আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

সারা দেশেই চলে বুদ্ধিজীবী হত্যা

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় বেছে বেছে জাতির মেধাবী সন্তানদের হত্যা করে। এ তালিকায় ছিলেন শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সংস্কৃতিসেবী, সাংবাদিক, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।

এত বছর পরে এসে সরকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল রোববার প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২২২ জনের একটি তালিকা করেছে। অবশ্য এর আগে স্বাধীনতার পরপর তথ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ নামে বাংলাদেশের পরিচিতিমূলক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ১ হাজার ৭০ জনের নাম ছাপা হয়।

বাংলা একাডেমির বুদ্ধিজীবী কোষ; বুদ্ধিজীবী স্মারক ও ‘স্মৃতি ৭১’ গ্রন্থ এবং বাংলাদেশ ডাক বিভাগের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ উপলক্ষে স্মরণিকায়ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে যাঁদের হত্যা করা হয়েছিল, সেই বুদ্ধিজীবীদের কেউ কি মনে রেখেছে তাঁদের পরিবার কেমন আছে—কয়েকজন সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে প্রথম আলো।

নিজ বাড়িতেই হত্যা
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে (২ এপ্রিল) রাজশাহীর আইনজীবী বীরেন্দ্রনাথ সরকারকে নিজ বাড়িতেই গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। তিনি কৃতী ফুটবলার ছিলেন। সাংবাদিকতাও করেছেন। তাঁর স্মরণে নগরের অলকার মোড় থেকে বেলদারপাড়া মহল্লা পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল ‘শহীদ বীরেন্দ্রনাথ সড়ক’। গতকাল রোববার সেখানে গিয়ে দেখা গেল স্মৃতিফলকটি আর নেই।

বীরেন্দ্রনাথের ভাগনি চন্দনা চৌধুরীর ছেলে প্রদীপ চৌধুরী বলেন, এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর বাড়িটিও এখন বেদখল। তিনি নিজের ৯ কাঠা জমিসহ বাড়িটি ভাইয়ের মেয়ে রুবি শিকদার ও বোনের মেয়ে চন্দনা চৌধুরীকে উইল করে দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই দলিল এখনো আছে। বাড়ি উদ্ধারের জন্য তাঁর ছোট বোন শ্রাবণী বাদী হয়ে উচ্ছেদ মামলা করেছেন।

আজও অপেক্ষা করি, তিনি ফিরে আসবেন।
অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম, বরিশালের শহীদ শিক্ষক ও সাংবাদিক রফিকুল ইসলামের স্ত্রী

ওই বাড়িতে গিয়ে গতকাল সকালে দেখা যায়, তিনটি পরিবার সেখানে বসবাস করে। এর মধ্যে বাদল সরকার নামে একজন বীরেন্দ্রনাথের ভাগনে বলে দাবি করেন। বাকি দুজন আত্মীয়তার দাবি করেননি।

খোঁজ রাখে না, স্বীকৃতি নেই

পাবনার দন্ত চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ অমলেন্দু দাক্ষীকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। নগরের টেলিফোন ভবনে আটকে রেখে নির্যাতন করে তিন দিন পর গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়।

ডা. দাক্ষী পরিবারসহ জেলা শহরের পাথরতলা মহল্লার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। পৈতৃক বাড়ি ছিল রাজশাহী শহরের মালোপাড়ায়। স্বাধীনতার পর তাঁর স্ত্রী শোভারানী দাক্ষী সন্তানদের নিয়ে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে চলে যান। অমলেন্দু দাক্ষীর তৎকালীন প্রতিবেশী ইয়াছিন আলী মৃধা বলেন, ‘যত দূর জেনেছি, ওই পরিবারের কেউ আর এখন এ দেশে নেই।’

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের খোঁজ নিতেন। রেশন কার্ডও করে দিয়েছিলেন। তবে ’৭৫–এর পর আর কেউ খোঁজ রাখেনি।
অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন নীলফামারীর সৈয়দপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শহীদ ডা. শামসুল হকের ছেলে

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও জয়পুরহাটের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. কাজী আবুল কাশেমের পরিবার এখনো সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। আবুল কাশেমের স্ত্রী ও দুই ছেলে মারা গেছেন।

আবুল কাশেমের নাতি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. জোবায়ের গালিব বলেন, সরকারি স্বীকৃতি না পেলেও তাঁর দাদার নামে জয়পুরহাট শহরে একটি মাঠের নামকরণ করা হয়েছিল। তবে সেখানে কোনো নামফলক নেই।

নীলফামারীর সৈয়দপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় (১২ এপ্রিল) হত্যা করা হয় ডা. শামসুল হককে। তিনি ছিলেন সৈয়দপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাঁর ছেলে অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের পরিবারের খোঁজ নিতেন। রেশন কার্ডও করে দিয়েছিলেন। তবে ’৭৫–এর পর আর কেউ খোঁজ রাখেনি।

অমল কৃষ্ণ সোম ছিলেন যশোরের তুখোড় নাট্যাভিনেতা। ২৭ মার্চ শহরের ষষ্টিতলাপাড়ার বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ও তাঁর ছোট ভাই অরুণ কৃষ্ণ সোমকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তাঁরা আর ফিরে আসেননি। স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও অমল সোমের পরিবার ‘শহীদ পরিবার’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, অমল সোমকে যখন পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়, তখন তাঁর ছয় সন্তানের মধ্যে বড় ছেলের বয়স ছিল ১১ বছর। সন্তানদের নিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে যান তাঁর স্ত্রী রেবা রানী সোম।

রেবা রানী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার হিসেবে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আমাকে দুই হাজার টাকার একটি চেক দিয়েছিলেন। এরপর আর কোনো সহায়তা সরকার করেনি। শহীদ পরিবারের স্বীকৃতিও আমরা পাইনি।’

এখনো অপেক্ষায়

কুমিল্লার চিকিৎসক আ খ ম গোলাম মোস্তফা ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। তাঁর একমাত্র মেয়ে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের ফার্মাকোলজির অধ্যাপক রোখসানা দিল আফরোজ জানান, শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে গোলাম মোস্তফার নাম চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ঢাকা, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মৃতিফলকে আছে।

ফেনীর প্রকৌশলী মো. শফিকুল আনোয়ার মজুমদারকে ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁর ছোট মেয়ে নাহিদ গুলশান বলেন, বাবাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তাঁর (নাহিদ) বয়স ছিল মাত্র ১২ দিন। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু তাঁর মাকে বাংলাদেশ বিমানে একটি চাকরি এবং মোহাম্মদপুরে একটি বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার হিসেবে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আমাকে দুই হাজার টাকার একটি চেক দিয়েছিলেন। এরপর আর কোনো সহায়তা সরকার করেনি। শহীদ পরিবারের স্বীকৃতিও আমরা পাইনি।
রেবা রানী সোম, যশোরের শহীদ অমল কৃষ্ণ সোমের স্ত্রী

বরিশালের সাংবাদিক রফিকুল ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি (২৯ জুলাই ১৯৭১) তাঁর কর্মস্থল চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। তিনি দর্শনা কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক ছাত্র রফিকুল ইসলাম ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

শহীদ রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ইডেন কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম সেই দুঃসহ দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি জানান, স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ছিলেন সন্তানসম্ভবা। রফিকুল ইসলামকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সালেহ তাঁর (রফিকুলের) ভাইকে বলেছিল, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হচ্ছে। ছেড়ে দেওয়া হবে।

হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘আজও অপেক্ষা করি, তিনি ফিরে আসবেন।’

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা)