
রশিদ খান। নাহ্, আফগান লেগ স্পিনার রশিদ খান নন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং আর অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের কথা শুনে মনে পড়ে গেল শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী রশিদ খানের কয়েকটি কথা। প্রয়াত ওস্তাদ রশিদ খান কথাগুলো এই প্রতিবেদককেই একবার বলেছিলেন বৈঠকি ঢঙে দেওয়া সাক্ষাৎকারে।
শচীন টেন্ডুলকারের পাঁড় ভক্ত রশিদ খান শৈশবে ক্রিকেটার হওয়ারই স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর মামা নিসার হুসেইন খান তাঁকে সে পথে হাঁটতে দেননি। একপ্রকার জোর করেই নিজেদের গড়া সংগীতরাজ্যে ঢুকিয়ে দেন রশিদ খানকে। শাস্ত্রীয় সংগীতের বড় সংগীতকার হয়েও রশিদ খান ক্রিকেটকে অন্তর থেকে মুছে ফেলতে পারেননি; বরং তিনি ক্রিকেট আর সংগীতকে দেখেছেন একই রূপে!
যে সাক্ষাৎকারের কথা বলা হলো, সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটটা সংগীতের মতোই। একেকটা কাভার ড্রাইভ, পুল, হুক—এগুলো তো সংগীতের বিভিন্ন ধারার মতোই রেশমি পরশ নিয়ে এগিয়ে চলে।’ সংগীত আর ক্রিকেটকে এক বিন্দুতে মেলানোর আলোচনায় তিনি আরেকটি বেশ মজার উদাহরণ টেনেছিলেন, ‘দেখুন, এটা অনেকটা গানের মতোই। একটি গানের তিনটি ভাগ যদি আপনি করেন, কী আছে সেখানে? আভোগ, অন্তরা, স্থায়ী।’
আভোগ মানে গানের শুরুর কথা। আভোগ ভালো হলে যেকোনো গানই শ্রোতা টানতে পারে। এরপর শ্রোতাকে মোহাচ্ছন্ন করতে অন্তরাটা, মানে মাঝের অংশটা জুতসই হওয়া চাই। আর শ্রোতার হৃদয়ে দাগ কাটতে চাই দারুণ একটা স্থায়ী, মানে শেষটা সুন্দর হলেই কারও হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেওয়া সম্ভব। রশিদ খান আসলে এটাই বলতে চেয়েছেন। সেদিক থেকে তো গান আর ক্রিকেট একই সুরে বাঁধা!
এবার আসা যাক, মিরাজের কথায়। বাংলাদেশ অধিনায়ক কী এমন বলেছেন যে রশিদ খানের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল? একই সঙ্গে চলে এল গানের তিনটি ভাগের বিষয়? কথাগুলোর সূত্র ধরে মনে পড়ে গেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’। সেখানে শুরুর দিকের একটি জায়গায় আছে, ‘ছেলেবেলায় এক বোষ্টমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল/ শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে।’ সুনীলের কবিতায় সেই বোষ্টমী আর অন্তরাটুকু শোনাতে আসেনি!
মিরাজও আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচ থেকে একটা ভালো ‘গান’(পড়ুন পারফরম্যান্স) উপহার দিতে কখনো ভালো একটা আভোগের আশ্বাস দিয়েছেন, কখনো আবার ভালো অন্তরা বা স্থায়ী শোনানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। সুনীলের কবিতার সেই বোষ্টমীর সঙ্গে বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের পার্থক্য একটাই—বোষ্টমী আর ফিরে আসেনি, কিন্তু বাংলাদেশ দল সিরিজে তিনবার মাঠে ফিরেও ভালো একটা অন্তরা বা স্থায়ী উপহার দিতে পারেননি!
আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে শুরুটা মোটেই ভালো ছিল না বাংলাদেশের। ১৮ রানে প্রথম, ২৫ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারানো বাংলাদেশ মিডল অর্ডারে মোটামুটি প্রতিরোধ গড়ার পর শেষের দিকে আবার ভেঙে পড়ে। শেষ পর্যন্ত অলআউট হয় ২২১ রানে। ‘আভোগে’ (পড়ুন প্রথম ম্যাচ) ৫ উইকেটে হারের পর মিরাজ অন্তরা আর স্থায়ীতে ভালো কিছু করার আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা সব সময়ই প্রথম ১৫ ওভারে বেশি উইকেট হারাই...শেষের দিকে জুটি গড়তে পারছি না। আমি নিশ্চিত, পরের ম্যাচে ছেলেরা ভালো করবে।’
কিন্তু মিরাজরা কথা রাখেননি বা রাখতে পারেননি। দ্বিতীয় ম্যাচে বোলাররা ছিলেন দুর্দান্ত। আফগানিস্তানকে ১৯০ রানে অলআউট করে দেয় বাংলাদেশ। কিন্তু মিরাজের ব্যাটিং লাইনআপ না দিতে পেরেছে একটি ভালো আভোগ, না একটি ভালো অন্তরা। সেটা পারলে কি আর ১৯১ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ১০৯ রানে অলআউট হয় দল। আহারে বেচারা শ্রোতার (পড়ুন সমর্থকের) দল, ‘মিথ্যা’ প্রতিশ্রুতির মায়ায় আর কত কত বছর না যেন কাটাতে হয়!
মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। কেউ কউ আবার স্বপ্ন দেখাতেও ভালোবাসেন। স্থায়ীতে (পড়ুন শেষ ওয়ানডে) মিরাজও আবার বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের স্বপ্ন দেখাতে চাইলেন। সুনীলের কবিতার সেই বোষ্টমীর মতো এবারও ভালো একটা অন্তরা শোনানোর (পড়ুন মাঝের ওভারে ভালো ব্যাটিংয়ের) প্রতিশ্রুতি দিলেন, ‘আমাদের এখনো একটি ম্যাচ বাকি আছে...আমাদের ব্যাটিংয়ের উন্নতি করতে হবে।’
মিরাজের এই প্রতিশ্রুতি যে শুধুই মায়াবী এক বিভ্রম, সে তো গতকাল রাতে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে দেখে সবাই বুঝেই ফেলেছেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে আফগানিস্তানের কাছে সবচেয়ে বেশি ২০০ রানের হারের রেকর্ড হলো!
মিরাজ এরপর কী বলবেন, সেটা অনেকটা অনুমিত ছিল। সবার দেওয়া প্রতিশ্রুতি যখন একে একে মিথ্যে হয়ে যাচ্ছিল, অন্যদের সব চাওয়া পূরণ হচ্ছিল, আর নিজেরা কিছুই পাচ্ছিল না; সুনীলের কবিতার মূল চরিত্রের বাবা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখিস, একদিন, আমরাও...।’ আমাদের বেলায় এখন কী হলো—আফগানিস্তান ৩-০–তে ওয়ানডে সিরিজ জিতে নিল, আগামী ওয়ানডে বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার সম্ভাবনা ঝুঁকিতে পড়ল। এমন অবস্থায় আমাদের ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মিরাজও সুনীলের কবিতার মতো সেই সুদিনের স্বপ্ন দেখালেন, ‘আমাদের টপ অর্ডার আর মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ে ভালো করতে হবে। হ্যাঁ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ আছে...কীভাবে ভালো করা যায়, দেখব।’
সুনীল তাঁর কবিতায় ‘বাবার’ দেওয়া আশ্বাসের শেষটা করেছিলেন ‘...’ দিয়ে। কে জানে, কেন এটা তিনি করেছেন! হয়তো ওই আশ্বাসও কখনো পূরণ হবে না বলেই। মিরাজের দেওয়া আশ্বাসের শেষটাতেও কি আমরা ‘...’ রেখে দেব! আমাদের কারোই হয়তো জানা নেই, মিরাজরা কবে আমাদের ভালো একটা আভোগ, জুতসই অন্তরা আর দারুণ একটা স্থায়ী সমৃদ্ধ সুন্দর ‘গান’ উপহার দেবেন। আর কবেই–বা ‘একদিন আমরাও দেখব’ এবং সেটা কোনো ‘...’ ছাড়া!