্যসেবার শক্তিশালী ভিত্তি হবে।

বেসরকারি হাসপাতালগুলো নিজেদের উন্নয়ন করছে শুধু, সরকার তাদের তথ্য চাচ্ছে। জনবল উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা অপরিহার্য। এ ফ্রেমওয়ার্কে বেসরকারি খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য। এনআইসিইউ ও বিশেষায়িত বিভাগ শিশুদের সেবা নিশ্চিত করছে, তবে প্রশিক্ষণ ও মানসম্মত পরিচালনার জন্য সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্ব প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক দিকেও বেসরকারি খাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের অর্থনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের বিনিয়োগ এবং সেবার প্রসার দেশের স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করবে। এতে নবজাতক ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন সম্ভব হবে। সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, সরকারিভাবেই বেসরকারি এই খাতের জনবল প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সহযোগিতা করা উচিত।

বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারকে সমর্থন দিয়ে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করছে। তবে প্রশিক্ষণ, জনবল উন্নয়ন ও নীতিমালাসংক্রান্ত সমন্বয় সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আরও কার্যকর করা যায়।

কোহিনুর জাহান শ্যামলী

শিশুবিষয়ক কনসালট্যান্ট,  ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট  জেনারেল হাসপাতাল, শেরপুর

বাংলাদেশে অনেক উপজেলায় কোনো পূর্ণাঙ্গ নবজাতক সেবা নেই। নবজাতকের ডেলিভারি হলেও অক্সিজেন, রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার বা মৌলিক পরিচর্যা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। আমার দায়িত্বে থাকা স্ক্যানুতে নবজাতকের চাপ অতিরিক্ত, আশপাশের ৯টি উপজেলা থেকে আসা নবজাতকের চাপ প্রতিদিন বাড়ছে।  ঢাকা মেডিকেলে স্ক্যানুর সিট ২৫টি আর আমাদের জেলা হাসপাতালে মাত্র ৮টি। ইউনিসেফ ও সরকারের সহায়তায় ২০২১ সাল থেকে এগুলো চালু হয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়।   

আমি পেডিয়াট্রিশিয়ান হলেও নবজাতক বিশেষজ্ঞ না হয়েও সেবা দিতে বাধ্য হচ্ছি। জেলাগুলোতে নবজাতক ইউনিট স্থাপন এবং অন্তত একজন নবজাতক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ অপরিহার্য। যেসব জেলায় মেডিকেল কলেজ নেই, সেখানে বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। সরকারি জনবল নিয়োগে সময় লাগে, তাই প্রাথমিকভাবে অল্প খরচে নার্স, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও গার্ড দিয়ে ইউনিট চালানো সম্ভব। প্রিম্যাচিউর শিশুর আরওপি স্ক্রিনিং জন্য জেলা স্তরে প্রশিক্ষিত চক্ষুরোগবিশেষজ্ঞ থাকা জরুরি। নতুন ইউনিটে মাতৃ ও নবজাতকের সেবা সমন্বয় অপরিহার্য। বুকের দুধ দ্রুত খাওয়ানোর জন্য মায়ের জন্য আলাদা রুম এবং সাপোর্টের জন্য ‘নানি’ থাকা আবশ্যক। এ ছাড়া বাঁচা শিশুদের মরবিডিটি, যেমন সেরিব্রাল পালসি নিরীক্ষার জন্য জেলা স্তরে মাসে অন্তত একবার পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিস্টের ফলোআপ জরুরি। 

মো. নূর এ আলম খান

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা,পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ

উপজেলা লেভেলে মূলত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়, যার বেশির ভাগই প্রতিরোধমূলক। উপজেলা হাসপাতাল এবং তার অধীনে কমিউনিটি ক্লিনিক, সাব–সেন্টার ও ফিল্ড পর্যায়ে শিশুদের ও গর্ভবতী মাকে সেবা দেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইচসিপি ও স্বাস্থ্য সহকারীরা স্বাস্থ্যশিক্ষা দেন, বিপদের লক্ষণ চিহ্নিত করে উপজেলা হাসপাতালে রেফার করেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করেন। ফিল্ড পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী নারী ও নবজাতক শিশুকে চিহ্নিত, টিকা প্রদান এবং কেএমসি ফলোআপ নিশ্চিত করেন।

উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ‘ওয়ান–স্টপ সার্ভিসিং’ হিসেবে এএনসি ও পিএনসি কর্নার চালু আছে। প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা নার্স মায়ের ওজন, রক্তচাপ, হিমোগ্লোবিন, ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে ডাক্তারকে দেখান। লেবার রুম ও প্রয়োজনে সিজারের ব্যবস্থা রয়েছে। কম ওজনের বাচ্চাদের জন্য কেএমসি কর্নার ও ২৪ ঘণ্টা নরমাল ডেলিভারি সেবা চালু আছে।

চ্যালেঞ্জও কম নয়। ডাক্তারদের ঘন ঘন বদলি, প্রশিক্ষিত জনবল ও ডেডিকেটেড মেডিকেল অফিসারের অভাব, ওয়ার্কলোডের চাপ এবং রেফারেল সিস্টেমের অনুপস্থিতি সেবাকে প্রভাবিত করছে। আমাদের বাংলাদেশে রেফারেল সিস্টেমটা এখনো চালু হয়নি। কোন রোগীকে কার কাছে রেফার করতে হবে, এই পরামর্শ দেওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রশিক্ষিত নার্স ও এসএসিএমও যদি কর্নারগুলোতে গাইডলাইন অনুসারে কাজ করেন, সেবার মান বজায় রাখা সম্ভব।

অংশগ্রহণকারী:

শেখ ছাইদুল হক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফিরোজা বেগম, প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)। মো. মাহবুবুল হক, সভাপতি, বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম (বিএনএফ)। মো. আব্দুল মান্নান, চেয়ারম্যান, নিওনেটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ; মহাসচিব, বিপিএস। দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, ইউনিসেফ বাংলাদেশ। সৈয়দ কামরুল ইসলাম, পরিচালক (প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নাসির আহমেদ, পরিচালক (মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। নাসরীন আখতার, উপ পরিচালক (প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা), সাপোর্ট সার্ভিস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফারুক আহমেদ, মেডিকেল ডিরেক্টর, ল্যাবএইড। কোহিনুর জাহান শ্যামলী, শিশুবিষয়ক কনসালট্যান্ট, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট  জেনারেল হাসপাতাল, শেরপুর। মো. নূর এ আলম খান, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।  সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো ।