মিরপুরের সবুজ গালিচা আর গ্যালারির গর্জন—সব এখন পেছনে। ইমরুল কায়েসের ঠিকানা এখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি। ক্রিকেটে বাংলাদেশের অনেক জয়ের নায়ক তিনি। একসময়ের নির্ভরযোগ্য ওপেনার। পরে জীবনের ‘ইনিংস’টা মোড় নিয়েছেন অন্যদিকে। তবে ঠিকানা বদলালেও ক্রিকেটপ্রেম কমেনি এতটুকু। বরং প্রবাসে বসেই আঁকছেন নতুন স্বপ্ন, বুনছেন নতুন দিনের পরিকল্পনা।
সম্প্রতি সিডনিতে বসে ইমরুল কায়েস প্রথম আলোকে শুনিয়েছেন তাঁর বর্তমান জীবনের গল্প। কথা বলেছেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আর ক্রিকেট নিয়ে তাঁর আজন্ম আবেগের কথা।
ইমরুল কায়েস নামটা শুনলেই অনেকের মনে একটা দীর্ঘশ্বাস জাগে। ঘরোয়া লিগে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েও জাতীয় দলে ছিলেন আসা-যাওয়ার মধ্যে। অনেক সময় থেকেছেন উপেক্ষিতও। ১০ বছরের বেশি তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের বয়স। সব মিলিয়ে খেলেছেন ৩৯ টেস্ট, ৭৮ ওয়ানডে আর ১৪ টি-টোয়েন্টি। ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে দুই সেঞ্চুরি আর এক ফিফটিতে ৩৪৯ রান করেছিলেন, যা বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের তিন ম্যাচের সিরিজে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড।
কিন্তু তবু ইমরুল কেন জানি কখনোই থিতু হতে পারেননি জাতীয় দলে। ২০১৯ সালের পর আর কখনো দেশের হয়ে টেস্ট খেলা হয়নি। সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেছেন ২০১৮ সালে, ২০১৭ সালে টি-টোয়েন্টি। গত বছর টেস্ট ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। অন্য সংস্করণেও আর জাতীয় দলে খেলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তবে কি সেই অভিমান থেকেই দেশ ছাড়লেন? ইমরুল অবশ্য জানালেন ভিন্ন কথা। জানালেন, সিডনিতে আসার পেছনে মূল প্রেরণা ছিলেন তাঁর স্ত্রী। বললেন, ‘অস্ট্রেলিয়াতে আসার ইচ্ছাটা আসলে আমার স্ত্রীরই বেশি ছিল। পরে আমারও মনে হলো এটাই হয়তো ভালো। এখানে আসার পর ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকার একটা পথ খুঁজছিলাম।’
দেশ ছেড়েছেন, কিন্তু ক্রিকেট ছাড়েননি। ইংল্যান্ড থেকে আগেই ‘লেভেল-টু’ কোচিং শেষ করেছিলেন। সিডনিতে এসেও জড়িয়েছেন কোচিংয়ের সঙ্গে। এখানকার তরুণ প্রতিভাদের দেখে মুগ্ধ তিনি। ইমরুলের ভাষায়, ‘আসার আগেও এখানকার কিছু খেলোয়াড়ের খোঁজখবর নিয়েছিলাম। সত্যি বলতে, আমার ধারণার চেয়েও এখানকার ছেলেরা অনেক ভালো। ওদের দেখে নিজেরও আগ্রহ বেড়েছে।’
পুঁজি হিসেবে আছে দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। ১০ থেকে ১২ জন ভিন্ন ভিন্ন কোচের অধীন খেলার অভিজ্ঞতা। পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে মাঠের এই বাস্তব অভিজ্ঞতাটাই তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।
কোচিংয়ের পাশাপাশি ব্যবসাতেও মন দিয়েছেন ইমরুল। সতীর্থ মেহেদী হাসান মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘এমকেএস স্পোর্টস’। ভালো মানের ব্যাটের অভাব ঘোচাতে যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম, তা এখন ১৪টি দেশে ব্যাট রপ্তানি করে। সিডনিতে স্থায়ী হওয়ায় ব্যবসার প্রসারেও সুবিধা দেখছেন তিনি। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললেন, ‘এমকেএস বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত নাম। এখন আমি এখানে থাকায় অস্ট্রেলিয়াকে কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারব। বাজারটা সরাসরি দেখার সুযোগ পাব।’
তবে ইমরুলের স্বপ্ন আরও বড়। শুধু কোচ বা ব্যবসায়ী হয়েই থাকতে চান না। বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের মধ্যে একটি মজবুত সেতুবন্ধন তৈরি করতে চান। একটা নিজস্ব একাডেমি ও ইনডোর সেন্টার গড়ার ইচ্ছা তাঁর। যেখানে ভারত বা পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের মতো বাংলাদেশের ছেলেরাও এসে তৈরি হতে পারবেন।
ইমরুল বলেন, ‘আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের জন্য এখানে সুযোগ কম। আমি সেই পথটাই তৈরি করতে চাই। আমি চাই, বাংলাদেশের প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা এখানে আসুক, এখানকার কন্ডিশনে খেলুক এবং নিজেদের আরও শাণিত করুক।’
ভক্তদের মিস করেন, তবে পেশাদার জীবনের ব্যস্ততায় মানিয়ে নিয়েছেন। তাঁর কথা, ‘ভক্তরা তো অবশ্যই মিস করে। আমিও করি। তবে সত্যি বলতে, আমি তিন-চার বছর ধরেই খেলার কারণে বছরের ছয়-সাত মাস দেশের বাইরে থাকায় অভ্যস্ত। তাই এই নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না।’
টেস্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটিতে এখনো তাঁর নাম, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩১২ রানের সেই রেকর্ড জুটি গড়েছিলেন তামিম ইকবালের সঙ্গে। সেসব স্মৃতি ফেলে এখন সিডনির এই জীবনকে ইমরুল দেখছেন ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে। তাঁর কথা, ‘এখন মনে হচ্ছে, সিডনিতে চলে আসাটা একটা ব্লেসিংস বা আশীর্বাদ। এখানে একটা নতুন পরিবেশ পেয়েছি, নতুন মানুষ পেয়েছি। আর সবচেয়ে বড় কথা, ক্রিকেটটাকেই ভিন্নভাবে আঁকড়ে ধরতে পারছি। আশা করি, এখান থেকেই দেশের ক্রিকেটের জন্য নতুন কিছু করতে পারব।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগও অবশ্য এসেছে ইমরুল কায়েসের সামনে। বিপিএলের আগামী আসরে সিলেট স্ট্রাইকার্সের ব্যাটিং কোচ হিসেবে কাজ করবেন। সিডনিপ্রবাসী ইমরুলকে তাই কিছুদিন আবার দেখা যাবে তাঁর চেনা মাঠে, হোক না সেটা নতুন ভূমিকায়।