শিরোনামটা ভালো করে খেয়াল করুন। বুঝতে পারবেন, আপনার মতামতের গুরুত্ব আছে। প্রশ্নটা তাই আপনার উদ্দেশেই—বাংলাদেশ দল টি-টোয়েন্টিটা কেমন খেলে?
উজ্জীবিত, ইতিবাচক সমর্থক হলে আপনার উত্তর কী হতে পারে, সেটা বোঝা কঠিন নয়।
ভালোই তো বলবেন, এ দলটা তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ জেতে। যদি নেতিবাচক সমর্থক হন, তাতেও আপনার উত্তর বোঝা সহজ। বাংলাদেশ আরব আমিরাতের বিপক্ষে সিরিজ হেরেছে, সেটাই তো বলবেন!
যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ হারের ঘটনা টানতে চাইলে পাল্টা যুক্তি আছে। ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে খেলা সেই সিরিজের দল আর এই বাংলাদেশ দলের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। সেই সিরিজের দলে সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মতো অভিজ্ঞ হলেও একটু বয়স্ক ক্রিকেটাররা ছিলেন, সে তুলনায় বর্তমান দলটা নতুন ও তারুণ্যে ভরপুর।
ক্রিকেটে উত্থান–পতন থাকবে। কোনো দল আরব আমিরাতের কাছে হারতে পারে, আবার অস্ট্রেলিয়া কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও হারাতে পারে। এটাই ক্রিকেটের সৌন্দর্য। এরপরও নির্মোহভাবে যেকোনো দলকে বিচার–বিশ্লেষণের সুযোগ আছে। সেভাবে দেখলে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলটা আসলে কেমন?
শুরুটা তো ওপেনারদের দিয়েই করতে হবে। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ওপেনিং কম্বিনেশন আপাতত ঠিকঠাক। তানজিদ হাসানের সঙ্গে ওপেন করেন পারভেজ হোসেন। সাবধান! পরিসংখ্যান দেখতে যাবেন না, প্লিজ! মন খারাপ হবে। পারভেজের গড় ২০.২৬, তানজিদের ২৭.২৫। এরপরও টি-টোয়েন্টিতে ওপেনিংয়ে তাঁদের বাইরে বাংলাদেশের ভাবার সুযোগ নেই বললেই চলে!
কারণ? টি-টোয়েন্টি মেজাজে ব্যাটিং করার সহজাত সামর্থ্য। এ সময়ের ক্রিকেটে ঝুঁকি নেওয়ার শুরুটা ওপেনারদেরই করতে হয়। স্পিনারদের হাওয়ায় ভাসানো বলটাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে গ্যালারিতে পাঠানোর দম, সাহস ও দক্ষতা ওপেনারদের থাকতে হয়। পেসারদের বিপক্ষে নতুন বলে ব্যাটটা চালাতেই হয়। আর এই দম, সাহস ও দক্ষতা পারভেজ ও তানজিদের আছে। ৬ ছক্কায় গতকাল তানজিদের খেলা ৭৩ রানের অপরাজিত ইনিংসটি এর উদাহরণ। পাকিস্তানের বিপক্ষে লাহোরে ৩৪ বলে ৬৬, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ২২ বলে ৩৮ রানে পারভেজও প্রমাণ করেছেন।
তিন ও চার নম্বরে আছেন লিটন দাস ও তাওহিদ হৃদয়। এখানেও আছে আশার আলো। কারণ তানজিদ-পারভেজের মতো সহজাত মেজাজে টি-টোয়েন্টি খেলার সামর্থ্য আছে এই দুজনেরও। যা একটু অভাব ধারাবাহিকতার।
শ্রীলঙ্কা সিরিজে দ্বিতীয় ম্যাচে ৭৬ ও তৃতীয় ম্যাচে ৩২ রান করে সিরিজসেরার ট্রফি লিটনকে বাড়তি অনুপ্রাণিত করতে পারে। যদিও লিটন এমন অনুপ্রাণিত হয়েছেন বারবার। তবু ধারাবাহিকতার অভাব।
যে ক্রিকেটার ২০২২ সালে ভারতের বিপক্ষে অ্যাডিলেডে ২১ বলে ফিফটি করতে পারেন, তাঁর তো অন্য অনুপ্রেরণার দরকার পড়ে না। সামর্থ্যের সার্টিফিকেট দিতে তো ওই এক ইনিংসই যথেষ্ট ছিল। তবে অতীত ভুলে লিটনকে এখন জ্বলে উঠতেই হবে। অধিনায়ক লিটন টি-টোয়েন্টি দলে পারফর্ম না করলে পুরো দলের কম্বিনেশন এলোমেলো হয়ে যেতে পারে।
অল্প দিনের ক্যারিয়ারে হৃদয়ও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার বলে টানা তিন ছক্কা মনে করে দেখুন। এ সময়ের ক্রিকেটে এই মানসিকতাই রাখতে হয়। একটি ছক্কার পর দেখেশুনে পরের ৫ বলে ৫ রান নিয়ে ১১ রান তোলার ধারণা এখন সেকেলে। এটি হতে পারে শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতে। ভারতের সঞ্জু স্যামসন, অভিষেক শর্মারা এই মানসিকতাতেই ব্যাটিং করেন। মারার বল পেলে এক ওভারে তিন-চারটা ছক্কাও মারেন। হৃদয় তা করে দেখিয়েছেনও। সে কারণেই বাংলাদেশকে হৃদয়ে ভরসা রাখতে হয়।
টি-টোয়েন্টি দলে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার শামীম হোসেন। দারুণ ফিল্ডার, বলটাও করতে পারেন, আর ব্যাটিং তো আছেই। এ সংস্করণে একেবারে ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’। ২০২১ সালে অভিষিক্ত শামীম এখন প্রত্যাশার প্রতিদান দিচ্ছেন। সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ যে ১৭৭ রান তুলল, তাতে বড় অবদান ছিল এই বাঁহাতিরই। সেদিন ২৭ বলে ৪৮ রান করেছিলেন।
দলে জাকের আলীর জায়গাটাও পাকাপোক্ত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ যে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছে, সেখানে বড় অবদান ছিল জাকেরের। শেষ ম্যাচে খেলেছেন ৪১ বলে ৭২ রানের ইনিংসও।
তানজিদ, পারভেজ, লিটন, হৃদয়, শামীম, জাকের—টি-টোয়েন্টি দলে এই ছয়জনের যে কারোরই নিজেদের দিনে ম্যাচ জেতানোর সামর্থ্য আছে। সঙ্গে তাঁদের সবাই যে যার জায়গা থেকে ছোট ছোট অবদানও রাখতে পারেন। মানে কেউ বড় ইনিংস না খেললেও যে যাঁর কাজটা করলে বাংলাদেশ ভালো সংগ্রহ পায়। কারণ, এই ছয়জনের মধ্যে সবচেয়ে কম স্ট্রাইক রেট লিটনের, সেটিও ১২৫.৪৮। লিটনের স্ট্রাইক রেট কমেছে অফ ফর্মের কারণে। আসলে লিটন যেদিন খেলেন, সেদিন স্ট্রাইক রেটে আলাদা করে চোখ রাখতে হয় না।
বাংলাদেশের পেস বোলিং আক্রমণ অনেক দিন ধরেই স্থির। মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে তাসকিন আহমেদ, শরীফুল ইসলাম, তানজিম হাসান, হাসান মাহমুদ, নাহিদ রানারা আছেন। তাঁদের সবাই যে টি-টোয়েন্টি খেলেন বা এই দলে প্রতিষ্ঠিত, তা নয়। তবে ২০২৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেরা দল পেতে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে তাঁদেরই হয়তো খেলানো হবে। অভিজ্ঞ ও তরুণদের মিশেলে গড়া এই পেস আক্রমণ ভরসার প্রতিদানও দিচ্ছে। সে কারণেই তো কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই নামগুলো লেখা গেল।
পেসারদের সঙ্গে যোগ করুন লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন ও অফ স্পিনার মেহেদী হাসানকে। রিশাদ কী পারেন, সেটি তিনি গত বিশ্বকাপে ১৪ উইকেট নিয়েই প্রমাণ করেছেন। পিএসএলে শিরোপা জিতেছেন। বিগ ব্যাশে আবারও দল পেয়েছেন। সব মিলিয়ে এ সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় টি-টোয়েন্টি তারকা রিশাদ।
মেহেদীও পারফর্ম করছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে ৮ উইকেট নিয়ে সিরিজসেরা হয়েছিলেন। কাল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে হয়েছেন ম্যাচসেরা। সবচেয়ে বড় বিষয়, নিয়মিত নতুন বলে বোলিং করতে পারেন। ব্যাটসম্যানকে আটকে রাখতে পারেন। সে কারণেই তো ৫৮ টি-টোয়েন্টি খেলা এই স্পিনার ইকোনমি—৬.৭০।
আশার কথা হচ্ছে, এ দলটার রয়েছে সহজাত টি-টোয়েন্টি খেলার সামর্থ্য। এখন লাগবে সময় এবং টিম ম্যানেজমেন্টের সঠিক সিদ্ধান্ত। একটা আরব আমিরাতের মতো খারাপ সিরিজ আসতেই পারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতে পারে ট্রল। এসবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের পরিকল্পনায় লেগে থাকলে ২০২৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সাফল্য পেতে পারে বাংলাদেশ। টিম ম্যানেজমেন্ট এ দলটাকে সেই সুযোগ দেবে নিশ্চয়ই!