
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘কাঠামোগতভাবে প্রান্তিক নারীদের অধিকার ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ১৮ নভেম্বর ২০২৫ ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে।
মোহাম্মদ আবু ইউছুফ
সচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
প্রান্তিক নারীদের সমস্যা বহুমাত্রিক। চা–বাগানের শ্রমিক, দৌলতদিয়ার যৌনকর্মী, প্রতিবন্ধী নারী—সবার সমস্যা ভিন্ন, তাই সমাধানও হতে হবে প্রসঙ্গ-নির্দিষ্ট। অনেকেই মনে করছেন, সরকার কিছুই করছে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশে শুধু বয়স্ক ভাতাভোগীই ৬১ লাখ, বিধবা ভাতা আরও প্রায় ৩০ লাখ। এত জনসংখ্যার দেশে সীমিত সম্পদ দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তার কাঠামো পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন।
এই বাস্তবতায় ভাতা ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা করাও বড় বাজেটের চাপ তৈরি করে। তাই কাঠামোগত সমস্যাগুলো বুঝতে হবে—জনসংখ্যা, রাজস্ব ও সীমিত সম্পদ। একইভাবে নারীর অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও প্রবেশগম্যতার ঘাটতি একটি বড় বাধা। বিচারব্যবস্থায় পৌঁছানো, সরকারি সেবা পাওয়া—এসব জায়গায় অভিগম্যতা এখনো দুর্বল। শুধু ভাতা দিয়ে সমস্যা মিটবে না—তাই আমরা ‘ক্যাশ প্লাস ট্রান্সফার’ পদ্ধতি চালু করেছি। এতে নারীরা ভাতার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের উপযোগী দক্ষতা, বাজার-যোগ এবং ১০-৫০ হাজার টাকার ক্ষুদ্র ঋণ পাচ্ছেন। তবে এত বড় জনসংখ্যায় এসব সেবা রাতারাতি বিস্তৃত করা কঠিন। এ জন্য বেসরকারি খাতকে সংবেদনশীল হতে হবে; কারণ, কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস তাঁরাই। নীতিপ্রণেতা হিসেবে আমাদের নিজেদেরও আন্তসংযুক্ত বৈষম্য আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে। নারীদের শিক্ষায়, পুষ্টিতে, তথ্য ও বিচারব্যবস্থায় প্রবেশগম্যতা, পরিবহনসুবিধা—এসব কাঠামোগত অধিকার নিশ্চিত করাই মূল সমাধান।
আমার অনুরোধ, সরকারকে একা দায়ী না করে সবাই মিলে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে। বেসরকারি খাতকে সংবেদনশীল করা, মানবপুঁজির উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ব্যতিরেকে মূল উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব দেওয়া—এগুলোই কাঠামোগতভাবে প্রান্তিক নারীদের অধিকার নিশ্চিত করার পথ।
ইলিরা দেওয়ান
মানবাধিকারকর্মী; সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন
দেশে এখন ৫১ শতাংশ নারী থাকা সত্ত্বেও জাতীয় নির্বাচনের জন্য এখনো ৩৩ শতাংশের জন্য দাবি জানিয়ে যাচ্ছি। সেই জায়গায় প্রান্তিক নারী বা আদিবাসী নারীদের অবস্থান কোথায়, সেটা নতুন করে আর বলার কিছুই নেই।
পাহাড় কি সমতল—সব জায়গায় আদিবাসী নারীরা বৈষম্য এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাঁরা প্রতিনিয়ত ভয়ের সংস্কৃতিতে থাকেন। সেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এত বেশি প্রবল যে নারী বিচার চাইতে আদালতে যাবেন, তিনি তা চিন্তাও করতে পারেন না; বরং মনে করেন যে আমি যখন নির্যাতনের শিকার হলাম, বৈষম্যের শিকার হলাম, আমি বরং চেপে যাই, যাতে লোকজন কম জানে। এই ভয়ের সংস্কৃতি এবং বিচারহীনতা সংস্কৃতি থেকে যত দিন পর্যন্ত আমরা বেরিয়ে আসতে না পারব, যত দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র এটার দিকে দৃষ্টি না দেবে, তত দিন পর্যন্ত আদিবাসী নারীর অধিকারের কথা শুধু আমাদের এভাবেই বলে যেতে হবে।
এই ভয়ের সংস্কৃতি ভাঙতে রাষ্ট্র, সরকার ও প্রশাসনকে সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি প্রকৃত অর্থে বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, তাহলে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রান্তিক নারী ও জনগোষ্ঠীর জন্য স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে—তা হলে বোঝা যাবে তারা প্রকৃত অর্থে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে আন্তরিক।
প্রান্তিক নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রশাসনিক মানসিকতা বদলাতে হবে; সেবাসমূহ সরকারিভাবে প্রচার করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য অনলাইন পদ্ধতির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিকল্প রাখা জরুরি; কারণ, জুম চাষি অনেক নারী লিখতে-পড়তে জানেন না। এমনকি সেখানে পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক নেই। আমি আশা করি, নীতিনির্ধারণী স্তর থেকে এসব বিষয় বিবেচনা করে কার্যকর উদ্যোগ আসবে।
মো. সাইদুর রহমান খান
মহাপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর
সরকারকে সমালোচনা করা সহজ এবং আমরা সেই সমালোচনা সহ্যও করি। কিন্তু সরকারের কাজও কম নয়; সমস্যা হলো প্রচারস্বল্পতা। প্রান্তিক নারীদের জন্য সরকার যে কাঠামোগত সুরক্ষা ও সেবা দিচ্ছে, তা তুলে ধরা জরুরি। প্রান্তিক নারী মানে কেবল দূরবর্তী এলাকার নারী নয়; বরং যাঁরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক বঞ্চনার মধ্যে আছেন—প্রতিবন্ধী নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু, দরিদ্র, বয়োবৃদ্ধ—সবাই এই শ্রেণিতে পড়েন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তর সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাবলয় পরিচালনা করছে। গত বছর আমরা ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছি, চলতি বছরে বরাদ্দ আরও বেশি। তবে আমি ভাতাকে চূড়ান্ত সমাধান মনে করি না—এটি স্বীকৃতির প্রতীক। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও উপবৃত্তিসহ অনেক সরকারি উদ্যোগ রয়েছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, চা–শ্রমিক—সবাই আমাদের কাঠামোগত সুরক্ষার আওতায় আছেন। আমরা সরাসরি তাঁদের কাছে ভাতা পৌঁছে দিচ্ছি, যাতে নারীরা নিজেরাই অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পান।
ভাতার বাইরে আমাদের বিভিন্ন সেবামূলক ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি আছে—পল্লী সমাজসেবা, পল্লী মাতৃকেন্দ্র, শিশু পরিবার, যৌন শোষণের শিকারদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন এবং সারা দেশে সেফ হোম। এগুলো নারীর দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের জন্য অপরিহার্য। আমরা এখন ‘ক্যাশ প্লাস সিস্টেম’-এ যেতে চাই—ভাতার সঙ্গে বিকল্প জীবিকা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও নারী নেতৃত্ব গড়ার কর্মসূচি চালু করছি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বেও নতুন সুযোগ আছে। প্রান্তিক নারীদের নির্যাতন বা বৈষম্যের বিষয়গুলো তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলার জন্য ইউনিয়ন সোশ্যাল ফোর্স গঠন করেছি। আমরা শুধু সহানুভূতি নয়, সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে চাই।
স্নিগ্ধা রেজওয়ানা
সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা যে কাঠামোগত প্রান্তিকতার কথা বলছি, সেটাই আসলে জটিল। দেশে ৫১ শতাংশ নারী থাকা সত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রে তাঁরা প্রান্তিক। তাই প্রান্তিকতা শুধু দল, জাত বা লিঙ্গ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে সমস্যাটা ধরা পড়ে না। চা-বাগানের শ্রমিক, নৃগোষ্ঠী, দলিত বা হিন্দু নারী—সবাইকে এক কাঠিতে মাপলে নীতি কখনো কার্যকর হয় না। তাই পলিসি করতে হলে গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা জরুরি; শুধু নীতি করলেই পরিবর্তন আসে না।
আমাদের বড় সংকট রাষ্ট্র এখনো ভাতাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরোতে পারেনি। ভাতা ও ভিত্তি সব সমস্যার সমাধান নয়। সংবিধান অধিকার দিয়েছে, কিন্তু সংকট রয়েছে সামাজিক মন, চেতনা ও গ্রহণযোগ্যতায়। ডোম, হাজাম বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজকে ব্রিটিশ আমলের মতোই নিচু শ্রেণির কাজে ধরে রেখে নিয়মিত ভাতার জালে আটকে রাখা হচ্ছে, যাতে তাঁদের অনগ্রসরতা টিকে থাকে।
এখনো নারীরা ম্যানহোল পরিষ্কার করেন পুরো শরীর পানিতে নামিয়ে—এটা কাঠামোগত বৈষম্যের নির্মম চিত্র। নারী শ্রমিকের মজুরিবৈষম্য এখনো আইনি কাঠামোয় জায়গা পায়নি। গৃহশ্রমিক নারীর ন্যূনতম বেতন নির্ধারণেও কোনো আইন নেই।
প্রতিবন্ধিতাকে আলাদা শ্রেণি ধরে দেখাও সাংস্কৃতিক অধস্তনতার অংশ। র্যাম্প থাকা নাগরিক অধিকার—এটার জন্য আলাদা শ্রেণির প্রয়োজন নেই। আমাদের পাঠ্যবইয়ে এখনো সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ নেই—এটাও কাঠামোগত ব্যর্থতা। প্রান্তিক নারীর নিরাপত্তা নিয়েও রাষ্ট্রকাঠামোগতভাবে দুর্বল। ধর্ষণের ঘটনায় ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ, আইনি সহায়তার অভাব এবং শিশু ভিকটিমদের নিরাপদ আশ্রয়ের অনুপস্থিতি—সবই দেখায় যে ভাতা নয়, বাস্তব নিরাপত্তা জরুরি।
মাহবুবা আক্তার
পরিচালক, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন, ব্লাস্ট
আমরা যখন দলিত জনগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী ও আদিবাসী নারীদের সঙ্গে কাজ করছিলাম, তখন একদম প্রান্তে গিয়ে তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতা শুনেছি। দেখেছি, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তাঁরা নানা রকম বাধার মুখে পড়েন, অথচ তাঁদের অধিকাংশই জানেন না, কোথায় তাঁদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা আছে বা কীভাবে সেগুলোতে প্রবেশ করা যায়। বিশেষ করে চা-বাগানে গিয়ে দেখেছি, সরকার যে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, তা অনেক নারী জানেনই না।
লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী নারীরাও এখনো সেই প্রবেশগম্যতার সুযোগ কার্যকরভাবে পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন নীতিমালা থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ আইন রয়েছে, যেখানে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত হলে আইনগত সুরক্ষা পাওয়া যায়। তবে বাস্তবে অনেকে সেবা নিতে গিয়েও বৈষম্যের শিকার হন। নীতি ও আইন বাস্তবায়নে কোথায় ঘাটতি আছে, কোথায় সংশোধন বা পরিমার্জন প্রয়োজন—এ নিয়ে গবেষণা করে আমরা ফলাফল তুলে ধরেছি।
নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যবিরোধী আইন চেয়েছে। যদি এই আইন পাস হতো, তাহলে কাঠামোগত বৈষম্য মোকাবিলায় আমরা বড় অগ্রগতি করতে পারতাম। কিন্তু সেটিও এখনো হয়নি। এ আইনকে বাস্তবায়নের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে অ্যাডভোকেসির কাজ করে আসছি। এ বছর একাধিক সংস্কার কমিশন হয়েছে—বিচার বিভাগে প্রবেশগম্যতা, শ্রম সংস্কার, নারী অধিকার এবং গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে আমরা আমাদের সুপারিশ তুলে ধরেছি, যেখানে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কাঠামোগত প্রান্তিক অবস্থানে থাকা জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীদের উন্নয়নে প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি। এখন নির্বাচন সামনে, তাই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে এসব বিষয় গুরুত্ব দেবে—এটাই আমাদের আশা।
সাইমী ওয়াদুদ
শিক্ষক, আইন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নারী পরিচিতি নিজেই একটি প্রান্তিক পরিচিতি, তবে সব নারীর প্রান্তিকতা সমান নয়। লিঙ্গ, ধর্ম, গোষ্ঠী ও শারীরিক সুস্থতা বা প্রতিবন্ধিতার ভিন্নতা মিলেই এক একটি ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তিবিশেষের প্রান্তিকতার স্বরূপ নির্ধারিত হয়। সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের নিশ্চয়তা থাকলেও বাস্তবে প্রান্তিক নারীরা শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মসংস্থান ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় বৈষম্যের শিকার হন। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীর ক্ষেত্রে আইন বাস্তবায়নে ফাঁক দেখা যায়। যেমন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩–তে সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমান অভিগম্যতার বিধান থাকলেও আদালতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যুক্তিসংগত ব্যাখ্যামূলক বা শ্রবণ সহায়তার কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না। প্রতিবন্ধী নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে বিচারিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কাজেই কাঠামোগতভাবেই প্রবেশগম্য নয়।
দলিত ও আদিবাসী নারীরা পারিবারিক ও ধর্মভিত্তিক আইনের প্রয়োগে আরও প্রান্তিক হয়ে পড়েন। যেমন হিন্দু বিবাহ নিবন্ধনের বাধ্যতামূলক বিধান না থাকায় বৈবাহিক অধিকার প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। সরকারি চাকরিতে নারী কোটার বিলুপ্তি ও সামাজিক সুরক্ষাসেবার বাস্তবায়নে প্রকৃত দাবিদার চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া ত্রুটিযুক্ত হওয়ায় প্রান্তিক নারী প্রান্তিকই থেকে যান বা প্রান্তিকতর হয়ে ওঠেন।
প্রান্তিক নারীদের কাঠামোগত অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের প্রথমে বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের আন্তসংযোগে সৃষ্ট বৈষম্য স্বীকার করা জরুরি। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে ইতিবাচক বৈষম্য ও কোটাপ্রথা সংস্কার করা প্রয়োজন, যাতে প্রান্তিক নারীরা প্রকৃত অর্থে উপকৃত হন। সামাজিক সুরক্ষাসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রান্তিকতার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার নীতি অনুসরণ করা আবশ্যক। হিন্দু ও দলিত নারীদের অধিকার রক্ষায় আইন সংস্কার এবং বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা জরুরি। প্রতিবন্ধী নারীর ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত সহায়তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে, যেন তাদের বিচার, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে প্রবেশে বাধা না আসে।
বনানী বিশ্বাস
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ দলিত অ্যান্ড ইন্ডিজেনাস উইমেন ফোরাম
দলিত নারীদের কাঠামোগত উন্নয়নের জন্য যে পদক্ষেপ প্রয়োজন, তা হলো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও সংরক্ষিত সুবিধা। স্বাধীনতার পর সংবিধান অনুযায়ী জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সমানতা নিশ্চিত করা হয়েছে, তবু প্রায় এক কোটি মানুষ আজও পিছিয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা জরুরি।
দলিত বলতে সমাজের জন্ম ও পেশাগত কারণে নিপীড়িত নারীকে বোঝানো হয়। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নিম্নবর্ণের মানুষ, যেমন হাজাম, নিকারি, শিকারি, গামছা বোনে—এসব প্রান্তিক নারীরা কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার। সরকারি সুবিধা যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি—এসব পেতে গেলে তাঁরা হেল্পডেস্ক, নোটিশ বোর্ড ও তথ্য প্রদানের অভাবে পিছিয়ে থাকেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় সভা, সক্রিয় স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং গ্রামভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা জরুরি।
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ঋণ ও উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যাতে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারেন। স্বাস্থ্য এবং প্রজননসেবায় তাঁরা সর্বাধিক পিছিয়ে রয়েছেন। কমিউনিটি ক্লিনিক তাঁদের বসবাসের এলাকায় কার্যকরভাবে থাকা উচিত। আইনি সহায়তা থাকলেও তাঁরা সচেতন নন; স্থানীয় এনজিও ও সরকারকে এটি নিশ্চিত করতে হবে।
গণমাধ্যমে তাঁদের সক্ষমতা ও সামাজিক ভূমিকা ইতিবাচকভাবে তুলে ধরলে হীনম্মন্যতা কমবে এবং কাঠামোগত পরিবর্তন সম্ভব হবে। বিচ্ছেদ, বিবাহ রেজিস্ট্রি এবং সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।
তামান্না সিং বড়াইক
প্রকল্প কর্মকর্তা, দলিত নারী ফোরাম
চা–বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে নারীরা প্রধানত চা–পাতা তোলার কাজে যুক্ত, সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন। বর্তমান মজুরি মাত্র ১৮৬ টাকা, যা বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে পরিবারগুলোর জীবনধারণ কঠিন আর নারীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত। তাঁদের উন্নয়নের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, যেমন দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ, ঋণ ও অনুদান সুবিধা, যাতে তাঁরা বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে পান। বাসায় থাকা চা–শ্রমিক নারীদেরও স্থানীয় প্রশিক্ষণ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি; কারণ, অনেক চা–বাগান দূরে এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে সচেতনতা নেই।
চা–শ্রমিকদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যসেবা অগ্রাধিকার দেওয়া এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। প্রান্তিক নারীরা যেন সংরক্ষিত আসনে বা কমিটিতে বসে তাঁদের অধিকার বিষয়ে কথা বলতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সময়ে এই জনগোষ্ঠীর সঠিক তথ্য ও গবেষণা অনুপস্থিত। দলের, জাতি বা পরিচয় অনুযায়ী বৈষম্য ও প্রান্তিকতার বাস্তব অবস্থা বোঝার জন্য প্রাথমিক তথ্যভিত্তিক গবেষণা অপরিহার্য।
চা–বাগানের প্রান্তিক নারীদের জন্য কাঠামোগত করণীয় হলো, তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা, শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যসেবা অগ্রাধিকার দেওয়া, আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং তাঁদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। পাশাপাশি সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রবেশগম্যতা ও বিকল্প আয়ের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নীতি প্রণয়নের জন্য তথ্যভিত্তিক গবেষণা অপরিহার্য। এসব পদক্ষেপ ছাড়া চা–বাগানের প্রান্তিক নারীদের অধিকার এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
মিনা রানী বিশ্বাস
গবেষক, রিব; দলিত নারী প্রতিনিধি, যশোর
সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গভেদে বৈষম্য নিষিদ্ধ, তবু দলিত নারীরা সামাজিক ও প্রশাসনিক বৈষম্যের শিকার। শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক প্রভাব তাদের মৌলিক অধিকার ও যোগ্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করছে। সরকারি সেবা পেতে গেলে ‘অনগ্রসর শ্রেণি’ নামে উল্লেখ থাকলেও প্রকৃত দলিত নারীরা সঠিক সুবিধা পাচ্ছেন না; কারণ, তথ্য প্রদানের অনিয়ম, হেল্পডেস্কের অভাব এবং নোটিশ বোর্ড না থাকায় তাঁরা সুযোগ সম্পর্কে জানতেই পারছেন না।
প্রান্তিক নারীদের জন্য উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে সমন্বয় সভা জরুরি, যাতে সেবা প্রাপ্তির অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়। বয়স্ক ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রায়ই অসম্পূর্ণ বা অপ্রতুল। টেইলারিং, কম্পিউটার ও অন্য আঞ্চলিক প্রশিক্ষণগুলোতে প্রকৃত ভুক্তভোগী বাদ পড়ছেন। তাই গ্রামভিত্তিক কার্যক্রম, নিয়মিত মনিটরিং এবং বিকল্প আয়ের সুযোগ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
স্বাস্থ্য ও প্রজননসেবায় দলিত নারীরা সবচেয়ে পিছিয়ে এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের অভাব তাঁদের অবস্থাকে আরও সংকীর্ণ করছে। আইনি সহায়তা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের অনেকেই জানেন না বা সুবিধা নিতে পারছেন না। বিবাহ, বিচ্ছেদ ও সম্পত্তিতে অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়ও প্রান্তিক নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত। ইউনিয়ন পরিষদ ও সিটি করপোরেশন স্তরে সংরক্ষিত আসন এবং নির্বাচনী ইশতেহারে কোটা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমে দলিত নারীদের সক্ষমতা ও সামাজিক ভূমিকা ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা গেলে হীনম্মন্যতা কমে এবং কাঠামোগত পরিবর্তন সম্ভব।
সুচিত্রা সরকার
অধিকারকর্মী
আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি, হিন্দু মেয়েদের পারিবারিক সম্পত্তিতে প্রাপ্ত অধিকার কার্যত শূন্য। সম্পত্তির ক্ষেত্রে আইন ও সামাজিক কনসেপ্ট মেয়েদের জন্য প্রায়ই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহিত নারীরা নিজের পরিবারের সম্পত্তিতে কোনো দাবি রাখতে পারেন না। পারিবারিক প্রথা ও স্থানীয় হিন্দু নেতাদের চাপের কারণে মেয়েরা মূলত বঞ্চিত থাকেন।
প্রত্যেক হিন্দু মেয়ের জন্য কাঠামোগতভাবে প্রয়োজন আইন অনুযায়ী সম্পত্তিতে সমান অধিকার নিশ্চিত করা। বর্তমানে ১৯৩৬ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের ওপর নির্ভর করা হয়, যেখানে উইল না থাকলে বিধবা, সন্তান ও মেয়েরা সম্পত্তি ভোগ করতে পারেন, কিন্তু বিক্রি বা সম্পূর্ণ স্বত্ব গ্রহণে সীমাবদ্ধ। ভারতে ১৯৫৬ সালের আইন অনুযায়ী সব উত্তরাধিকারী সমানভাবে অধিকার পায়, যা আমাদের দেশে এখনো নেই। ১৯২৮ সালের অক্ষমতা অপসারণ আইনও বাস্তবায়িত হয়নি, ফলে প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ নারীরা বঞ্চিত থাকেন।
এই কাঠামোগত বৈষম্য দূর করতে সরকারের ও আইনসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে মেয়েদের পারিবারিক সম্পত্তিতে স্বীকৃতি দিতে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আইনি সহায়তা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রান্তিক নারীরা নিজেদের অধিকার জানতে ও প্রয়োগ করতে সক্ষম হবেন। এ ছাড়া দলিত ও প্রান্তিক নারীদের জন্য সংরক্ষিত সুযোগ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রতিটি স্তরে, বিশেষ করে ইউনিয়ন ও সিটি করপোরেশনে কোটাব্যবস্থা থাকা উচিত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও ঋণের সুযোগ তাঁদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করবে। গণমাধ্যমে তাঁদের যোগ্যতা ও সামাজিক ভূমিকা ইতিবাচকভাবে তুলে ধরলে হীনম্মন্যতা কমবে এবং কাঠামোগত পরিবর্তন সম্ভব হবে।
প্রাপ্তি তাপসী
অধিকারকর্মী
গণ-অভুত্থান–পরবর্তী সরকারের কাজের ক্ষেত্রে প্রান্তিক নারীদের কাঠামোগত অধিকার নিশ্চিতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও নারীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোকে আরও আগে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। নারীর প্রতিনিধিত্ব এবং তাঁদের অধিকার নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সরকারি পদক্ষেপ নেই।
বর্তমানে কোটা বা ইতিবাচক বৈষম্য নারীদের জন্য কার্যকরভাবে নেই। সংবিধান ও কমিশনগুলোতে নারীর অন্তর্ভুক্তি কম এবং অনেক ক্ষেত্রেই নিযুক্ত নারী সদস্যদের কোনো বাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই।
আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ আইন সংশোধন হলেও বাস্তবে ভিকটিমদের সুরক্ষা অসম্পূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ ও অফিসে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধী সেল এবং জেলাগুলোতে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার কার্যকরভাবে নেই, যা নারীদের সুরক্ষা ও সহায়তায় প্রভাব ফেলে।
নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে মিরর রিপ্রেজেনটেশন প্রয়োজন। ৬ কোটি ভোটার নারী এবং জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী থাকা সত্ত্বেও সরকারি ও সামাজিক পদক্ষেপে ১০০ জন পুরুষের মধ্যে দুজন নারী রাখার মতো প্রতীকী ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতা নিশ্চিত করতে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি।
জয়া সিকদার
নির্বাহী পরিচালক, সম্পূর্ণা
প্রান্তিক নারীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য ও অধিকার সুরক্ষার অবস্থা উদ্বেগজনক। ট্রান্সজেন্ডার নারীর পরিচয় এবং তাঁদের সামাজিক অবস্থান কাঠামোগতভাবে তাঁদের পিছিয়ে রাখে। জন্মগত ও লিঙ্গপরিচয়ের কারণে তাঁরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নজরে ভিন্নভাবে দেখা হয়। রাষ্ট্রের নীতিমালা এখনো তাঁদের স্বাভাবিক অধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম নয়। ফলে তাঁরা হিজড়া পল্লি বা আলাদা কমিউনিটিতে সীমিত জীবন যাপন করতে বাধ্য হন।
প্রান্তিক নারীদের জন্য একটি সুরক্ষিত আইন অপরিহার্য। ট্রান্সজেন্ডার বিল বাস্তবায়িত হলে তাঁরা সরকারি ও বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে স্বচ্ছ পরিচয় ব্যবহার করে প্রবেশ করতে পারবেন। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে তাঁদের ‘আসল–নকল’ প্রমাণ করতে হয়, যা তাঁদের জন্য বড় বাধা। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবায়নে বড় সমস্যা দেখা দেয়। ভাতা, উপবৃত্তি এবং প্রশিক্ষণ প্রায়ই তাঁদের পরিচয় সঠিকভাবে যাচাই না হওয়ায় পৌঁছে না। সরকারের পক্ষ থেকে হিজড়া জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে, কিন্তু কাঠামোগত বাধার কারণে কার্যকর হয়নি।
প্রান্তিক নারীদের ক্ষমতায়নে নীতিগত, আইনি ও সামাজিক সংস্কার জরুরি। আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি, কর্মক্ষেত্রে স্বীকৃতি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। লিঙ্গবৈচিত্র্যের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের মনোভাব পরিবর্তন না হলে তাঁরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
শারমিন আক্তার
কর্মসূচি সহ–সমন্বয়কারী, ডব্লিউডিডিএফ
সমাজে প্রতিটি মানুষ সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রান্তিক নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সরকারি সেবা গ্রহণে নানা বাধার সম্মুখীন। এই বাধা শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেও রয়েছে। আমাদের দায়িত্ব হলো এই বাধাগুলো দূর করে তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করা।
প্রবেশগম্যতা একটি মানবাধিকার। জাতিসংঘের প্রতিশ্রুতির আলোকে প্রতিটি দেশ নিশ্চিত করবে যাতে প্রান্তিক নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সরকারি সেবা সমানভাবে পায়। এটি দেশের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়নের শর্তও। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি অফিস ও অনলাইন সেবা প্রায়শই প্রতিবন্ধী বান্ধব নয়। লিফট, র্যাম্প, হ্যান্ডরেল, এক্সেসেবল টয়লেট অনুপস্থিত, ব্রেইল বা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার নেই, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো স্ক্রিন রিডার বান্ধব নয়।
সমাধানের জন্য করণীয় স্পষ্ট। সরকারি ভবনের নকশায় ইউনিভার্সাল ডিজাইন বাধ্যতামূলক করতে হবে। সেবা কেন্দ্রগুলোয় দৃশ্যমান ও স্পর্শনির্ভর নির্দেশনা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ক্যাপশন, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট ও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সাপোর্ট ডেক্স স্থাপন অপরিহার্য। জেলা ও উপজেলা কমিটিগুলোর নিয়মিত সভা নিশ্চিত করা দরকার।
পূজা রানী দাস
দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, মিরনঝিল্লা
প্রান্তিক নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক ও কাঠামোগত দায়িত্ব। ঢাকা শহরের মিরনঝিল্লা কলোনিতে বহু প্রান্তিক নারী ঘরবিহীন ও অস্থির জীবন যাপন করছেন। উচ্ছেদ, সীমিত বাসস্থান ও অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন তাঁদের মৌলিক অধিকার ব্যাহত করছে। সরকারি সেবা যেমন ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি বা ঋণও তাঁরা প্রায়ই পান না; কারণ, স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটি পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম অনুসরণ করে, যেখানে নারীদের ভোটাধিকার বা অংশগ্রহণ সীমিত।
সরকারি প্রক্রিয়ায় প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রান্তিক নারীদের প্রবেশগম্যতা সীমিত। মাঠে কাজ করা নারীদের সেবা পৌঁছে দিতে গেলে কমিটি বা সামাজিক নেতারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেন না। ঋণ ও উদ্যোক্তা সহায়তায় অপ্রতুল অর্থ এবং কঠোর কিস্তি শর্তও তাঁদের সক্ষমতা সীমিত করে।
কাঠামোগতভাবে সমস্যার সমাধান জরুরি। প্রান্তিক নারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট আসন বরাদ্দ, ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, সরকারি ভবন ও সেবাকেন্দ্রে প্রবেশগম্যতা, যথাযথ ভাতা ও ঋণের ব্যবস্থা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণসহ ন্যূনতম সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া এগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়েই প্রান্তিক নারীর ক্ষমতায়ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
ভাতাকেন্দ্রিক নীতির বাইরে গিয়ে কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
সামাজিক কল্যাণ বাজেটে অবকাঠামো উন্নয়নের তুলনায় দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার প্রদান।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা অগ্রাধিকার প্রদান।
আইন ও নীতি বাস্তবায়ন শক্তিশালী করা।
বৈষম্যবিরোধী আইন পাসে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
উপজেলা পর্যায়ে স্থায়ী কমিটির সভা নিয়মিত মনিটরিং নিশ্চিত করা ও সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি করা।
নারীর নিরাপত্তা ও আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা।
মোহাম্মদ আবু ইউছুফ, সচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ইলিরা দেওয়ান, মানবাধিকার কর্মী; সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। মো. সাইদুর রহমান খান, মহাপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর। স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। মাহবুবা আক্তার, পরিচালক, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন, ব্লাস্ট। সাইমী ওয়াদুদ, শিক্ষক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তামান্না সিং বড়াইক, প্রকল্প কর্মকর্তা, দলিত নারী ফোরাম। বনানী বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ দলিত অ্যান্ড ইন্ডিজেনাস উইমেন ফোরাম। মিনা রানী বিশ্বাস, গবেষক, রিব; দলিত নারী প্রতিনিধি, যশোর। সুচিত্রা সরকার, অধিকারকর্মী। প্রাপ্তি তাপসী, অধিকারকর্মী। জয়া সিকদার, নির্বাহী পরিচালক, সম্পূর্ণা। শারমিন আক্তার, কর্মসূচি সহ–সমন্বয়কারী, ডব্লিউডিডিএফ। পূজা রানী দাস, দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, মিরনঝিল্লা। সঞ্চালক: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো।