স্যারের দুই চোখে অশ্রুর ধারা

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক লিটন চন্দ্র পাল। ছবি: লেখক
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক লিটন চন্দ্র পাল। ছবি: লেখক

প্রত্যেকের জীবনেই এমন কিছু মানুষ থাকে, যাঁদের উপস্থিতি আমাদের জীবনে স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। আমার ক্ষেত্রে এ রকম মানুষটি হচ্ছেন লিটন চন্দ্র পাল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে তাঁকে অন্যদের তুলনায় বেশ আলাদা মনে হয়েছিল। খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। এক কথায় অমায়িক হাসিখুশি মানুষ। তিনি যখন লেকচার দেন, তখন পুরো ক্লাসরুমে পিনপতন নীরবতা থাকে। কেউ পড়া বুঝতে না পারলে আবার প্রথম থেকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে দেন তিনি। লিটন চন্দ্র পাল কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে গেলেন সকলের প্রিয় লিটন স্যার।

স্যারের সঙ্গে মনে রাখার মতো আমার অসংখ্য স্মৃতি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সাত দিনের মধ্যেই আমরা বিভাগের বড় ভাইয়া-আপুদের সঙ্গে সুন্দরবন ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে যাই। বাসে করে সুন্দরবন যাওয়ার পথে স্যারের পাশে আমার ও আমার একজন বন্ধুর বসার সৌভাগ্য হয়েছিল। পথে যেতে যেতে উনি আমাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলা শুরু করলেন যেন তিনি আমাদের পুরোনো বন্ধু। সেদিনের আগে স্যারকে খুব ভালোমতো চিনতাম না, কিন্তু যাত্রা শেষে আমরা দুজনেই ওনার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

লিটন স্যার অন্য শিক্ষকদের মতো নন। তিনি আলাদা। তিনি অনন্য, দায়িত্ববান ও নিবেদিত প্রাণ।

সেদিন আমরা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবার, কর্মজীবন ইত্যাদি নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি খুব সহজভাবে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। কথার মাঝেই আমাদের জানিয়েছিলেন, উনি একজন বাবা। এতটা খোলামেলাভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্য শিক্ষক হয়তো আলাপ করতেন না। বিষয়টি আমার খুব ভালো লেগেছিল।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন

সুন্দরবন থেকে অল্প দূরত্বেই রিসোর্ট ভাড়া করা হয়েছিল। আয়োজন করা হয়েছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শেষদিকে বড় ভাইয়া আপুদের মধ্যে দু-একজন কান্না শুরু করে দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে কান্না আরও বেশ কয়েকজন সিনিয়রের মধ্যে ছড়িয়ে গেল। স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বাবার মতো অনেককেই বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। যখন কান্না থেমে পরিবেশ মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় এসেছে, তখন খেয়াল করে দেখলাম স্যারের দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। পরে জেনেছি, সেটিই ছিল পঞ্চম ব্যাচের ভাইয়া-আপুদের ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সঙ্গে শেষ বনভোজন।

লিটন স্যার ক্লাসে কখনো দেরি করে আসেন না। ক্লাসরুমে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে অনেক মজার কথা বলেন, সফল ব্যক্তিদের কথা শোনান। একজন ভালো মানুষ হওয়ার কথা বলেন তিনি। ওনার দায়িত্ববোধ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমাদের প্রতি স্নেহ—প্রতিটি জিনিসই আমাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে।

আমি জানি না বিভাগের এত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উনি আমাকে আলাদাভাবে খেয়াল করেছেন কি না! একসঙ্গে পথচলার সময়ের হিসাবে মাত্র এক বছর হয়তো বেশি নয়। তবুও এই অল্প সময়ে তিনি আমাদের যে পরিমাণে ভালোবাসা দিয়েছেন, সেটি কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

লিটন চন্দ্র পাল হয়তো সব ছাত্রছাত্রীর প্রিয় শিক্ষক নন। কিন্তু আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, আমার উনিশ বছরের জীবনে ওনার চেয়ে ভালো শিক্ষক কখনো দেখিনি।

শিক্ষক দিবসের মতো পবিত্র দিনে লিটন স্যারকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আপনার কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ না রাখেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়