
টেস্টের প্রথম দিনেই নাটক জমে উঠতে দেখেছেন কখনো? আগে না দেখে থাকলেও আজ নিশ্চয়ই দেখেছেন, যদি আপনি বাংলাদেশ–আয়ারল্যান্ড দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিনে অন্তত শেষ বেলার দর্শক হয়ে থাকেন।
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আজ শুরু টেস্টটা মুশফিকুর রহিমের শততম। বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের প্রথম শততম টেস্ট খেলা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। সে ইতিহাসের প্রথম দিনে মুশফিক নিজ হাতে ঢেলে দিলেন রোমাঞ্চের মধু। সেটি কীভাবে, এক বাক্যেই পেয়ে যেতে পারেন তার উত্তর—শততম টেস্ট খেলতে নামা মুশফিক প্রথম দিন শেষে অপরাজিত ৯৯ রানে!
বুঝতেই পারছেন, আর একটি ওভার পেলেই মুশফিক তাঁর শততম টেস্টের প্রথম দিনটাও রাঙাতে পারতেন শতরান দিয়ে। তবে তা না হওয়াতেও ক্ষতি নেই। মুশফিক ও তাঁর সতীর্থদের সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের ক্রিকেটামোদীরাই আজকের রাতটা পার করবেন মধুর এক অপেক্ষা দিয়ে। কাল সকালে আর ১ রান করেই শততম টেস্টে শতরানের উদ্যাপনে মেতে উঠবেন মুশফিক—অপেক্ষা সেই আবেগময় দৃশ্য দেখে আবেগাক্রান্ত হওয়ার।
আয়ারল্যান্ডের হয়ে দিনের শেষ ওভারটা করেছেন গ্যাভিন হোয়। ওভারের শুরুতে সেঞ্চুরির জন্য ৩ রান দরকার ছিল মুশফিকের। ৬ বলে ৩—টেস্ট ম্যাচের মধ্যেও এই ওভার যেন শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে নিয়ে এল সাদা বলের ক্রিকেটের রোমাঞ্চ! প্রথম দুই বল ডট দিয়ে তৃতীয় বলে লিটন দাসের সঙ্গে প্রান্ত বদলে মুশফিক নিলেন ১ রান।
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে (পড়ুন মুশফিকের সেঞ্চুরিতে) পৌঁছাতে তখন দরকার ৩ বলে ২। মুশফিক নন–স্ট্রাইকে চলে গেলেও পরের বলেই ১ রান নিয়ে লিটন আবারও স্ট্রাইক দিলেন মুশফিককে। লিটনের রান তো আর মুশফিকের খাতায় যোগ হবে না। শেষ ২ বলে তাই ২–ই থাকল লক্ষ্য। পারবেন তো মুশফিক! তবে তাঁকে তা আজই পারতে হবে, এমন কোনো প্রত্যাশা অন্তত প্রেসবক্স বা গ্যালারিতে ছিল না। মুশফিকের মধ্যেই বরং একটু তাড়াহুড়া দেখা গেছে শেষ দিকে, যেটি সবাইকে একটু শঙ্কিতও করে তুলেছিল—সেঞ্চুরির তাড়াহুড়ায় না আবার তীরে এসে তরি ডোবান মুশফিক! ওদিকে স্নায়ুচাপ ভর করা ড্রেসিংরুমের আবহে কামনা—আজই সেঞ্চুরির দরকার নেই, দিনটা শেষ করে এসো।
সবকিছুর অবসান ঘটল হোয়ের পঞ্চম বলে। একটু ঝুঁকি নিয়ে সুইপ শট খেলেছিলেন মুশফিক, কিন্তু রান হলো ১। প্রথম দিনে সেঞ্চুরির সম্ভাবনা এবং সেঞ্চুরি না পাওয়ার শঙ্কা দুটোই দূর হলো তাতে। ওভারের শেষ বলে কোনো রান নিলেন না লিটন। মুশফিক অপরাজিত থাকলেন ৯৯ রানে, সঙ্গে ৪৭ রান নিয়ে লিটন। অপরাজিত থাকল মুশফিকের শততম টেস্টে সেঞ্চুরির সম্ভাবনাও।
মুশফিকের শততম টেস্ট স্মরণীয় করে রাখতে দিনের শুরুতে মাঠেই হয়েছে অনাড়ম্বর আনুষ্ঠানিকতা। যেখানে মুশফিকের জন্য ছিল বিশেষ টেস্ট ক্যাপ আর ক্রেস্ট। মা–বাবা, স্ত্রী–সন্তানদের সামনে সেসব সম্মাননা নিলেন বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ১০০ টেস্ট খেলা ক্রিকেটার। মুশফিক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাঁর এতটা পথ পাড়ি দেওয়ায় পাশে থাকা সবাইকে।
কাল জাতীয় স্টেডিয়ামে ফুটবল দলের ভারতকে ১–০ গোলে হারানোর পর দেশের খেলাধুলায় এখন হামজা–শমিতদের নিয়েই আলোচনা বেশি। এমন আবহের মধ্যে সিলেটে ইনিংস ও ৪৭ রানে হারা দুর্বল প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরের দ্বিতীয় টেস্টটি নিয়ে মাতামাতির কোনো কারণই ছিল না। তবু মাতামাতি হচ্ছে এটি মুশফিকের শততম টেস্ট বলে। আর মুশফিকও বোধ হয় চাইলেন নিজের শততম টেস্টটাকে তিনি নিজ হাতে রাঙাবেন।
টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়ার পর সকালে দুই ওপেনার মাহমুদুল হাসান ও সাদমান ইসলাম ভালো শুরু করেছিলেন। ১৪তম ওভারের মধ্যেই দলের রান হয়ে যায় ৫০। কচি ঘাসের আবরণে সবুজাভ উইকেটে বল উঠছিল, সকালের দিকে সামান্য এদিক–সেদিকও হচ্ছিল; তবে সেটি ব্যাটসম্যানদের সমস্যায় ফেলার মতো কিছু ছিল না। তার মধ্যেও প্রথম সেশনে ৯৫ রান তুলতে দুই ওপেনারের পর অধিনায়ক নাজমুল হোসেনের উইকেটও হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ।
৩ উইকেটে ১০০ রান নিয়ে মধ্যাহ্ন বিরতি, পরের সেশনে আর কোনো উইকেট না হারিয়ে ৯২ রান, শেষ সেশনে মুমিনুল হককে হারিয়ে যোগ হয় আরও ঠিক ১০০। সব মিলিয়ে ৪ উইকেট হারিয়ে ২৯২—বাংলাদেশের জন্য ভালো দিনই বলতে হয়। অবশ্য মুমিনুলের ব্যক্তিগত ২৩ এবং ৪৯ রানে পাওয়া দুটি নতুন জীবন এবং ২২ রানে উইকেটের পেছনে দেওয়া মুশফিকের আউটের সুযোগটাকে বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে মনে রাখতে হবে এখানে। এসবের মধ্যেই টেস্টে মুমিনুল ২৪তম ফিফটি (৬৩) করেছেন, পূর্ণ হয়েছে টেস্টে বাংলাদেশের ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে লিটনের তিন হাজার রানও। আয়ারল্যান্ডের হয়ে ৪টি উইকেটই নিয়েছেন অফ স্পিনার অ্যান্ডি ম্যাকব্রাইন।
অপর প্রান্তে থেকে দুটোরই সাক্ষী হয়েছেন পাঁচে নামা মুশফিক। চতুর্থ উইকেটে মুমিনুলের সঙ্গে ১০৭ রানের জুটির পর দিন শেষে লিটনের সঙ্গে তাঁর পঞ্চম উইকেট জুটি অবিচ্ছিন্ন থেকেছে ৯০ রানে। ১৮৭ বলে ৯৯ রানে অপরাজিত থেকে দিন শেষ করা মুশফিকের ইনিংসে বাউন্ডারি মাত্র চারটি। কতটা এক–দুই নির্ভর ইনিংস খেলেছেন, সেটি তো বুঝতেই পারছেন।
৯৫ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ায় শুরুতে ধরে খেলার কাজটাই করেছেন মুশফিক। প্রথম চার মেরেছেন নিজের খেলা ৬৮তম বলে। এভাবে খেলেই অবশ্য ৯০ পার হয়ে গেছেন কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই। দ্বিতীয় সেশনে মুমিনুলের সঙ্গে জুটিতে দলের ইনিংসটাকেও দিয়েছেন স্থিতি, যার সুবাদে প্রথম দিন শেষে বড় রানে চোখ রাখতে পারছে বাংলাদেশ। শততম টেস্টে সেঞ্চুরি উদ্যাপনের অপেক্ষায় থাকতে পারছেন মুশফিক নিজেও।