
হায়দরাবাদের তাজ কৃষ্ণা হোটেলের লবিতে গিজগিজে ভিড়। সেই ভিড়ে হঠাৎই একটা হুড়োহুড়ি। কারণ, ভারতীয় দলের বাস এসে হোটেলের সামনে থেমেছে। ক্রিকেটাররা একে একে ঢুকছেন আর ছুটে যাচ্ছেন সেলফি–শিকারিরা। সবচেয়ে বড় ভিড়টা কাকে ঘিরে, তা অনুমান করতে পারার জন্য কোনো পুরস্কার নেই। অবশ্যই বিরাট কোহলি।
ভারতের মাটিতে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলছে। সেই টেস্টের দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। কোহলি ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন, ইতিহাস গড়া ডাবল সেঞ্চুরি। তাঁকে ঘিরে মৌমাছির মতো ভিড় আর সেলফি তোলা নিয়ে মা–মেয়ের মধ্যে রীতিমতো ঝগড়া লেগে যাওয়ার কারণ অবশ্যই ওই ডাবল সেঞ্চুরি নয়। কোহলি শূন্য রানে আউট হলেও অমনই হতো। ভারতীয় ক্রিকেটাররা সবাই তারকা হতে পারেন, কিন্তু বিরাট কোহলি তখন তারকাকুলে বৃহস্পতি।
‘তখন’ বলছি কেন, আরও আগে থেকেই তো তা–ই। সেটি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করার পরও। নভজোৎ সিং সিধু তো বিদায়বাণীতে তাঁকে ‘ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার’ই বলে ফেলেছেন। গ্রেগ চ্যাপেল ‘সেরা’র লাইনে না গিয়ে বলছেন ‘ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্রিকেটার’। আগে থেকেই খবরটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরও বিরাট কোহলির টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এমনই আলোড়ন তুলেছে যে ক্রিকেট–বিশ্বের সব প্রান্তেই ছড়িয়ে পড়েছে সেটির অনুরণন। কোহলির হাতে বিদায়–অর্ঘ্য তুলে দেওয়ার একটা প্রতিযোগিতাই শুরু হয়ে গেছে।
সেটিই স্বাভাবিক। তবে লেখার শুরুতেই ২০১৭ সালের হায়দরাবাদে ফিরে যাওয়াটা কারও কাছে একটু অস্বাভাবিক মনে হতেই পারে। সেই ব্যাখ্যা দিতে তাজ কৃষ্ণা হোটেলের লবি থেকে লিফটে ঢুকতে হবে। লিফটে ভারতীয় ক্রিকেটারদের গাদাগাদি ভিড়। আগে ঢুকে যাওয়ায় স্থান হয়েছে এই লেখকেরও। কোহলি ঠিক সামনেই। ‘অভিনন্দন’ জানাতেই ‘ধন্যবাদ’ বলে জবাব দিয়েছেন। অভিনন্দনটাকে শুধু ডাবল সেঞ্চুরির জন্যই ধরে নিলেন কি না, সন্দেহ হওয়াতেই প্রশ্নটা করা—আজ যে আপনি ডন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন, তা কি জানেন? আরেকটা উদ্দেশ্যও ছিল। এক লাইনের হলেও একটা ‘কোট’ যদি পাওয়া যায়। কোহলির কি আর না জানার কথা, মাঠে কেউ না কেউ তাঁকে অবশ্যই বলেছেন। কী আশ্চর্য, কোহলি নাকি জানতেন না। আগ্রহ নিয়ে বরং জানতে চাইলেন, এখানে ব্র্যাডম্যান কীভাবে আসছেন। জানার পর স্মিত হাসি আর আরেক দফা ‘ধন্যবাদ’–এর বেশি অবশ্য কিছু পাওয়া গেল না।
তা ব্র্যাডম্যানকে পেছনে ফেলে দেওয়া সেই রেকর্ডটা কী? টানা চার টেস্ট সিরিজে ডাবল সেঞ্চুরি। টানা তিন সিরিজে ব্র্যাডম্যান ডাবল সেঞ্চুরি করার ৭৩ বছর পর এই রেকর্ড ছুঁয়েছিলেন ভারতেরই রাহুল দ্রাবিড়। দুজনকেই পেছনে ফেলে বিরাট কোহলি সেদিনই চারে চার করে ফেলেছেন। সেই সময়টাতে কোহলি রীতিমতো অবিশ্বাস্য। তাঁর ব্যাটিং দেখলে মনে হয় যেন অটো–পাইলটে প্লেন চলছে। বোলার কে, ফিল্ড প্লেসিং কী—এসবে কিচ্ছু আসে যায় না। গন্তব্যে পৌঁছা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সেই গন্তব্য মানে সেঞ্চুরি। তা এমনই ডালভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে শচীন টেন্ডুলকারের ১০০ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে দেওয়াটা অবধারিত বলে মনে হচ্ছে। কদিন পরই শুরু হতে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া সিরিজে আরেকটি ডাবল সেঞ্চুরি করে পাঁচে–পাঁচ করে ফেলাও। সেদিন কোহলিকে নিয়ে লেখায় অবলীলায় তাই সেই ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলেছিলাম। যা পড়ার সময় কারও ভ্রু কুঁচকে গেছে বলে শুনিনি।
সেই ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি। ‘ল অব অ্যাভারেজ’–এর সূত্র সত্যি প্রমাণ করে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন টেস্টের পাঁচ ইনিংসে কোহলির সর্বোচ্চ ইনিংস মাত্র ১৫ রানের। সেটি যে নিছকই দুর্ঘটনা, তার প্রমাণ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরের সিরিজেই টানা দুই টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি। সেই সময়ের কোহলি প্রশ্নাতীতভাবে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চার বছর টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ৭৫.৯৩, ৭৫.৬৪, ৫৫.০৮ ও ৬৮। ওয়ানডেতে যা আরও অবিশ্বাস্য। যে বছর সবচেয়ে ‘খারাপ’ করেছেন, সেই ২০১৯ সালেও তা ৫৯.৮৬। এর আগের বছরেই যা চোখ কপালে তুলে দেওয়া ১৩৩.৫৫! বাকি দুই বছর রান করেছেন ৯২.৩৭ ও ৭৬.৮৪ গড়ে। টি–টোয়েন্টিতেও একই রকম অপ্রতিরোধ্য। ২০১৬ সালে গড় ১০৬.৮৩! সে বছরই টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় কপিল দেবের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। কপিল দেবদের প্রজন্ম তাঁদের দেখা সেরা ব্যাটসম্যানের কথা উঠলে সব সময় ভিভ রিচার্ডসকে সবার ওপরে রেখে তারপর বাকিদের নিয়ে আলোচনা শুরু করে এসেছেন। অথচ চমকে দিয়ে কপিল দেব বললেন, আর তিন বছর এমন খেললে তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন, তাঁর দেখা সেরা ব্যাটসম্যানের নাম বিরাট কোহলি। এটা শুনলে ভিভ রিচার্ডসের মাইন্ড করার কোনো কারণ নেই। কারণ, ভিভ নিজেও অনেক দিনই কপিল ভাবাপন্ন। কোহলির মধ্যে দেখতে শুরু করেছেন নিজেকে।
কপিল দেবের দেওয়া ’আগামী তিন বছরের’ শর্ত ঠিকই পূরণ করেছেন বিরাট কোহলি। যদিও পরে আর তাঁকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি, ভিভ রিচার্ডসই এখনো তাঁর এক নম্বর কি না। গত কয়েক বছরে অবশ্যই কিছুটা ম্লান হয়ে এসেছে বিরাট–মহিমা। টি–টোয়েন্টি আগেই ছেড়েছেন, পারফরম্যান্স বিবেচনায় টেস্ট ক্রিকেটও ছেড়ে দেওয়ায় সেভাবে বিস্ময়ের কিছু নেই। গত পাঁচ বছরে মাত্র একটাই সেঞ্চুরি। ’কোহলি শেষ’—এই রবও উঠেছে অনেকবারই। ওয়ানডে–ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ইঙ্গিত না দিলেও মনে হয়তো আছে ২০২৭ বিশ্বকাপ। তারপরও শচীন টেন্ডুলকারের ১০০ সেঞ্চুরির রেকর্ড যে নিরাপদেই আছে, নিশ্চিন্তেই তা বলে দেওয়া যায়। ৮২ থেকে ১০০ যে অনেক দূরের পথ।
অনেক দিনই নিজের ছায়া হয়ে থাকার পরও তাঁর টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণায় যে শূন্যতার অনুভব, সিদ্ধান্তটা বদলানোর জন্য সাত সাগর তেরো নদীর ওপার থেকে ব্রায়ান লারার অনুনয়—এর একটাই কারণ। আইপিএল যুগের ক্রিকেটার হয়েও, সম্ভবত ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান হওয়ার পরও বিরাট কোহলি ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটের সত্যিকার এক দূত। মনপ্রাণ দিয়ে শুধু তা খেলেনইনি, এর মহিমার কথাও সুযোগ পেলেই প্রচার করে গেছেন।
রঙিন পোশাকে আরও কিছুদিন থাকছেন ক্রিকেট মাঠে, কিন্তু শ্বেতশুভ্র পোশাকের বিরাট কোহলি এখন থেকে থাকবেন শুধুই টেলিভিশনে দেখানো পুরোনো খেলায় আর ইউটিউবে। একটু শূন্য শূন্য তো লাগছেই!