১৯৭৮ সালে শাহিওয়ালে সেই ম্যাচে ভারতের অধিনায়ক ছিলেন বিষেণ সিং বেদি (বাঁয়ে), পাকিস্তানের হয়ে খেলেছিলেন পেসার সরফরাজ নেওয়াজ
১৯৭৮ সালে শাহিওয়ালে সেই ম্যাচে ভারতের অধিনায়ক ছিলেন বিষেণ সিং বেদি (বাঁয়ে),  পাকিস্তানের হয়ে খেলেছিলেন পেসার সরফরাজ নেওয়াজ

এই দিনে

সরফরাজের টানা চার বাউন্সার, আম্পায়ার নিশ্চুপ, প্রতিবাদে ম্যাচ ছেড়ে দিলেন ভারত অধিনায়ক

১৪ বলে ২৩ রান দরকার, হাতে ৮ উইকেট। ওপেনারদের একজন ৭৮ রানে অপরাজিত। এই ম্যাচে কোন দল জিততে পারে—এ নিয়ে কেউ বাজি ধরতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। এখান থেকে ব্যাটিং টিম খেলা ছেড়ে দিতে পারে, এটা কি বিশ্বাস করার মতো?

অথচ ঘটনা তা–ই।

সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা নিয়ে অবশ্য সবার আগে আলোচনা করা উচিত। খেলা ছেড়ে দেওয়া মানে কী? যে ম্যাচটার কথা বলছি, সেটি ছিল ওয়ানডে। টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংস ডিক্লেয়ার করা যায়, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তো বটেই। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তো সেই নিয়মই নেই। এটা তো বক্সিং ম্যাচও নয় যে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারও অবস্থা খারাপ দেখে প্রতিপক্ষকে জয়ী ঘোষণা করে দেবেন রেফারি। পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরও তাই অলআউট বা ওভার শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত খেলা চলে। তাহলে?
এই ‘তাহলে’–এর উত্তর দিতেই এই লেখা।

১৯৭৮ সালে শাহিওয়ালে ভারত–পাকিস্তান ওয়ানডেটা ব্যতিক্রমী হয়ে থাকার কারণও লুকিয়ে এতে। ওয়ানডে ইতিহাসে এটাই একমাত্র ম্যাচ, যাতে এক দল খেলা ছেড়ে দিয়ে প্রতিপক্ষকে জয় উপহার দিয়েছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, সিদ্ধান্তটা ছিল ভারতীয় অধিনায়ক বিষেণ সিং বেদির, যা ছিল আসলে একটা প্রতিবাদ।

অধিনায়ক হিসেবে বিষেণ সিং বেদি ছিলেন আপসহীন মনোভাবের

লেখার শুরুতে যে সমীকরণের কথা বলেছি, তা ছিল ভারতের সামনে। এখন যেমন ওয়ানডে মানেই ৫০ ওভারের ম্যাচ, তখন তা ছিল না। ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ ৬০ ওভারের ম্যাচও হতো। এর বাইরে ৫৫, ৫০, ৪৫, ৪০—নানা দৈর্ঘ্যের ম্যাচ হতো ওয়ানডেতে। এই ম্যাচটাই যেমন ছিল ৪০ ওভারের, যাতে প্রথমে ব্যাটিং করে পাকিস্তান করেছিল ৭ উইকেটে ২০৫। যেটির জবাব দিতে নেমে ভারত ৩৭ ওভারে ২ উইকেটে ১৮৩ রান করে ফেলার পর ওই ম্যাচে পাকিস্তানের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে হচ্ছিল।

জয়ের জন্য শেষ ৩ ওভারে, মানে ১৮ বলে ভারতের ২৩ রান লাগে, উইকেটে জমে যাওয়া ওপেনার অংশুমান গায়কোয়াড়ের সঙ্গে মাত্রই যোগ দিয়েছেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। তখনই নাটকের শুরু। ৩৮তম ওভারটা করতে বোলিংয়ে এলেন পাকিস্তানের পেসার সরফরাজ নেওয়াজ। রান আটকানোর মোক্ষম এক উপায় বের করে পরপর চারটি বাউন্সার। সেই বাউন্সারও এমন যে নাগাল পাওয়া ব্যাটসম্যানের অসাধ্য। তাহলে তো ওয়াইড হওয়ার কথা, তা–ই না? হওয়ার কথা, কিন্তু হলো না। কারণ, আম্পায়াররা নিশ্চল দাঁড়িয়ে। আগেকার দিনে মাঠে ভারতীয় ও পাকিস্তানি আম্পায়ারদের দেশপ্রেমের প্রকাশ নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে। এই ম্যাচের দুই আম্পায়ার জাভেদ আখতার ও খিজির হায়াতও হয়তো সেই চেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন। একটা বলেও তাই তাঁদের দুই হাত প্রসারিত হলো না। মানে ওয়াইড দিলেন না। নীতির ব্যাপারে আপসহীন ভারতীয় অধিনায়ক বিষেণ সিং বেদি রেগেমেগে ডেকে পাঠালেন দুই ব্যাটসম্যানকে। সেই ম্যাচে বিজয়ী ঘোষণা করা হলো পাকিস্তানকে।

এই পরিণতির কথা বিষেণ সিং বেদিও জানতেন। এমন ভাববেন না যে ‘মরা’ ম্যাচ বলেই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বেদি। সেই ম্যাচ ছিল ওয়ানডে সিরিজ নির্ধারণী। তিন ম্যাচের সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে দুই দল জিতে স্কোরলাইন ছিল ১–১। এই ম্যাচে জয় পেয়ে পাকিস্তান তাই ২–১–এ ওয়ানডে সিরিজ জিতে যায়।

ভারতের রান আটকাতে সেই ম্যাচে একের পর এক বাউন্সার দিয়েছিলেন সরফরাজ নেওয়াজ

এসব ব্যাপারে বেদির আপসহীন মনোভাবের পরিচয় অবশ্য এর আগেও পেয়েছিল ক্রিকেট–বিশ্ব। শাহিওয়ালে ওই ওয়ানডের বছর দুয়েক আগে ১৯৭৬ সালের মার্চে জ্যামাইকা টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলারদের টানা বাউন্সারে একের পর এক ভারতীয় ব্যাটসম্যান আহত হওয়ার পর ৬ উইকেট পড়তেই প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে দিয়েছিলেন বেদি। সেটিও ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘ইনটিমিডেটরি বোলিং’–এর প্রতিবাদ। শাহিওয়াল ওয়ানডেতে যে ওপেনারের কথা বলছিলাম, সেই অংশুমান গায়কোয়াড় জ্যামাইকায় বাউন্সারের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ৮১ রান করার পর শেষ পর্যন্ত ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ করতে বাধ্য হন। কিছুক্ষণ পর গায়কোয়াড়কে অনুসরণ করেন ব্রিজেশ প্যাটেলও। বাকি ব্যাটসম্যানদের অবস্থাও সুবিধার ছিল না।

একটা প্রশ্ন অবশ্য আপনার মনে জেগেছে বলেই অনুমান করি। হঠাৎ এসব পুরোনো কাহিনি ফেঁদে বসার কারণটা কী? কারণ তো অবশ্যই আছে।

ওয়ানডে ইতিহাসে কোনো অধিনায়কের ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার একমাত্র যে ঘটনার কথা বললাম, সেই ম্যাচটি হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ৩ নভেম্বর, অর্থাৎ ৪৭ বছর আগের এই দিনেই।