
‘গতি দিয়ে ওদের গুঁড়িয়ে দিতে হবে’—তিন বছর ধরে এই একটা মন্ত্রই জপছিল ইংল্যান্ড। পার্থের বাইশ গজে সেই পরিকল্পনার কী দুর্দান্ত বাস্তবায়নটাই না দেখা গেল! যা ঘটল, তা এককথায় রোমাঞ্চকর, শিহরণজাগানো।
অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের শেষ কবে এতটা নড়বড়ে আর অসহায় দেখা গেছে, মনে করা কঠিন।
ব্যাট হাতে ‘বাজবল’ দর্শনের আগ্রাসন দেখাতে গিয়ে ইংল্যান্ড নিজেরাই ধসে পড়েছিল। মিচেল স্টার্কের তোপে ছারখার হয়ে গিয়েছিল তাদের ব্যাটিং লাইনআপ। স্টার্ক একাই নিলেন ৭ উইকেট। কিন্তু কে জানত, নাটকের আসল অঙ্কটা তখনো বাকি! স্টার্কের ওই বিধ্বংসী স্পেলের জবাব দিতেই যেন ইংল্যান্ডের পাঁচ ফাস্ট বোলার আগুনের গোলা হাতে নামলেন। বিরামহীন গতির ঝড়ে অস্ট্রেলিয়ার সব প্রতিরোধ যেন নিমিষেই উড়ে গেল।
বল কখনো ব্যাটসম্যানদের মাথায় আঘাত করছে, কখনো আঙুল বা কনুই থেঁতলে দিচ্ছে। চামড়ার বলের সঙ্গে হাড়-মাংসের এই সংঘাত পার্থের মাঠে নতুন কিছু নয়। তবে চিত্রনাট্যটা এবার উল্টো। সচরাচর পার্থের বাউন্সি উইকেটে শুধু ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরাই প্রাণভয়ে কুঁকড়ে থাকেন, লুকোনোর জায়গা খোঁজেন। এবার খুঁজলেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরাও।
ইংল্যান্ডের ১৭২ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে পার্থে প্রথম দিন শেষে অস্ট্রেলিয়া ধুঁকছে ১২৩ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে। নতুন বলে ইংলিশ বোলারদের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারের মতো! এক মুহূর্তের জন্যও তারা অ্যাকসিলেটর থেকে পা সরায়নি।
পাঁচ বছরের চোট-দুঃস্বপ্ন মুছে জফরা আর্চার ফিরলেন রাজার মতো। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষিক্ত জেক ওয়েদারাল্ডকে দ্বিতীয় বলেই লেগ-স্টাম্প উপড়ানো ইয়র্কারে বিদায় করলেন। এরপর করলেন মারনাস লাবুশেনের প্রতিরোধ ভাঙার কাজটাও। আর্চারের ৯ ওভারে ১১ রানে ২ উইকেটের সঙ্গে যোগ হলো ব্রাইডন কার্সের ২ উইকেট, যার মধ্যে আছে স্টিভ স্মিথের মহামূল্যবান উইকেটটি। আর শেষটা বেন স্টোকসের ভেলকি। অন্যরা অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের ভড়কে দেওয়ার কাজটা করেছেন, সেই সুযোগে স্টোকস করে গেছেন নিজের কাজটা। পেলেন ৫ উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার দিশাহারা ব্যাটসম্যানরা যেন উইকেট উপহার দিয়ে গেলেন তাঁকে।
গ্যালারির দর্শকেরা যাকে বলে পয়সা উশুল এক দিন কাটালেন। প্রথম দিনের খেলা যখন শেষ হলো, স্কোরবোর্ডে দুই দলের ১৯ উইকেট নেই!
ইংল্যান্ডের ব্যাটিংটাও ছিল অদ্ভুতুড়ে। রান তুলেছে ওয়ানডের গতিতে (ওভারে ৫.২৩), অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নিজেদের দ্রুততম ১৫০ রানও করেছে, কিন্তু উইকেটে টিকে থাকার ধৈর্য বা নিবেদন ছিল না কারও। মাত্র ৩২ ওভারে সব শেষ। স্টোকস জমানায় এত দ্রুত তারা আর কখনো অলআউট হয়নি।
জ্যাক ক্রলি আর জো রুট ‘ডাক’ মারলেন। একপর্যায়ে মাত্র ১২ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ল তারা। চা-বিরতির এক ঘণ্টা আগেই অলআউট! অতীতে হলে ইংল্যান্ডের যেকোনো দল এই ধাক্কায় মানসিকভাবে শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এই দলের যে এমন এক বোলিং আক্রমণ আছে, যা যেকোনো পরিস্থিতিতে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে!
পার্থ স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৫১ হাজার দর্শকের মধ্যে অন্তত ছয়জন সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক ছিলেন। গ্যালারিতে বসে তাঁরা নিশ্চয়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন—ইশ্, তাঁদের সময়ে যদি অস্ট্রেলিয়ার দিকে ঘণ্টায় ১৫০ কিমি গতির গোলা ছোড়ার মতো এমন পাঁচজন বোলার থাকত!
স্টিভ স্মিথের কথাই ধরুন। আট বছর আগে এই পার্থেই সাড়ে ৯ ঘণ্টা ব্যাট করে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। তখন চা–বিরতির সময় দ্বাদশ খেলোয়াড়কে দেখা যেত তাঁর আরামের জন্য প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে আসতেন। আর এবার? দ্বাদশ খেলোয়াড় এলেন ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে! কনুই আর হাতে আঘাত পেয়ে দীর্ঘক্ষণ চিকিৎসা নিতে হলো স্মিথকে। কার্সের বলে স্লিপে ক্যাচ দেওয়ার আগে ৪৯ বল খেলেন, দেখে মনে হয়নি থিতু হতে পারবেন।
বেচারা ওয়েদারাল্ডের জন্য মায়া লাগতে পারে কারও কারও। সকালে ডেভিড ওয়ার্নারের হাত থেকে আবেগঘন পরিবেশে ‘ব্যাগি গ্রিন’ ক্যাপ পেলেন, আর ক্রিজে গিয়ে টিকলেন মাত্র দুই বল। উসমান খাজা প্লেয়িং কন্ডিশনের ফাঁদে পড়ে ওপেন করতে পারেননি, তাই নামতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু আর্চারের ইয়র্কারে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরতে হলো। গাস অ্যাটকিনসন যদিও কোনো উইকেট পাননি, তবে টানা তিনটি মেডেন নিয়ে চাপে রেখেছিলেন।
স্টিভ স্মিথ যখন ক্রিজে এলেন, গ্যালারি থেকে ভেসে এল দুয়োধ্বনি। মন্টি পানেসারকে নিয়ে অদ্ভুত মন্তব্যের জেরে ইংলিশ সমর্থকেরা তাঁকে জেঁকে ধরেছিলেন। লাবুশেন আর স্মিথ চেষ্টা করেছিলেন মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে। কিন্তু আর্চারের দ্বিতীয় স্পেল সব এলোমেলো করে দিল। লাবুশেন বোল্ড হলেন, পরের ওভারেই ফিরলেন স্মিথ। কার্সের একটা লাফিয়ে ওঠা বল খাজার গ্লাভস ছুঁয়ে চলে গেল স্মিথের হাতে। ৩৮ বছর বয়সী খাজা হয়তো এখন আর আগের মতো ক্ষিপ্র নন, কিন্তু ওই বলটা বিশ্বের যেকোনো ব্যাটসম্যানকেই আউট করার মতো!
এমন আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে হলে কলিজায় জোর লাগে। ট্রাভিস হেড আর ক্যামেরন গ্রিন গতির ঝাপটা সামলে কিছুটা থিতু হয়েছিলেন, মনে হচ্ছিল তাঁরা বুঝি খেলা ধরে ফেলবেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, আলসে শট খেলে দুজনই ডুবলেন। মার্ক উডের ঘণ্টায় ১৫২ কিমি গতির বাউন্সার গ্রিনের হেলমেটের গ্রিলে আঘাত করার পর তাঁর মাথা যেন ভোঁ-ভোঁ করছিল, সেই রেশ কাটতে না কাটতেই খোঁচা দিয়ে বসলেন। স্টার্ক আর অ্যালেক্স ক্যারি প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বাজে শটে বাউন্ডারি লাইনে ধরা পড়লেন। আর স্কট বোল্যান্ডকে শূন্য রানে ফিরিয়ে স্টোকস পূর্ণ করলেন তাঁর ৫ উইকেট।
মিচেল স্টার্কের জন্যও খারাপ লাগতে পারে। ১০ রানে ৩ উইকেট থেকে ৫৮ রানে ৭ উইকেট—অ্যাশেজের অন্যতম সেরা ওপেনিং স্পেল করলেন, উইকেটের সেঞ্চুরিও পূর্ণ হলো। ঘাসে ঢাকা উইকেটে বল গ্রিপ করছিল, সুইংয়ের চেয়ে তাঁর সিম মুভমেন্টই বেশি ভুগিয়েছে ব্যাটসম্যানদের। ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরাও অবশ্য বাজে শট খেলে নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছেন। হ্যারি ব্রুকের ফিফটি বা ওলি পোপের ৪৬ রান ছাড়া বলার মতো কিছু নেই।
তবে দিনশেষে একটা পার্থক্য খুব স্পষ্ট—অস্ট্রেলিয়া ছিল ‘ওয়ান ম্যান ব্যান্ড’, একা স্টার্কই যা লড়লেন। আর ইংল্যান্ড? তারা বাজাল নিখুঁত এক অর্কেস্ট্রা, যেখানে সব যন্ত্রই সুর তুলেছে সমান তালে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ৩২.৫ ওভারে ১৭২ ( পোপ ৪৬, ব্রুক ৫২; স্টার্ক ৭/৫৮, ডগেট ২/২৭)
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস: ৩৯ ওভারে ১২৩/৯ ( ক্যারি ২৬, গ্রিন ২৪, হেড ২১; স্টোকস ৫/২৩, আর্চার ২/১১)—প্রথম দিন শেষে।