একজন যশপ্রীত বুমরা ও একজন মোহাম্মদ সিরাজ আছেন। এরপর কে?
বললে তো অনেকগুলো নামই বলা যায়। মুকেশ কুমার, আকাশ দীপ, প্রসিধ কৃষ্ণা। কিন্তু তাঁদের কেউই কি বুমরা–সিরাজের মতো দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন? হয়তো কোনো এক সময়ে পারবেন, তবে নিকট ভবিষ্যতে নয়।
ইংল্যান্ড সিরিজে বুমরা যে তিনটি টেস্ট খেলেছেন, সেগুলোর একটিতেও জেতেনি ভারত। তবু ভারতীয় দলের পেস আক্রমণের নেতা বুমরাই। সিরাজ তাঁর প্রধান সহযোগী, বুমরার অবর্তমানে কখনো নেতাও বনে যান। ২০২৩ সালে পিঠের অস্ত্রোপচারের পর বুমরা ১৮ টেস্টে বল করেছেন ৫১৩.২ ওভার। একই সময়ে মোহাম্মদ সিরাজ খেলেছেন আরও বেশি টেস্ট, বল করেছেন ৫৮১.৪ ওভার।
৩১ বছর বয়সী বুমরাকে এখন আর নিয়মিত পাওয়া যাবে না। চোটজর্জর হওয়ায় তাঁকে খেলানো হবে বেছে বেছে। ইংল্যান্ড সফরে সিরাজ সব ম্যাচ খেললেও ওয়ার্কলোডের বিষয়টি তিনিও উড়িয়ে দিতে পারবেন না। ভারতের সর্বশেষ ২৭ টেস্টের মধ্যে ২৪টিতেই খেলা এই পেসারকেও কিছুটা বেছে বেছে খেলতে হবে।
২০১৮ সালে বুমরার টেস্ট অভিষেকের পর এখন পর্যন্ত ২০ বা এর বেশি ম্যাচ খেলেছেন ভারতের আর পাঁচ পেসার—সিরাজ, মোহাম্মদ শামি, ইশান্ত শর্মা, উমেশ যাদব ও ভুবনেশ্বর কুমার। সিরাজ ছাড়া বাকি চারজন এখন দলের বাইরে। গৌরব যাদব, মোহিত আওয়াসথির মতো রঞ্জির সেরা পারফর্মাররাও নির্বাচকদের আলোচনায় নেই।
এখন টেস্ট দলের আশপাশে আছেন অর্শদীপ সিং ও হর্ষিত রানা। আকাশ দীপও টুকটাক সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁদের সামর্থ্য আছে। তবে তা ভারতের পেস আক্রমণকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নয়? তাই বলে এখনই বুমরা-সিরাজহীন বোলিং আক্রমণ ভাবতে হচ্ছে না ভারতকে। তবে সংকট আসন্ন। বুমরা-সিরাজ দুজনের বয়সই যেহেতু ৩০ পেরিয়ে গেছে, বড় প্রশ্নটা তাই থেকেই যাচ্ছে—পরের নেতা কে?
অভিষেকের মাত্র দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ভারতের টেস্ট পরিকল্পনা থেকে সরে গেছেন মুকেশ কুমার। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্য, প্রথম শ্রেণিতে দারুণ রেকর্ড—সবকিছুর পরও ৩১ বছর বয়সী এই পেসার ঠিক জাতীয় দলে থিতু হতে পারছেন না। এ বছর ইংল্যান্ড লায়নসের বিপক্ষে ভারত ‘এ’ দলের হয়ে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জাতীয় দলে ডাক আসেনি। এমনকি রিজার্ভ হিসেবেও রাখা হয়নি।
২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি—সব সংস্করণেই ১৪ দিনের মধ্যে অভিষেক হয় মুকেশের। এখন পর্যন্ত ৩ টেস্টে ৭ উইকেট, ওয়ানডেতে ৬ ম্যাচে ৫টি, টি-টোয়েন্টিতে ১৭ ম্যাচে ২০ উইকেট নিয়েছেন। ভারতীয় দলে টিকে থাকার জন্য এমন পারফরম্যান্স যথেষ্ট নয়। প্রথম শ্রেণিতে ২১.৬ গড়ে ২১০ উইকেট আছে মুকেশের। তবে ৩১ বছর বয়সী এই পেসারের জন্য জাতীয় দলে ফেরা এখন কঠিন।
আকাশ দীপকে দেখে অনেকের মনে পড়ে যায় মোহাম্মদ শামির কথা। দুজনের বোলিং অ্যাকশনও মেলে অনেকটা। এই তো ইংল্যান্ড সফরে এজবাস্টন টেস্টে নেন ১০ উইকেট! সব মিলিয়ে ১০ টেস্টে নিয়েছেন ২৮ উইকেট। যদিও পুরোনো বলের কার্যকারিতা, মন্থর পিচে বোলিং সামর্থ্য এখনো দেখাতে পারেননি। তবু দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের পেস পরিকল্পনায় আছেন আকাশ দীপ।
ইংল্যান্ড সফরটা ভালো-মন্দ মিলিয়ে কেটেছে প্রসিধ কৃষ্ণার। ওভাল টেস্টে দারুণ বোলিং করে ৮ উইকেট নেন, ভারতের সিরিজ ড্রয়ে বড় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু এর আগে হেডিংলিতে তেমন ভালো করতে পারেননি। রান দিয়েছেন, চাপ তৈরি করতে পারেননি। দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছেন ১ উইকেট।
ইংল্যান্ডের সাবেক পেসার স্টিভ হার্মিসন প্রসিধের কিছু কৌশলগত সমস্যাও খুঁজে পান। তিনি জানান, প্রসিধ ফুল লেংথে বল করলেও সিম ঠিকমতো উপস্থাপন করতে পারছেন না। ফলে বল সুইং করছে না।
তবে ওভালে চিত্রটা ছিল আলাদা। পিচে বাউন্স ও মুভমেন্ট ছিল। সেটার পুরো ফায়দা নেন প্রসিধ। জোরের সঙ্গে পিচে বল ফেলে বাউন্স আদায় করেন, লাইনও ঠিক রাখেন। ওভালে ৮ উইকেট নিয়ে প্রমাণ করেন কেন তাঁকে ইশান্ত শর্মার উত্তরসূরি ভাবা হয়। তবে এরপরও চোট ও কম্বিনেশনের কারণে নিয়মিত খেলার সুযোগ পান না। এখন বয়স ২৯, টেস্ট খেলেছেন মাত্র ৫টি। সব মিলিয়ে সত্যিকারের হুমকি হয়ে উঠতে তাঁকে আরও ভালো পারফর্ম করতে হবে।
জহির খানের পর ভারতের বাঁহাতি পেসার খোঁজার অভিযান চলছে বহুদিন। অর্শদীপ সিং সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারবেন বলেই মনে হচ্ছিল। ওভালে অভিষেকের দোরগোড়ায় এসেও বাদ পড়েন। ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁর পরিবর্তে প্রসিধকে সুযোগ দেয়, সাফল্যও আসে।
দুই দিকেই সুইং, ‘ওবল সিম’, ভালো বাউন্সার—সব মিলিয়ে ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি অভিষেকের পর থেকে সাদা বলে অর্শদীপ এক ভরসার নাম। প্রথম শ্রেণিতে ২১ ম্যাচে ৬৬ উইকেট; গড় তেমন ভালো নয়। তবে তাঁর অ্যাঙ্গেল ও বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ বিদেশ সফরে কাজে লাগতে পারে। হয়তো ভারতের পরের সিরিজেই তাঁর টেস্ট অভিষেক হবে।
আইপিএলে নজরকাড়া পারফরম্যান্সের পর অস্ট্রেলিয়া সফরে বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফিতে হর্ষিত রানার অভিষেক হয়। পার্থে প্রথম ম্যাচেই ৪ উইকেট নিয়ে ভারতের ২৯৫ রানের জয়ে ভূমিকা রাখেন। এরপর ২ টেস্ট, ৫ ওয়ানডে ও ১ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন।
ইংল্যান্ড সফরের দলে শুরুতে জায়গা না হলেও পরে বিকল্প হিসেবে ডাক পান। আবার দ্বিতীয় টেস্টের পর তাঁকে ছেড়েও দেওয়া হয়। ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের ওপরে ধারাবাহিক গতি ও বাউন্স, সঙ্গে আগ্রাসনও আছে। ধারাবাহিক হতে পারলে দীর্ঘ মেয়াদে ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন রানা।
রঞ্জি ট্রফির এক ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে আলো কাড়েন অংশুল কম্বোজ। এরপর দ্রুতই ইংল্যান্ড সফরের দলে ডাক পান। ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে অভিষেকও হয়। যদিও অভিষেক টেস্টে পারফর্ম করতে পারেননি।
এক ইনিংসে বোলিংয়ের সুযোগ পেয়ে দেন ৮৯ রান, উইকেট পান ১টি। পরে জানা যায়, কম্বোজের চোট ছিল। ডিউক বলেও মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে। এমন অভিষেকের পরও তাঁকে হিসাবের বাইরে রাখার সুযোগ নেই। কারণ, এর আগেও তিনি খারাপ সময় পেরিয়ে পারফর্ম করেছেন।
২০২০ সালে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ না পাওয়াটা কম্বোজের জন্য ছিল একটা টার্নিং পয়েন্ট। এরপর আরও মনোযোগী হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরেন। ২২ বছর হওয়ার আগেই হরিয়ানার সিনিয়র দলে জায়গা করে নেন সব সংস্করণে।
এখন পর্যন্ত ২৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৭৯ উইকেট নিয়েছেন কম্বোজ। এ বছর আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেলেছেন, ৮ ম্যাচে নিয়েছেন ৮ উইকেট। বয়সও মাত্র ২৫, এটিও তাঁকে এগিয়ে রাখবে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে এখনো কিছু আশার আলো আছে। দিল্লির ২১ বছর বয়সী হিমাংশু চৌহান, রঞ্জি ট্রফির সেরা পেসার গৌরব যাদব (৪১ উইকেট), কর্ণাটকের বিদ্বাথ কাভেরাপ্পা আর বিজয়কুমার বৈশাখ ধারাবাহিক পারফর্ম করছেন। মুম্বাইয়ের মোহিত আওয়াসথি, বিদর্ভের আদিত্য ঠাকরে আর আসামের আকাশ সেনগুপ্তও নজরে এসেছেন। তবে তাঁদের ভারত টেস্ট দলের জন্য তৈরি করতে সময় দিতে হবে।