
অ্যাশেজের মানে আর যা-ই হোক, বন্ধুত্ব নয়। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড দুই দলের জন্যই এটি মর্যাদার লড়াই। অ্যাশেজ তাই দুই দলকে যতটা না কাছাকাছি আনে, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতামুখর মানসিকতার কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি দূরে ঠেলে দেয়।
তবে এবারের অ্যাশেজের মাঝপথে দুই দলই একটা জায়গায় হাত মিলিয়েছে—স্নিকোমিটারে অবিশ্বাস। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কেউই স্নিকোর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। দুই দলই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চায়।
স্নিকোয় কী সমস্যা বোঝার আগে এটি আসলে কী, সেটা মাথায় রাখা ভালো। ক্রিকেটে ডিসিশন রিভিউ সিস্টেমে (ডিআরএস) যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, স্নিকো তার একটি। সুনির্দিষ্ট করে বললে, স্নিকো হচ্ছে ছবি ও শব্দের সাহায্যে প্রান্ত শনাক্তকরণ (এজ ডিটেকশন) প্রযুক্তি। এটির মাধ্যমে দেখা হয় বল বা ব্যাট কোন মুহূর্তে কিসের সংস্পর্শে এসেছে। যেহেতু বল ও ব্যাটের সংস্পর্শের মাধ্যমে আউট হওয়া (ক্যাচ) ও না হওয়া (এলবিডব্লু) নির্ভর করে, তৃতীয় আম্পায়ার এ দুটির সংযোগ দেখার চেষ্টা করেন।
তবে বিষয়টি নিশ্চিত খুব সহজ নয়। কারণ, ছবির পাশাপাশি শব্দও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কোনোটি ঠিকঠাক কাজ না করলে সঠিক ফল পাওয়া যায় না। পুরো বিষয়টা বেশ সূক্ষ্মই বলা চলে।
এই স্নিকোর ব্যবহার নিয়ে চলমান অ্যাডিলেড টেস্টের প্রথম দুই দিনই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। প্রথম দিনে অস্ট্রেলিয়ার অ্যালেক্স ক্যারি আর দ্বিতীয় দিন ইংল্যান্ডের জেমি স্মিথকে নিয়ে দুটি সিদ্ধান্ত ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে।
কাকতালীয়ভাবে তিনটি ঘটনাতেই ইংল্যান্ডের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান স্মিথের নাম আছে। বুধবার টেস্টের প্রথম দিনে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ৭২ রানে থাকা ক্যারি উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন। আম্পায়ার আউট না দিলে ইংল্যান্ড রিভিউ নেয়। স্নিকোতে দেখা যায়, বল ক্যারির ব্যাট ঘেঁষে যাওয়ার সময় স্নিকোয় স্পাইক নেই। যে স্পাইক আছে, সেটা বল ব্যাটের কাছে যাওয়ার দুই ফ্রেম আগে। আইসিসির বিধি অনুসারে, এক ফ্রেম পর্যন্ত স্পাইকের বিচ্যুতি আম্পায়ার আমলে নিতে পারেন। দুই ফ্রেম হলে বল ব্যাটে লাগেনি বলে বিবেচিত হয়।
তৃতীয় আম্পায়ার তাই ক্যারিকে আউট দেননি। তবে দিনের খেলা শেষে ক্যারি জানান, বল তাঁর ব্যাটে লেগেছে বলে মনে হয়েছে। আউট হওয়া থেকে বেঁচে ১০৬ রান করা ক্যারি নিজেকে সৌভাগ্যবানও দাবি করেন। এরপর স্নিকোর প্রতিষ্ঠাতা ওয়ারেন ব্যারেন নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে জানান, স্নিকো অপারেটর ভুল করেছিলেন। যে স্টাম্প মাইক থেকে শব্দ নেওয়ার কথা ছিল, সেখান থেকে না নেওয়ায় স্নিকোর ফলে সঠিকটা উঠে আসেনি।
বৃহস্পতিবার ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে প্যাট কামিন্সের বলে স্লিপে স্মিথের ক্যাচ নেন উসমান খাজা। মাঠের আম্পায়ার নীতিন মেনন টিভি আম্পায়ার ক্রিস গ্যাফানির সাহায্য চাইলে তিনি নটআউট দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় অস্ট্রেলিয়া। স্নিকোয় দেখা যায়, বল স্মিথের হেলমেটে লেগে স্লিপে গেছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানদের বিশ্বাস ছিল গ্লাভসে লেগেছে। ২ ওভার পর ওই কামিন্সের বলে স্মিথের বিপক্ষে আবার ক্যাচের আবেদন ওঠে। এবারও আম্পায়ার মেনন তৃতীয় আম্পায়ারের কাছে সিদ্ধান্তের জন্য পাঠান।
গ্যাফানি স্নিকোয় দেখেন, বল ব্যাট পেরিয়ে যাওয়ার পরের ফ্রেমে স্পাইক দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় আম্পায়ার আউট দিলে এবার ক্ষুব্ধ হন স্মিথ, নন–স্ট্রাইকে থাকা ইংল্যান্ড অধিনায়ক বেন স্টোকসকেও অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
প্রথম দিন ক্যারির আউটে ভুল হওয়ার পর ক্ষুব্ধ ইংল্যান্ড দল ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রোর কাছে অভিযোগ নিয়ে যায়। বিষয়টি আমলে নিয়ে ক্রো ইংল্যান্ডের একটি রিভিউ আজ সকালে পুনর্বহাল করেন। দিনের খেলা শুরুর আগে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী টড গ্রিনবার্গ এসইএন রেডিওকে বলেন, স্নিকোর কার্যকারিতায় তাঁরা খুশি নন, ‘এটা যথেষ্ট ভালো বলে আমরা মনে করি না। আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে, এমন কিছু যেন আবার না ঘটে।’
এই স্নিকো জিনিসটাকে ছুড়ে ফেলো। ফালতু।সাবেক ইংলিশ স্পিনার গ্রায়েম সোয়ান
কিন্তু গ্রিনবার্গের কথাকে ‘উপহাস’ করে কয়েক ঘণ্টা পরই স্মিথের ঘটনায় একাধিকবার স্নিকোর সীমাবদ্ধতা ধরা পড়েছে। খাজার ক্যাচে স্মিথকে আউট না দেওয়ার পর তো তাৎক্ষণিকভাবে মাঠেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন মিচেল স্টার্ক। অস্ট্রেলিয়ার বাঁহাতি পেসারকে তখন স্টাম্প মাইকে বলতে শোনা যায়, ‘স্নিকো বাদ দেওয়া দরকার। খুব বাজে প্রযুক্তি।’ আগের দিনের ক্যারির নটআউটের প্রসঙ্গে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘(স্নিকো) গতকালও ভুল করেছে, আজও ভুল করল।’
কিছুক্ষণ পর স্মিথকে যখন ওই স্নিকোমিটার দেখেই আউট দেওয়া হয়, ইংলিশ এই ব্যাটসম্যান তখন বিরক্তি প্রকাশ করেন।
স্মিথের আউটের পর সাবেক ইংলিশ স্পিনার গ্রায়েম সোয়ান টিএনটি স্পোর্টস লাইভে বলেন, ‘এই স্নিকো জিনিসটাকে ছুড়ে ফেলো। ফালতু।’ ইংল্যান্ডের আরেক সাবেক ক্রিকেটার অ্যালেক্স হার্টলিও টেস্ট ম্যাচ স্পেশালে প্রায় একই কথা বলেন, ‘স্নিকো বাদ দেওয়া দরকার। স্মিথ নিশ্চিত ছিল বল তার ব্যাটে লাগেনি। অস্ট্রেলিয়া জোরেশোরে আবেদন করেছে। কারণ, সবাই জানে যে এখন আর স্নিকোকে বিশ্বাস করা যায় না। তাই তারা সবকিছুর জন্যই আবেদন করছে, দরকারে রিভিউ নিচ্ছে।’
স্নিকো নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন অস্ট্রেলিয়ানরাও। সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিং যেমন বলেছেন, ‘আমরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, সেটা অন্য দেশে ব্যবহার করা প্রযুক্তির মতো ভালো নয়। তৃতীয় আম্পায়ার বসে থেকে প্রযুক্তি তাঁকে যা দিচ্ছে, তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অনেক সময় তৃতীয় আম্পায়ারকে সাহস করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এটা হতে পারে না। যে প্রযুক্তিটা আছে, সেটা আস্থা রাখার মতো হতে হবে।’ সাবেক অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার সাইমন টফেলও স্নিকোর সীমাবদ্ধতা নিয়ে পরোক্ষে প্রশ্ন তুলেছেন। চ্যানেল সেভেনকে তিনি বলেছেন, ‘প্রযুক্তির কাজ আম্পায়ারের কাজে সহায়তা করা, আম্পায়ারের বিকল্প হওয়া নয়। আমাদের ২০ বছর পেছনে ফিরতে হবে, যেখানে প্রযুক্তির ওপর সন্দেহ থাকত। ব্যাটিং দল সব সময় একটা সুবিধা পেত। আমি চাই, আম্পায়ারদের সফট সিগন্যাল ব্যবস্থা ফিরে আসুক।’
স্নিকোর বিকল্প আছে। এজ ডিটেকশনের জন্য আলট্রা এজও ব্যবহার করা হয়। ইংল্যান্ড তো ২০১৬ সাল থেকে স্নিকোমিটারই ব্যবহার করে না। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন আলট্রা এজই ব্যবহার করে। তবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে স্নিকোই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
স্নিকো এবং হকআই কোম্পানির আলট্রা এজ—এ দুটোই আইসিসি অনুমোদিত। কোনটি ব্যবহৃত হবে, এ সিদ্ধান্ত সম্প্রচারকের। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এবারের অ্যাশেজ সম্প্রচারে চুক্তিবদ্ধ ফক্স স্পোর্টস। তারাই প্রযুক্তি সহায়তার জন্য স্নিকোমিটারকে নিযুক্ত করেছে। স্নিকো ব্যবহারে খরচও আলট্রা এজের চেয়ে কম।
তবে এবারের অ্যাশেজে স্নিকো নিয়ে যে পরিমাণ বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তাতে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তির দ্বারস্থ হয় কি না, সন্দেহ। বিশ্বাস উঠে গেলে যা হয় আরকি!