ফজলহক ফারুকি
ফজলহক ফারুকি

পেসার হয়ে টিটকারি শোনা সেই ছেলেই নতুন বলে আফগানদের আশার প্রতীক

আফগানিস্তান মানেই স্পিনের দেশ। মোহাম্মদ নবী, রশিদ খান, আল্লাহ গজনফর, মুজিব উর রেহমান—বিশ্বমানের স্পিনারদের অভাব নেই দেশটিতে। সেই আফগানিস্তানেই একজন ফজলহক ফারুকি দেখেছিলেন পেস বোলার হওয়ার স্বপ্ন। এ জন্য কিশোর বয়সে বন্ধুদের কাছে টিটাকারিও শুনতে হয়েছে। কারণ, আফগান ক্রিকেটে ধারণা ছিল এমন, বিদেশি লিগে খেলে তারকা হওয়ার সুযোগ শুধু স্পিনারদেরই, পেসারদের নয়।

ফারুকি এই গল্প শুনিয়েছিলেন আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে খেলতে এসে। ২০২২ সালে হায়দরবাদের পোস্ট এক ভিডিওতে ফারুকি বলেছিলেন, ‘সবাই মজা করেই বলেছে। কিন্তু আসলে ধারণটাই এমন ছিল। আফগান স্পিনাররাই শুধু বিদেশি লিগে খেলবে, ব্যাটসম্যান আর পেসাররা নয়।’

ফারুকি এ ধারণা ভেঙেছেন। আইপিএল, বিগ ব্যাশ, সিপিএল, পিএসএল, দ্য হানড্রেড—বড় বড় লিগেই দেখা গেছে এই আফগান তারকাকে। আজ শুরু হতে যাওয়া এশিয়া কাপেও নতুন বলে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম ফজলহক ফারুকিই।

এমনিতে ফারুকিকে দেখলে আহামরি পেসার মনে না–ও হতে পারে। উচ্চতা কম, বলের গতিও ঘণ্টায় ১৪৫ বা ১৫০ কিলোমিটার নয়। তবে বল দুই দিকেই সুইং করাতে পারেন। আর ব্যাটসম্যানদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই যার বড় প্রমাণ। ৮ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে ফারুকি ছিলেন যৌথভাবে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক। ওভারপ্রতি রান দিয়েছিলেন ৬.৩১ করে। সমান ৮ ম্যাচে ১৭ উইকেট নেন ভারতের অর্শদীপ সিংও।

সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৪৭ ম্যাচে ৫৯ উইকেট নিয়েছেন এই পেসার। তাঁর ইকোনমি রেট মাত্র ৬.৭৯। ৫৯ উইকেটের মধ্যে ৩৪ উইকেট পেয়েছেন পাওয়ার প্লেতে। এই উইকেটগুলোই আফগান স্পিনারদের জন্য মঞ্চ তৈরি করে দেয়।

ফারুকি নিজেও নিজের সীমাবদ্ধতা জানেন। কাজ করেন তা মেনেই। তিনি বলেছেন, ‘আমি খুব সহজ করে ভাবি। যখন অনূর্ধ্ব-১৯ বা অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলতাম, তখন ভাবতাম—আমি তো লম্বা-চওড়া নই, খুব দ্রুতগতির বোলারও নই। তখন থেকেই ভেবেছি, অন্যদের থেকে আলাদা কিছু শিখতে হবে। তাই সুইং শেখার চেষ্টা করেছি। এখন এটাই আমার কাছে সহজ মনে হয়।’

দারুণ ছন্দে আছেন বাঁহাতি পেসার ফারুকি।

ফারুকি বড় হয়েছেন আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাগলান শহরে। সেই শহরে তাঁর শৈশব কেটেছে নানা অভাবে। বিদ্যুৎ ছিল বিলাসিতা, টিভিতে ক্রিকেট দেখে কাউকে অনুসরণ করা তো দূরের কথা। সানরাইজার্স হায়দরাবাদে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘কয়েক বছর আগেও নিয়মিত বিদ্যুৎ ছিল না। আরেকটা সমস্যা ছিল টেলিভিশন। কোনো এক বাড়িতে যদি একটা টিভি থাকত আর বিদ্যুৎ আসত, তখন পুরো এলাকার মানুষ ভিড় করত। সবার বসার জায়গা হতো না। আমি ছোট বলে আমাকে বসতে দিত না। জানালা দিয়ে উঁকি দিলে তাড়িয়ে দিত। ম্যাচ দেখাটাই ছিল বড় কষ্ট। ২০১৭ সাল পর্যন্ত সহজে টিভি দেখতে পারিনি। তখন শুধু স্বপ্ন দেখতাম—কবে নিশ্চিন্তে বসে টিভি দেখতে পারব। এখন অবশ্য পারি।’

আফগানিস্তান ক্রিকেট যখন ধীরে ধীরে বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিচ্ছে, তখনই নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন মোহাম্মদ নবী আর রশিদ খান। তাঁদের শৈশবের দুঃসহ স্মৃতি, দেশ ছাড়ার গল্প, শরণার্থীশিবিরের দিনগুলো ছুঁয়ে গিয়েছিল অনেক তরুণকে। কিন্তু ফারুকির বেড়ে ওঠা ছিল অন্য রকম। নবী-রশিদদের মতো পাকিস্তানের শিবিরে ক্রিকেট শেখা হয়নি তাঁর। কোনো নাটকীয় পালানোর গল্পও নেই তাঁর জীবনে।

রশিদ খানের সঙ্গে ফারুকি। ২০২৪ বিশ্বকাপের ছবি।

তবে চ্যালেঞ্জ ছিল যথেষ্ট। ফারুকি বলেন, ‘আমার গ্রামে ফুটবলই ছিল বড় খেলা। জাতীয় দল জিততে শুরু করার পর আমরা ক্রিকেট অনুসরণ করা শুরু করি। তখন কোনো একাডেমি ছিল না, কেউ আমাদের শেখাত না। ভালো ব্যাট-বলও ছিল না। আমরা সবাই টেনিস বল দিয়েই খেলতাম, যতই পুরোনো হোক না কেন। অনেক পরে বোর্ড একাডেমি খোলে, তখনই আমরা ব্যাট-বল ফ্রি পাই। সেখান থেকেই আমার যাত্রা শুরু—প্রাদেশিক দল, জুনিয়র জাতীয় দল, তারপর জাতীয় দল।’

ফারুকি এখন আফগানিস্তান দলে স্পিনারদের মতোই অপরিহার্য। তবে তাঁর পরিচয় এর চেয়ে বড়—দেশের প্রথম ফাস্ট বোলিং আইকন, যিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। এটাই তাঁর স্বপ্নও।

এশিয়া কাপে কেমন করবেন ফারুকি?

ফারুকির ভাষায়, ‘যেখানেই যান কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেন, সবাই আফগানিস্তানের স্পিনারদের নিয়েই কথা বলে। কারণ, আমাদের ভালো স্পিনার আছে, রোল মডেল আছে রশিদ আর মুজিবের মতো। আমি চাই দেশের তরুণেরা অনুপ্রাণিত হোক ফাস্ট বোলার হতে। সবাই যেন বলে আফগানিস্তানের শুধু ভালো স্পিনার নয়, ভালো পেসারও আছে। এর জন্যই আমাকে কিছু অর্জন করতে হবে।’

সেই অর্জনের জন্য আরও একটি বড় মঞ্চই এশিয়া কাপ। দেখা যাক, ফারুকি সেখানে কেমন করেন! আজ হংকংয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে তাদের এশিয়া কাপ শুরু হবে।