আইপিএল ট্রফি হাতে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু অলরাউন্ডার ক্রুনাল পান্ডিয়া
আইপিএল ট্রফি হাতে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু অলরাউন্ডার ক্রুনাল পান্ডিয়া

ক্রুনাল পান্ডিয়া: আড়ালে থাকা এক নায়ক, অবমূল্যায়িত এক আইপিএল গ্রেটের নাম

এবারের আইপিএলের উদ্বোধনী ম্যাচে সেরা খেলোয়াড় কে হয়েছিলেন, মনে আছে?

ওপরের লাইনটা পড়ার পর অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করে বলতে পারেন, ‘কাল রাতে আইপিএলের ফাইনাল হয়ে গেল। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নিলেন ক্রুনাল পান্ডিয়া। অথচ এই লেখক কি না সেই মার্চে শুরু হওয়া টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ নিয়ে পড়ে আছেন!’

আসলে প্রসঙ্গক্রমেই প্রশ্নটা করা। কথায় আছে না—শেষ ভালো যাঁর, সব ভালো তাঁর! তবে এবার ক্রুনাল পান্ডিয়ার শুরু–শেষ দুটিই ভালো হয়েছে।

ফাইনালে ক্রুনালের দুর্দান্ত বোলিং ব্যবধান গড়ে দিয়েছে

আহামেদাবাদে পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে ফাইনালের মতো গত ২২ মার্চ ইডেন গার্ডেনে কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচেও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছিলেন ক্রুনাল। টুর্নামেন্টর মাঝের সময়টাও ভালো কেটেছে ৩৪ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডারের। খারাপ করলে কি আর শেষ পর্যন্ত একাদশে জায়গা ধরে রাখতে পারতেন, দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠতে পারতেন?

প্রায় আড়াই মাস আগে আইপিএলের প্রথম ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিতে গিয়ে ক্রুনাল বলেছিলেন, ‘এর আগেও দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে (মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ও লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টস) খেলেছি। কিন্তু বেঙ্গালুরুর মতো অনুরাগী কোথাও দেখিনি। এই ফ্র্যাঞ্চাইজি যে এত বছরেও ট্রফি জেতেনি, এটা তাদের দুর্ভাগ্য। এবার ভাগ্য বদলাতে চাই।’

কাল ফাইনালসেরার পুরস্কার নিতে গিয়ে সেই কথাই একটু আলাদা সুরে বলেছেন, ‘আরসিবিতে যোগ দেওয়ার পরই বলেছিলাম, আমি ট্রফি জিততে ভালোবাসি। দলটিতে যোগ দেওয়ার সাড়ে তিন মাস পর এটা ভেবে আনন্দিত যে প্রথম দিন যে কথা বলেছিলাম, আজ (কাল) তা পূরণ করতে পেরেছি।’

সন্তানদের সঙ্গে দুই ভাই হার্দিক ও ক্রুনাল পান্ডিয়া

ক্রুনাল পান্ডিয়াকে আলাদা করে পরিচয় না করিয়ে দিলেও চলত। তিনি ভারতের তারকা অলরাউন্ডার ও মুম্বাই ইন্ডিয়ানস অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়ার বড় ভাই।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা যেহেতু একই পরিবারে, তাই তাঁদের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের সংগ্রামের জীবনটা একই। মুম্বাইয়ের মালিক নীতা আম্বানি যেমন দুই ভাইয়ের সংগ্রামী জীবনের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ওদের যখন প্রথম দেখি, তখন একদম লিকলিকে, রোগা ও পাতলা ছিল। টাকার অভাবে ভালো খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও ছিল না। তিন বছর নুডলস খেয়ে কাটিয়েছিল...।’

তারকাখ্যাতি পাওয়ার পর হার্দিকের জীবন কত বদলে গেছে। বরোদা ও মুম্বাইয়ে প্রাসাদতুল্য বাড়ি, ব্যবহার করেন ল্যাম্বরগিনির গাড়ি, পরেন বিখ্যাত ব্র্যান্ড রিশা মিলের ঘড়ি...আরও কত কিছু! বদলে গেছে ক্রুনালের জীবনও। তবে তিনি ততটা জাহির করেন না। ভালোভাবে চলতে-ফিরতে-বাঁচতে যতটুকু লাগে...ব্যস, ততটুকুই।

দুই ভাইয়ের এই বৈপরীত্যই কি একজনকে প্রতিনিয়ত পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসছে, আরেকজনকে আড়ালেই রেখে দিচ্ছে?

ফাইনালসেরার পুরস্কার হাতে ক্রুনাল পান্ডিয়া

হয়তো তা-ই। নয়তো আইপিএল গ্রেট হয়েও ক্রুনাল এখনো অগোচরের নায়ক হয়ে আছেন কেন? যতটা মূল্যায়িত হওয়া দরকার, ততটা হচ্ছেন না কেন? পারফরম্যান্স সবকিছুর মাপকাঠি হলে নিশ্চয়ই দীর্ঘ চার বছর তাঁর জাতীয় দলের বাইরে থাকার কথা নয়।

আহমেদাবাদের ‘আইকনিক’ নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে এবারের আইপিএলে ম্যাচ হয়েছে নয়টি। ১৮ ইনিংসের ১১টিতে দলীয় স্কোর ২০০ ছুঁয়েছে, ২২০ ছাড়িয়েছে পাঁচবার। কাল ফাইনালের আগপর্যন্ত আগে ব্যাট করা সব ইনিংসেই ন্যূনতম ১৯৫ রান উঠেছে। সেই তুলনায় ফাইনালে বেঙ্গালুরুর ১৯০ রান একটু কমই মনে হতে পারে।

কিন্তু ক্রুনালের কাছে এই রানই যথেষ্ট মনে হয়েছিল। সত্যিকারের জহুরি যেমন আসল হীরা চিনতে ভুল করেন না, ক্রুনালও কালকের পিচ পড়তে ভুল করেননি। ভুল করার কথাও নয়। এই আহমেদাবাদই তো ক্রুনালের জন্মশহর। এই মাঠ আর মাঠের সব পিচ তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। সেই জানাশোনা থেকেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন।

ক্রুনাল বলকে একেবারেই বাঁক খাওয়াতে পারেন না, হাত থেকে রহস্যময় ডেলিভারিও বের হয় না। ব্যাটসম্যানের নড়াচড়া দেখে চেষ্টা করেন ভালো জায়গায় বল ফেলতে। মাঝেমধ্যে জোরের ওপর কিছু বল করেন, এটাই তাঁর শক্তির জায়গা।

কিন্তু ফাইনালের পিচ কিছুটা মন্থর হওয়ায় ক্রুনাল কাল জোরের ওপর বল করেছেন কমই। ধীরগতির পিচে বল করেছেন আরও ধীরে। তাতে পাঞ্জাব ব্যাটসম্যানরা ইতস্তত বোধ করেছেন। ক্রুনালের বোলিং ফিগারও হয়ে গেছে ‘আইকনিক’—৪ ওভারে ১৭ রান দিয়ে ২ উইকেট।

এটুকু দিয়ে আসলে ক্রুনালের ইমপ্যাক্টকে ঠিক তুলে ধরা যায় না। যদি বলা হয়, ফাইনালে তাঁর করা ২৪ বলের মধ্যে অর্ধেকই (১২টি) ডট, তাহলে মানানসই হয়। মাঝের ওভারের এই স্পেলই বিরাট কোহলি আর বেঙ্গালুরুর অধরা ট্রফি অবশেষে হাতে পাওয়া প্রায় নিশ্চিত করেছে।

ফাইনালে ১২টি ডট বল করে উপহার হিসেবে গাছ পেয়েছেন ক্রুনাল পান্ডিয়া

আর ম্যাচ শেষে যখন ফাইনালসেরার পুরস্কারটা ক্রুনালের হাতে উঠেছে, তখন তিনি অনন্য কীর্তি গড়ে ফেলেছেন। আইপিএল ইতিহাসে একাধিকবার ফাইনালসেরার স্বীকৃতি পাওয়া প্রথম ক্রিকেটার যে তিনি!

এর আগে ২০১৭ ফাইনালে বিলুপ্ত রাইজিং পুনে সুপার জায়ান্টাসের বিপক্ষে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের ১ রানে জয়ের রাতে নায়ক ছিলেন ক্রুনাল। হায়দরাবাদের লো স্কোরিং ফাইনালে ৪ ওভারে ৩১ রান দিয়ে উইকেট না পেলেও পুনে ব্যাটসম্যানদের হাত খুলে খেলার সুযোগ দেননি। এর আগে ব্যাট হাতে উপহার দিয়েছিলেন ৩৮ বলে ৪৭ রানের মহামূল্যবান ইনিংস।

তবে এবারের আইপিএলে ক্রুনালের ব্যাটিং–সামর্থ্যটা একটু ঢাকা পড়ে গেছে। আসলে তিনি ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছেন কম—১৫ ম্যাচে মাত্র সাতবার। তাতে ১৮.১৬ গড়ে ১২৬.৭৪ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ১০৯ রান।

এই মৌসুমে একবার ওপরে উঠে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েই বেঙ্গালুরুকে জিতিয়েছেন ক্রুনাল পান্ডিয়া

বলতে পারেন, রানটা কম হয়ে গেল না? অবশ্যই কম। বেশির ভাগ ম্যাচেই যে তিনি নেমেছেন ব্যাটিং অর্ডারের সাতে কিংবা আটে। তখন হাতে বল ছিল কম, শুরু থেকেই মেরে খেলার দায়িত্ব বর্তেছিল।

মাঝে একটা ম্যাচেই ওপরে উঠে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছেন। দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে সেই ম্যাচেই ৫ চার ও ৪ ছক্কায় ৪৭ বলে ৭৩ রান করে বেঙ্গালুরুকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন, হন ম্যাচসেরাও। সেদিন ক্রুনাল নেমেছিলেন পাঁচে, ২০১৭ ফাইনালেও তা–ই!

এবার আসা যাক বোলিংয়ে। যে কাজটা ক্রুনাল এই মৌসুমে সবচেয়ে ভালো করেছেন। ১৫ ম্যাচে নিয়েছেন ১৭ উইকেট, যা তাঁকে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিদের তালিকায় রেখেছে সাতে, স্পিনারদের মধ্যে চারে।

তবে অলরাউন্ডারদের মধ্যে উইকেট শিকারের সংখ্যায় তিনিই শীর্ষে। তাঁর ওপরে যাঁরা আছেন, সবাই পুরোদস্তুর বোলার। ইমপ্যাক্ট খেলোয়াড়ের নিয়ম চালুর পর বোলারদের দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠা আইপিএলে ক্রুনালের ইকোনমিও মন্দ নয়—৮.২৩, যা এই মৌসুমে কমপক্ষে ৪০ ওভার করা বোলারদের মধ্যে ষষ্ঠ সর্বনিম্ন।

এমন পারফরম্যান্সের বিশ্লেষণ করার পর কে বলবেন, এই ক্রুনাল ভারত জাতীয় দলের জার্সি সর্বশেষ গায়ে চাপিয়েছেন ২০২১ সালের জুলাইয়ে! অথচ সাদা বলের আরেক সংস্করণ ওয়ানডের আবির্ভাবেই সাড়া ফেলেছিলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫০ ছুঁয়েছিলেন ২৬ বলে, যা ছিল ওয়ানডে অভিষেকে দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড। গত মার্চে সেই রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের মুহাম্মদ আব্বাস (অভিষেকে ২৪ বলে ফিফটি)।

মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের হয়ে তিনবার আইপিএলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ক্রুনাল পান্ডিয়া

ক্রুনালকে ভারতীয় নির্বাচকদের লম্বা সময় উপেক্ষিত রাখার আরেকটি কারণ হতে পারে রবীন্দ্র জাদেজা ও অক্ষর প্যাটেলের উপস্থিতি। তাঁরা দুজনই ক্রুনালের মতো বাঁহাতি স্পিন অলরাউন্ডার। আর যা–ই হোক, স্কোয়াড তো আর বাঁহাতি অলরাউন্ডারে ভরে ফেলা যায় না।

কিন্তু গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর এই সংস্করণে ভারতের জার্সি চিরতরে তুলে রাখার ঘোষণা দিয়েছেন জাদেজা। এরপর ভারত আরও ২০টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেললেও অক্ষর খেলেছেন ১১টি (প্রায় অর্ধেক)। এরপরও ক্রুনালের কথা একবারও মনে পড়েনি নির্বাচকদের। তবে জন্মশহর আহমেদাবাদের আলোঝলমলে রাতে কাল আলোছড়ানো পারফরম্যান্সের পর ক্রুনালের ওপর নির্বাচকদের সুনজর পড়ার আশা করাই যায়।

বেঙ্গালুরুকে প্রথম ট্রফির স্বাদ পাইয়ে দিয়ে ছোট ভাই হার্দিককে ফোন করেছিলেন ক্রুনাল। কী কথা হয়েছে, জানিয়েছেন সেটাও, ‘১০ বছরে আমি ৪টি আইপিএল ট্রফি জিতলাম। হার্দিককে ফোনে বলেছি, পান্ডিয়া পরিবারে ১১ মৌসুমে এখন ৯টি ট্রফি (হার্দিক পাঁচবার আইপিএল জিতেছেন) থাকবে।’

২০২১ সালের জুলাইয়ের পর ক্রুনাল পান্ডিয়াকে আর ভারতের জার্সিতে দেখা যায়নি

ভাইয়ের সঙ্গে আবার জাতীয় দলে খেলতে চাওয়ার কথা জানিয়েছেন কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে ৫ ওয়ানডে ও ১১ টি-টোয়েন্টিতেই আটকে যাওয়া ক্রুনালের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার আবার সচল না হলে একজন আইপিএল গ্রেটকে অবমূল্যায়িত করা হবে। অজিত আগারকার (ভারতের প্রধান নির্বাচক) কি সেটা করবেন?