
আমি জাহানারা বেগম। বয়স ৪০ বছর। বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চালবন্দ গ্রামে। বড় ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করব। কিন্তু হয়নি। মাত্র ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়তে পেরেছি। মা-বাবা, ভাই-বোন মিলে সংসার ছিল ১০ জনের। দারুণ অভাব। নুন আনতে পানতা ফুরায়। একবেলা দুমুঠো খেলে দুবেলা উপোস থাকতে হয়। ছোটকালের সেই কষ্ট এখনো মনে গেঁথে আছে। বাপের বাড়ি, স্বামীর বাড়ি-দুই জায়গাতেই অভাব দেখেছি। অনাদর-অবহেলা ছিল নিত্যদিনের সাথি। তবে মনে জেদ ছিল। নিজে যখন পারিনি, যত কষ্টই হোক, সন্তানদের লেখাপড়া করাব। জেদ থেকেই একসময় দিনরাত পরিশ্রম করা শুরু করি। এখন অভাব ঘুচেছে। সুখ এসেছে সংসারে। বলা হচ্ছে, আমি একজন সফল উদ্যোক্তা। জাতীয়ভাবে আমাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে ‘জয়িতা’র সম্মান।
তবু মাঝেমধ্যে মনে দুঃখ ভর করে। নারীর প্রতি অবহেলা, বঞ্চনায় মন কাঁদে। একটা গান লিখেছিলাম: ‘আমি গ্রাম বালিকা বধূরে, আমার মনে বড় ব্যথা/ আঁচলে বান্দিয়া রাখি, দুঃখের অনেক কথা/ এই বয়সে পিতা-মাতা, কেন দিল শাদি/ ফুল দেখিয়া হাসি আমি, চাঁদ দেখিয়া কাঁদি...।’
আমার বয়স তখন ১৪। বিয়ে, সংসার—এসবের কিছুই বুঝি না। তবু বিয়ে হয়, স্বামীর ঘরে আসি। কোনো কাজ করতে পারি না। স্বামীর জমি-জিরাত তেমন নেই। কৃষিকাজ করে টেনেটুনে চার মাস চলে। বাকি সময় বড় কষ্টে যায়। নিজেকে কেমন ছোট মনে হয়। বাপের বাড়ির বড় সংসারের কথা মনে আছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, দুই সন্তানের বেশি নেব না। তা-ই করি। আমাদের দুই ছেলে হয়। ছেলেরা বড় হতে থাকে। আমার চিন্তা বাড়ে। মনে মনে ভাবি, কী করব। অন্তত সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য, সংসারের গরিবি দূর করার জন্য কিছু একটা করতেই হবে।
২০০৬ সাল। বড় ছেলে পাঠশালা পাস করেছে। হাইস্কুলে ভর্তি হবে। পড়াশোনার খরচ লাগবে। টাকা পাব কোথায়? এর মধ্যে একদিন শুনি, গ্রামের নারীরা মিলে সমিতি করেছে। আমি সদস্য হই। কিছুদিন পর উপজেলায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ডাক আসে। আমি যেতে চাই। কিন্তু স্বামীর এসব সমিতি, ট্রেনিং পছন্দ ছিল না। তাঁকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করাই। তিন দিনের প্রশিক্ষণ। আমি নার্সারি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিই।
এর আগে উপজেলায় তো দূরের কথা, গ্রামের বাইরে কখনো পা পড়েনি আমার। টাকাপয়সা নেই। প্রতিদিন ১২ কিলোমিটার পথ হেঁটেই আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। বাড়িতে কিছু মরিচ ও পেঁপের বীজ ছিল। প্রশিক্ষণ শেষে সেগুলো দিয়ে চারা জন্মানো শুরু করি। তারপর এলজিইডির সিবিআরএমপি প্রকল্প থেকে চার হাজার টাকা ঋণ নিই। দিনরাত কাজ করি।
প্রথম দিনের কথা মনে আছে। একটা ঝুড়িতে ৫০টি চারা দিয়ে স্বামী হাসান আলীকে বললাম বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে। তিনি প্রথমে রাজি হতে চাইলেন না, কেমন জানি লজ্জা লাগছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি চারাগুলো নিয়ে বাজারে গেলেন এবং ফিরে এসে আমাকে বললেন, সব চারা মানুষ হাতে হাতেই কিনে নিয়ে নিয়েছে। ছয় মাস পর ঋণ শোধ করি। আয় থাকে আরও ১০ হাজার টাকা। এরপর আর থামতে হয়নি। কোনো ঋণও নিতে হয়নি। প্রতিবছর আয় থেকে নার্সারি বড় হয়। এখন মানুষ আমার বাড়িতে এসে চারা কিনে নিয়ে যায়। বিভিন্ন এনজিও আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখে। বছরে কেউ এক লাখ, কেউ দেড় লাখ টাকার চারা নেয়। এখন এক একর জমিতে নার্সারি আছে। চারা আছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার। স্বামী-স্ত্রী মিলেই নার্সারির পরিচর্যা করি। বছরে আয় হয় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা।
আমাদের বাড়িতে জমির পরিমাণ প্রায় তিন একর। বসতঘরের সামনে একচিলতে উঠোন। পুরো বাড়িই গাছগাছালিতে ভরা। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কমলা, পেঁপে, পেয়ারা, নারকেল, সুপারি, আতাফল, কামরাঙা, জলপাই, জাম্বুরাসহ বেশির ভাগই ফলের গাছ। ২০০৯ সাল থেকে মাছ চাষ করছি। দুটি পুকুর আছে। মাছ চাষে বছরে আরও ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। রয়েছে মোরগের খামার। কয়েকটি গরুও আছে। এখন উন্নত জাতের গরুর খামার করার কথা চিন্তাভাবনা করছি। ছোট্ট শণের ঘর ছিল। এখন টিনের ঘর বানিয়েছি। ঘরে বিদ্যুৎ এনেছি। অন্যের কাছে বেশ কিছু জমি বন্ধক ছিল, সেগুলো ছাড়িয়েছি। বড় ছেলে বেলাল হোসেন বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দেবে আর ছোট ছেলে হেলাল হোসেন পড়ে একাদশ শ্রেণিতে। ছেলেদের কম্পিউটার কিনে দিয়েছি।
পারিবারিক বাধা, সংকোচ, কুসংস্কার কিছুই আমাকে আটকাতে পারেনি। সাহস নিয়ে কাজ করলে, পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। আমি সাফল্য পেয়েছি। সম্মান পেয়েছি। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এলজিইডির পক্ষ থেকে আমাকে অর্থনৈতিকভাবে সফল নারীর পুরস্কার দেওয়া হয়। ঢাকায় এলজিআরডি মন্ত্রী (বর্তমানে জনপ্রশাসনমন্ত্রী) সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আমার হাতে সেই পুরস্কার তুলে দেন। সেই বছর ওই মন্ত্রণালয়ের সমাজভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা (সিবিআরএমপি) প্রকল্প থেকে আমার লেখা বই সিঁড়ি প্রকাশ করা হয়। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ অতিথিরা সেখানে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। তারপর ২০১৪ সালে আরেকটি উপন্যাস ধূপ পোড়া গন্ধ প্রকাশ করেছে তারা। সে বছর ঢাকায় আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী।
ধূপ নিজে পুড়ে গন্ধ বিলায়। চারপাশ পবিত্র করে। নারীরাও তেমনি। তারা পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য কত কাজ করে। কিন্তু শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা পায় না। এখানেই আমার যত দুঃখ। আমি গানেও বলেছি: ‘আমি নারী হইয়া ঠেকলাম ভবে/ জীবন মূল্যহীন, আমি পরের অধীন/... নাইরে শক্তি নাইরে মুক্তি নাইরে অধিকার/ বুকের ভিতর চাপাকান্না করে হাহাকার...।’
নারীর বসে থাকলে চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে। আমার দেখাদেখি এলাকার অনেকেই নার্সারি করেছে। হাঁস-মোরগ, গরু-ছাগল পালন করছে। গ্রামের ৩০ জন নারী মিলে ‘এসো কাজ করি’ নামের একটি সংগঠন করেছি। বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করি আমরা। ছোট পরিবারের পরামর্শ দিই। মেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহ জোগাই।
আমাদের গ্রামের গরিব পরিবারের এক মেয়ে টাকার অভাবে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারছিল না। আমরা সেই টাকা জোগাড় করে দিয়েছি। সে পাস করার পর তার কলেজে ভর্তি হওয়ার ফি জোগাড় করে দিয়েছি। গ্রামের আরেক মেয়ে মুক্তামালা। তারা চার বোন। খুবই গরিব পরিবার। বাবা ভ্যানচালক। মুক্তামালাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া হয়। সে সেলাইয়ের কাজ করে পরিবারের হাল ধরে। এখন ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে সে একই কাজ করছে। তার আয়েই স্বামীর সংসারের উন্নতি হয়েছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে খুব সম্মান করে। তার অন্য তিন বোন স্কুলে পড়ছে। তারাও সেলাইয়ের কাজ করে নিজেদের লেখাপড়ার খরচ জোগাচ্ছে।
নিজের জীবন থেকে দেখেছি, অন্যের ওপর নির্ভরশীল হলে সংসারে দাম পাওয়া যায় না। নারীদের লেখাপড়া করতে হবে। একজন শিক্ষিত নারী একটি পরিবারকে বদলে দিতে পারে। বিয়ে কী, সংসার কী, বোঝার আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এ কারণে মেয়েরা ঘরে-বাইরে নানা সমস্যায় পড়ে। স্বামীর চাপে ছেলের আশায় পাঁচটা-ছয়টা মেয়ের জন্ম দেয়। পরে অভাবের কারণে এই মেয়েদের আর শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ করতে পারে না। সন্তান ছেলে না মেয়ে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো মানুষের মতো মানুষ করা।
নারীদের দুঃখ-কষ্ট দেখলে আমার মন কাঁদে। সবকিছু মুখে বলা যায় না। তাই অবসরে গান লিখি। ২০০-এর ওপরে গান লিখেছি। আমার একটি গানে আছে: ‘আমরা বঞ্চিত লাঞ্ছিত একদল নারী/ রক্তঝরা আঘাত সহে, শাড়ির আঁচলে গা ডাকিয়ে/ মুক্তির সংগ্রাম করি...।’
চোখের জল আড়াল করেই নারীদের লড়াই করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমি চাই, প্রত্যেক নারী যেন স্বাবলম্বী হয়, পরিবারে ও সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচতে শেখে।
(অনুলিখন)
জাহানারা বেগম, সফল নার্সারী উদ্যোক্তা, সুনামগঞ্জ