
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা সফরের ওয়ানডে সিরিজে ভালো বোলিং করা বাঁহাতি স্পিনার শুনিয়েছেন তাঁর উঠে আসার গল্প।
‘আমার তো ঠিক নেই, অনেক জুনিয়রকে আপনি করে বলি, আবার অনেক সিনিয়রকে তুই বা তুমি।’ কথাগুলো বলতে বলতে কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে আসার সেই গল্পগুলো মনে করেন তানভীর ইসলাম। কখনো বয়সভিত্তিক দলে না খেলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটের চূড়ায় পৌঁছে যাওয়ার দুরূহ কাজটি করেছেন। সতীর্থদের সঙ্গে সম্পর্কের সম্বোধনে ‘আপনি’, ‘তুই’, ‘তুমি’র গোলমেলে হিসাবটাও বয়সভিত্তিক দলে না খেলা থেকেই। বয়সভিত্তিক দলের সিঁড়ি মাড়িয়ে আসেননি বলে অনেক সময়ই বুঝতে ভুল হয়—কে বয়সে তাঁর বড়, কেই–বা ছোট!
সিঁড়ি বেয়ে না ওঠার কারণেই কি না, তানভীরের আন্তর্জাতিক অভিষেক একটু দেরিতেই হয়েছে। ২৮ বছর বয়সে যেখানে বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার ‘অস্তের’ দিকে হেলে পড়ে, সেখানে তানভীরের ওয়ানডে ক্রিকেটের পথচলার শুরু এখান থেকে, টি–টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছেন এর দুই বছর আগে। জাতীয় দলে খেলা বা এর আশপাশে থাকা বেশির ভাগ ক্রিকেটারের যখন ক্রিকেটের প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়ি শৈশবে, তানভীরের সেটা কৈশরের প্রান্তে গিয়ে। তাঁর গল্পের শুরু এক দশক আগে, ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি ক্রিকেট একাডেমিতে নাম লেখানো দিয়ে।
বাবা-মা চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকেন, তানভীরের বেড়ে ওঠা বরিশালের উজিড়পুরে নানির কাছে। ছোটবেলা নানির কাছে আবদার করতেন ব্যাট–বলের। নানির কিনে দেওয়া ব্যাট দিয়ে নিজের চেয়ে বয়সে বড়দের সঙ্গে খেলতেন টেপ টেনিস ক্রিকেট। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি তানভীরের ঝোঁক থাকলেও বাবা ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে ডেন্টিস্ট হোক বা পুলিশের চাকরি নিক।
কিন্তু তানভীর বাবার কাছে দুটি বছর চেয়ে নেন। বাবাকে বলেন, দুই বছরের মধ্যে নিজেকে ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে তিনি যা বলবেন, সেটাই করবেন। এরপরই তানভীরের বাবা তাঁকে ভর্তি করে দেন ধানমন্ডির ওই ক্রিকেট একাডেমিতে। একাডেমির হয়ে তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট দিয়ে শুরু। সেখান থেকে প্রথম বিভাগের দল খেলাঘরে সুযোগ পান। ২৯ উইকেট নিয়ে দলকে তোলেন প্রিমিয়ার লিগে। নজরে পড়েন বিপিএলের দল খুলনা টাইগার্সের ম্যানেজার (এখন তিনি জাতীয় দলের ম্যানেজার) নাফিস ইকবালের, সুযোগ মেলে বিপিএলে।
এসব গল্প পেছনে ফেলে তানভীর স্বপ্নের দুনিয়ায়। টি-টোয়েন্টি দলে আসা-যাওয়া থাকলেও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই জাতীয় দলের হয়ে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছে, দ্বিতীয় ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়ে হয়েছেন ম্যাচসেরা। এমন রঙিন সময় কাটানোর কিছুদিন আগেও হতাশায় ডুবে যেতে বসেছিলেন তানভীর। ২০২৩ সালের মার্চে মিরপুরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টি–টোয়েন্টি অভিষেক। অভিষেক ম্যাচে ২ ওভার বোলিং করে ১৭ রান দিয়ে নেন ১ উইকেট। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সে বছরেরই ডিসেম্বরে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে খেলা একটি ম্যাচে উইকেট পাননি। কোনো ম্যাচ খেলা না হলেও ছিলেন ২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্কোয়াডে। ২০২৪ সালে অবশ্য দুটি ম্যাচ তিনি খেলেছেন জিম্বাবুয়ের বাংলাদেশ সফরে, উইকেট পান একটি।
এরপর যান এ বছর বাংলাদেশের সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে। দুই ম্যাচে ৮ ওভার বল করে ৬৭ রান দিয়ে নেন দুই উইকেট। এ সফরই তানভীরকে হতাশায় ডোবায়। এতটাই যে তিনি নিজের বোলিং অ্যাকশনই বদলে ফেলতে চেয়েছিলেন। তবে তাওহিদ হৃদয় তাঁকে এক সিরিজের বাজে পারফরম্যান্সের জন্য হতাশায় ভেঙে পড়তে না করেন। হৃদয়ের পরামর্শ মেনে আবার পুরোনো অ্যাকশনে ফিরে আসার লড়াই শুরু করেন।
সে লড়াই চলাকালেই একটা ফোনকল নতুন করে আশা দেখাতে শুরু করে তানভীরকে, ‘শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার আগে মিরাজ ভাই (মিরাজ বয়সে তানভীরের চেয়ে এক বছরের ছোট!) বলেন, “তোকে আমার লাগবে।”’ মিরাজের সেই প্রয়োজন থেকেই মুহূর্তে বদলে গেল তানভীরের জীবন। গভীর হতাশা থেকে এখন তিনি সাদা বলের ক্রিকেটের রঙিন দুনিয়ায় পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় তাঁর সফল হওয়ার মন্ত্রটা সহজ। যে মন্ত্রটা তাঁর সব সময়ের বোলিংয়ের—বাতাসে থাকতেই বল ঘুরানো আর ভালো জায়গায় ফেলার চেষ্টা। নিজের ভান্ডারে নতুন অস্ত্র যোগ করার বিষয়ে তানভীর অবশ্য মানেন সাকিব আল হাসানের পরামর্শ, ‘সাকিব ভাইয়ের সঙ্গে একবার বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনা নিয়ে কথা হয়েছিল। উনি আমাকে বলেছেন, “সফল হওয়ার জন্য খুব বেশি স্কিলের দরকার নেই। প্রতি মৌসুমে একটা করে নতুন স্কিল চেষ্টা করবি। একসঙ্গে অনেকগুলো চেষ্টা করলে কোনোটাই ঠিকঠাক হবে না।’”
এখন তো বাংলাদেশের স্পিন বোলিং কোচ কিংবদন্তি মুশতাক আহমেদ। পাকিস্তানের সাবেক লেগ স্পিনারে তানভীরের মুগ্ধতা অন্য জায়গায়, ‘ওনার কথা এত সুন্দর! এত সুন্দর করে মোটিভেশন দেন! এটা খুব প্রয়োজনীয়।’ তানভীরের অনুপ্রেরণা তো হতে পারেন তিনি নিজেও। বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চল উজিড়পুর, যেখানে এখনো সেভাবে কাঠামোগত ক্রিকেটের সংস্কৃতিই গড়ে ওঠেনি; সেখান থেকে ঢাকার তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট হয়ে এখন তিনি জাতীয় দলের মঞ্চে। কাজটা যে সহজ ছিল না, তা বোঝা যায় তাঁর একটা কথায়ও, ‘বরিশালে এখনো সুযোগ-সুবিধা নেই। আমাদের এখানকার ছেলেদের ঢাকা বা খুলনায় যেতে হয় অনুশীলন করতে।’