তিন সংস্করণ মিলিয়ে ভারত-পাকিস্তান এখন পর্যন্ত মুখোমুখি হয়েছে ২১০ বার। তবে টুর্নামেন্টের ফাইনালে দেখা হয়েছে খুবই কম। গত ৪০ বছরে পাঁচ বা তার বেশি দলের টুর্নামেন্টে এমনটা ঘটেছে মাত্র পাঁচবার। প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার আগে ফিরে দেখা যাক সেই ফাইনালগুলোয়।
ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব ক্রিকেট, ১৯৮৫, মেলবোর্ন
১৯৮৩ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ভারত তখন ওয়ানডের সেরা দল। ৭ দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব ক্রিকেটের ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই দল। ম্যাচটা ছিল একতরফা। মেলবোর্নে কপিল দেব আর লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণনের বোলিংয়ের দাঁড়াতে পারেনি পাকিস্তান। দুজনই নেন তিনটি করে উইকেট। জাভেদ মিয়াঁদাদের ৪৮ আর ইমরান খানের ৩৫ রানই সর্বোচ্চ। পাকিস্তান ইনিংস থমকে যায় ৯ উইকেটে ১৭৬ রানে।
রান তাড়ায় ভারত ছিল দাপুটে। কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত ছয়টি চার আর দুটি ছক্কায় ৬৭ রান করেন। রবি শাস্ত্রী অপরাজিত থাকেন ৬৩ রান করে। তাঁদের ১০৩ রানের জুটিতে পাকিস্তান ম্যাচ হারে ৮ উইকেটে। শাস্ত্রী জেতেন ‘চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়নস’ খেতাব, সেই সঙ্গে একটি আইকনিক অডি গাড়ি।
অস্ট্রাল-এশিয়া কাপ, ১৯৮৬, শারজা
এই ফাইনালটি আগেরটির সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দফায়ও পাকিস্তানের বিপক্ষে শ্রীকান্ত খেলেন ৮০ বলে ৭৫ রানের ইনিংস, যা সময়ের তুলনায় ঝোড়ো ব্যাটিং। সুনীল গাভাস্কার (৯২) আর দিলীপ ভেংসরকারের (৫০) দুই ফিফটিও ভারতকে বড় সংগ্রহের দিকে এগিয়ে দেয়। তবে কিন্তু ওয়াসিম আকরাম ৪২ রানে ৩ উইকেট নিলে ভারতের মিডল অর্ডার দাঁড়াতে পারেনি। ভারত থামে ৭ উইকেটে ২৪৫-এ।
তাড়া করতে নেমে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা ছিলেন ওঠা–নামার মধ্যে। তবে নিয়মিত ব্যবধানে উইকেট পড়লেও একপাশ আগলে রাখেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এক দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করেন তিনি, পাকিস্তানকে নিয়ে যায় ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত।
এরপর যা ঘটেছে, তা ভারত-পাকিস্তান আখ্যানে বছরের পর বছর চর্চিত হয়েছে।
পাকিস্তানের তখন শেষ উইকেট, শেষ বলে দরকার ৪ রান। চেতন শর্মা ইয়র্কার দিতে চেয়েছিলেন, সেটা হয়ে ওঠে লো ফুলটস। মিয়াঁদাদ সেটিকে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা মারেন। ১১৬ রানে অপরাজিত মিয়াঁদাদের বাতাসে ঘুষি মারতে থাকার সেই দৃশ্য ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার রিপ্লে হওয়া মুহূর্তগুলোর একটি। শুধু জয় নয়, এই ম্যাচ ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের মানসিক ধারা বদলে দিয়েছিল। পরের এক দশক ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তান মানসিকভাবে এগিয়ে ছিল।
অস্ট্রাল-এশিয়া কাপ, ১৯৯৪, শারজা
১৯৯৪ সালের দিকে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ ছিল তারকায় ঠাসা। ওপেনার সাঈদ আনোয়ার দুর্দান্ত ছন্দে। অস্ট্রাল-এশিয়া কাপের ফাইনালে তিনি খেলেন ৪৭ রানের ইনিংস। আমির সোহেলের ব্যাট থেকে আসে ৬৯ রান। তাঁদের ৯৬ রানের উদ্বোধনী জুটি পাকিস্তানকে এতটাই শক্ত ভিত দেয় যে অফ স্পিনার রাজেশ চৌহানের তিন উইকেটও (একই ওভারে ইনজামাম-উল-হক আর সেলিম মালিককে আউট) রানের গতি কমাতে পারেনি। বাসিত আলির ৫৭ বলে ৫৮ রানের ইনিংসে পাকিস্তান পৌঁছায় ২৫০-এ।
তাড়া করতে নেমে ভারতের শুরুটা ছিল বাজে। ওয়াসিম আকরামের প্রথম ওভারেই আউট হন অজয় জাদেজা। এরপর শচীন টেন্ডুলকার ও নভজ্যোত সিধু ১১ ওভারে ৫৯ রান তুললেও আরেক ধাক্কায় ভারতের স্কোর হয়ে পড়ে ৮৩/৪-এ। পঞ্চম উইকেটে বিনোদ কাম্বলির সঙ্গী হন অতুল বেদাদে। মাত্র চতুর্থ আন্তর্জাতিক ম্যাচে বেদাদে প্রথমে নার্ভাস থাকলেও শেষ পর্যন্ত ৪৫ বলে ৪৪ রান করেন, যার মধ্যে ছিল চারটি ছক্কা। তবে তিনি আউট হতেই ৪৮ রানের মধ্যে শেষ পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত। ৬৯ রানের সঙ্গে ২ উইকেট আর ২ ক্যাচের জন্য ম্যাচসেরা হন সোহেল।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০০৭, জোহানেসবার্গ
ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম তখন গমগম করছে। ইতিহাসের প্রথম টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পেয়েছে স্বপ্নের ফাইনাল। ভারত প্রথমে ব্যাট করতে নামে। বর্তমান প্রধান কোচ গৌতম গম্ভীর ৫৪ বলে করেন ৭৫ রান। শেষ দিকে নেমে রোহিত শর্মা করেন ১৬ বলে অপরাজিত ৩০ রান। ২০ ওভারে ভারত করে ৫ উইকেটে ১৫৭। পাকিস্তানের উমর গুল ২৮ রানে নেন ৩ উইকেট।
ইমরান নাজির ১৩ বলে ৩৩ রান করে রবিন উথাপ্পার সরাসরি থ্রোয়ে রানআউট হলে পাকিস্তান বড় ধাক্কা খায়। এরপর রুদ্র প্রতাপ সিং ও ইরফান পাঠান ৩টি করে উইকেট নিলে পাকিস্তান আরও পিছিয়ে পড়ে। তবে মিসবাহ উল হক উইকেটে ছিলেন বলে পাকিস্তানের আশা মরে যায়নি।
মিসবাহ সমীকরণ নামিয়ে আনেন শেষ ওভারে ১৩ রানে। তখন ভারত অধিনায়ক এমএস ধোনি বল তুলে দেন অখ্যাত যোগিন্দর শর্মার হাতে। প্রথমেই ওয়াইড, এরপর ডট, দ্বিতীয় বল ছক্কা। চার বলে দরকার ৬ রান। জয় অনেকটাই পাকিস্তানের নাগালে।
এরপর তৃতীয় বলটিতে মিসবাহ (৪৩) স্কুপ খেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঠিকঠাক ব্যাটে না লাগায় বল যায় শর্ট ফাইন লেগে থাকা শ্রীশান্তের হাতে। ভারত পায় নাটকীয় ৫ রানের জয়। পরবর্তী সময়ে ভারতের এই জয়ই হয়ে ওঠে টি-টোয়েন্টির নতুন দিনের বড় মাইলফলক। তবে যোগিন্দর আর কখনো ভারতের হয়ে খেলেননি। অমরত্ব অবশ্য ঠিকই পেয়ে গেছেন।
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ২০১৭, লন্ডন
র্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে নিচের দল হিসেবে আট দেশের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে গিয়েছিল পাকিস্তান। এমনকি গ্রুপ পর্বে ভারতের কাছেই ম্যাচ হেরেছিল ১২৪ রানের (ডিএল) বড় ব্যবধানে। কিন্তু ১৮ জুনের ফাইনাল সরফরাজ আহমেদের দল পাকিস্তান দুর্দান্ত এক ম্যাচ খেলে। প্রথম ব্যাট করে ৫০ ওভারে করে ৪ উইকেটে ৩৩৮ রান।
শুরুতেই যশপ্রীত বুমরার নো বলে বেঁচে যাওয়া ফখর জামান খেলেন ১০৬ বলে ১১৪ রানের ইনিংস। আজহার আলী করেন ৫৯, বাবর আজম ৪৬ আর মোহাম্মদ হাফিজ শেষ দিকে ৩৭ বলে অপরাজিত ৫৭ রানের ইনিংস খেলেন।
এরপর ভারত রান তাড়া করতে নামলে বল হাতে আগুন ঝরান মোহাম্মদ আমির। তাঁর ৬ ওভারের ঝোড়ো বোলিংয়ে এক এক করে ফেরেন রোহিত শর্মা (০), বিরাট কোহলি (৫) আর শিখর ধাওয়ান (২১)। ৩৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়েই ম্যাচ থেকে একপ্রকার ছিটকে যায় ভারত।
এরপর হার্দিক পান্ডিয়া ৪৩ বলে ৭৬ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেললেও তিন শর বেশি রান ভারতের জন্য অনেক দূরেই থেকে যায়। হাসান আলীও নেন ৩ উইকেট। ভারত ৩১তম ওভারে ১৫৮ রানে অলআউট হয়ে যায়। পাকিস্তানের ১৮০ রানের জয় ছিল কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট ফাইনালে সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়।