Thank you for trying Sticky AMP!!

কীভাবে হারিয়ে গেল আবাহনী-মোহামেডান লড়াই

দর্শকভরা গ্যালারি, উত্তেজনায় থরো থরো। আবাহনী–মোহামেডানের সেই লড়াই হারিয়ে গেছে। ছবি: সংগৃহীত
আবাহনী-মোহামেডানের লড়াই কীভাবে যেন হারিয়ে গেল এ দেশের মানুষের মানসপট থেকে!


বাংলাদেশের ফুটবল নস্টালজিয়ায় ডুবে আছে বহু বছর ধরে। আহা, একসময় কী এক দ্বৈরথ ছিল দুই প্রধানের! আবাহনী-মোহামেডান লড়াই নিয়ে আজও চলে নিরন্তর নস্টালজিয়া। ফুটবলার, সংগঠকসহ এই অঙ্গনের সবাই অতীত স্মৃতি তুলে আনেন। একটা সময় দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত গোটা দেশ। বিকেল ৫টায় খেলা হলে বেলা ১১টাতেই ভরে যেত স্টেডিয়াম। দুই দলের পতাকায় ছেয়ে যেত গোটা শহর, দুই দলের সমর্থন নিয়ে মারামারি ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আজ তা কোথায় হারিয়ে গেল!


এর উত্তর সবারই জানা। লোকে বলে, এখন বিনোদনের এত উপকরণ হাতের কাছে। তাই আর আবাহনী-মোহামেডান টানে না। বাংলাদেশের ফুটবল অনুরাগীরা ইউরোপের ফুটবল দেখেন নিয়মিত। কিন্তু কেন দেখেন? একটা উত্তর তৈরিই থাকে, ‘আরে ভাই, স্যাটেলাইটের যুগে যেখানে রিমোট টিপেই ইউরোপের শীর্ষ সব লিগের খেলা দেখা যায়, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসিরা যেখানে বাসার ড্রয়িংরুমের স্থায়ী বাসিন্দা, সেখানে কার এত দায় পড়েছে যানজট, জলজট আর গণপরিবহনের অপ্রতুলতার এই শহরে মাঠে গিয়ে আবাহনী-মোহামেডানের খেলা দেখবেন! আগে স্যাটেলাইট টিভি ছিল না, ফুটবলপ্রেমীরা আধুনিক, উন্নত ফুটবল দেখার সুযোগ পেতেন কালেভদ্রে। নির্দিষ্ট করে বললে চার বছর পরপর বিশ্বকাপের সময়। তাই ভিড় জমাতেন আবাহনী-মোহামেডানের লড়াইয়ে, একটু রক্ত গরম করা বিনোদনের আশায়। একটু রোমাঞ্চিত হওয়ার আশায়। এখন রোমাঞ্চের তো অভাব নেই।’

কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন আসে, তাহলে কলকাতায় ফুটবল আজও এত দর্শকপ্রিয় কেন? কলকাতার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বৈরথ নিয়ে সেখানে উত্তেজনা আর রোমাঞ্চের কথা তো এখনো পত্রিকার পাতাজুড়ে আসে। স্যাটেলাইট টিভি কি কলকাতায় নেই? আছে, কিন্তু ওখানে ফুটবল সংস্কৃতিটা আজ অটুট। যেটি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রায়ই বিশাল কলকাতা নগর মিশে যায় এক কেন্দ্রে। বলিউডের কোনো ছবি নিয়ে নয়, এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো রাজনৈতিক মহাসমাবেশ নয়। ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের ঐতিহ্যের লড়াই উদ্বেলিত করে কলকাতার নাগরিকদের। তাঁরা রোমাঞ্চিত হন, আত্মার আকর্ষণ বোধ করেন এই ম্যাচ ঘিরে।

সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দশকে আবাহনী-মোহামেডান ‘ঢাকা ডার্বি’ আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকত। এ দুই ক্লাবের লড়াই দুই ভাগ করে দিত গোটা দেশকে। মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় সারা দিন চলত উত্তেজনা। বাড়ির কর্তা বিকেলে আবাহনী-মোহামেডানের লড়াইয়ে ‘গন্ডগোল’ বাধতে পারে বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতেন। ৪০ থেকে ৫০ হাজার দর্শকের গগনবিদারী চিৎকার রোমাঞ্চ ছড়িয়ে দিত পুরো দেশে। ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া বাধত, বন্ধুতে বন্ধুতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যেত। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে একসময়। কিন্তু মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে সেই উত্তেজনা এখন শুধুই অতীতের গল্প।

যে দেশের মানুষ ফুটবল ভালোবাসে, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, রিয়াল-বার্সা নিয়ে ভাগ হয়ে যায়, সেই দেশে আজ আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ কেন উদ্বেলিত করে না? এর দায় ক্লাব দুটিকেও নিতে হবে। কারণ, দুটি ক্লাবই এখন উদাসীন। ঐতিহ্যের লড়াই তাদেরও আর নাড়া দেয় না। তাই গত দুই দশকে এ লড়াই কীভাবে আবেদন হারিয়েছে, সেই গবেষণার দুই প্রধানের উদাসীনতার বিষয়টিও আসবে। এ দুটি ক্লাবের কর্তাদেরই আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে ঐতিহ্য বা নস্টালজিয়া নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। দু–চারজন বাদে বাকিরা ম্যাচটা দেখতেও আসেন না। এমনকি কোনো কোনো কর্মকর্তা ম্যাচের খবর রাখেন বলেও মনে করা কঠিন। সমর্থকদের মাঠে আসার ডাক নেই ক্লাবের পক্ষ থেকে। চারপাশ কেমন যেন নীরব। আর দশটা দিনের মতো এই ম্যাচটাও নীরবে খেলে ক্লাবে ফিরতে চায় দুই ক্লাব।

সত্তর-আশি বা নব্বইয়ের দশকে যারা আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে উত্তেজিত হতেন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে দলে টানার কোনো পরিকল্পনা কি আবাহনী-মোহামেডান নিয়েছে? নেয়নি, নিলে আজ এই খাঁ খাঁ অবস্থা হতো না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুই ক্লাব কী নিজেদের বাজারজাত করেছে? করেনি।


বর্তমান সময়ে ক্লাব সংস্কৃতির মূল বিষয়ই হচ্ছে ক্লাবের জার্সি, মাফলার, চাবির রিংসহ নানা ধরনের পণ্যের বিপণন। ইউরোপের ক্লাবগুলোর এত দর্শকপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে এই পণ্য বিপণন। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনো বালাই নেই। আবাহনী-মোহামেডান কখনোভাবেইনি এগুলো করা উচিত। প্রতিবছর একটা দল বানিয়ে খেলতে হবে বলেই যেন খেলা। এর বাইরে আর কিছু নেই। নিজেদের সাজিয়ে-গুছিয়ে দর্শকদের সামনে তুলে ধরার কোনো ইচ্ছাই নেই দুই প্রধানেরই।

কর্মকর্তারা নতুন প্রজন্মকে আবাহনী-মোহামেডান চেনাননি। ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য যে উদ্যোগ নিতে হয়, সেটি তাঁদের মগজেই নেই। তাঁরা নিজেদের সমর্থকদের ওপর কোনো জরিপ চালিয়ে দেখেনি যে কেন আজ এত ভাটার টান। সামাজিক যোগাযোগের যুগে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টুইটারে আবাহনী-মোহামেডানের কোনো কর্মকাণ্ড আপনার চোখে পড়ে? নিশ্চিত বলা যায়, ‘না’। নিদেনপক্ষে দুই প্রধানের অতীত লড়াইয়ের একটা ভিডিও কি আপনি পাবেন? এবারও উত্তর, ‘না’।

আজ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে আবাহনী-মোহামেডানের আরও একটি লড়াই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। ম্যাচ শুরু সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়। আসুন না, আবাহনী-মোহামেডান লড়াইয়ে আকর্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে আমরা মাঠমুখী হই।