
সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ!
‘হৈমন্তী’ গল্পের চরিত্র অপুর হয়েছিল এমন আত্মোপলব্ধি। আর্জেন্টিনারও সেই উপলব্ধি হলো অবশেষে। লিওনেল মেসিকে নিয়ে আর্জেন্টাইনদের কতশত অভিযোগ, অভিমান—‘দেশকে কিছুই জেতাতে পারো না, যতটা না আর্জেন্টাইন তুমি তার চেয়েও বেশি কাতালান।’ সেই মেসি আবারও ব্যর্থ! কে জানে, হয়তো আবারও শাপশাপান্ত করার প্রস্তুতিই নিচ্ছিলেন তাঁরা।
সেই সুযোগ মেসি দিলে তো! কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ বলে দিলেন; বিদায়, জাতীয় দলের হয়ে সাফল্য আমার ভাগ্যে নেই। ব্যস, বদলে গেল আর্জেন্টাইনদের মনোজগৎ। অভিমান, অভিযোগ ভুলে এখন তাঁরা নিঃশর্ত ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের ফুটবল-বীরকে। আর্জেন্টিনার এখন একটাই আকুতি, ‘মেসি, যেয়ো না!’
পরশু বুয়েনস এইরেসে উন্মোচন করা হলো মেসির একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি। বল নিয়ে ছুটন্ত মেসির মূর্তিটি যেন আর্জেন্টাইনদের আবেগ বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। বুয়েনস এইরেসের লা প্লাটা নদীর তীরে মেসির সঙ্গে আর্জেন্টিনার আরও বেশ কয়েকজন কিংবদন্তির মূর্তি শোভা পাচ্ছে। এই পাসেও দে লা গ্লোরিয়ায় (গৌরবের পথ) যাঁরা আছেন তাঁদের একজন আর্জেন্টিনার হকির ‘ম্যারাডোনা’ লুসিয়ানা আইমার। তাঁর চোখেও আর্জেন্টাইনদের এমন আবেগময় আচরণই মেসির অকাল অবসরের কারণ, ‘এখানে (আর্জেন্টিনা) ফুটবল চরম উন্মাদনার বিষয়। আমাদের রক্তেই সেই আবেগ বহন করি। সত্যি বলতে, এটাই আমি ভালোবাসি। কিন্তু এই মাত্রাতিরিক্ত আবেগ আমাদের এগোতে দিচ্ছে না। আমি নিশ্চিত, ওর (মেসি) উত্তেজনা যখন থিতিয়ে আসবে, ভেবে দেখার সময় পাবে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ওকে ওর মতো থাকতে দিন।’
আবেগের অনেক রকম প্রদর্শনীই চলছে আর্জেন্টিনায়। মেসির উদ্দেশে আবেগময় এক খোলা চিঠি লিখে যেমন বিখ্যাত হয়ে গেছেন এক স্কুলশিক্ষক ইয়োহানা ফাকস। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে পড়ে শোনানো সেই চিঠিতে সব আর্জেন্টাইনের আকুতিই যেন ঝরে পড়েছে, ‘হাল ছেড়ো না। পৃথিবীর মানুষ যেন না ভাবে, আমরা শুধু জয় আর শিরোপা নিয়েই ভাবি।’
দুই দিন আগেই যে মেসিকে নিয়ে আর্জেন্টিনা ছিল দ্বিধাবিভক্ত, সেই দেশে আজ সম্মিলিত হাহাকার! দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে ম্যারাডোনা, সবাই এখন মেসিকে ফিরে আসতে বলছেন। সব বিরাগ মুছে গিয়ে মেসি শুধুই ভালোবাসার নাম। আর্জেন্টাইনরা তো এমনই। কিন্তু কেন? আবেগের রাতারাতি এমন রূপ বদলে ফেলা মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হতে পারে।
এই মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যা আছে আর্জেন্টিনা মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণী সংস্থার (এপিএ) সভাপতি আন্দ্রেস রাসকোভস্কির কাছে, ‘আর্জেন্টাইনরা সব সময় একজন বীর খুঁজে বেড়ায়। রাজনীতিকেরা দেশটিকে লজ্জা ও কলঙ্কে ডুবিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতেই একজন ম্যারাডোনা কিংবা মেসিকে প্রয়োজন তাদের।’
আন্দ্রেস রাসকোভস্কি উদাহরণ দিয়েছেন ম্যারাডোনাকে দিয়ে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘ঈশ্বরের গোল’টির কথা আর্জেন্টাইনরা এখনো গর্ব করে বলে বেড়ায়। রাসকোভস্কি তাই বললেন, ‘হ্যান্ড অব গড ছিল একটি অন্যায়, একটি মেকি গোল, যেটি করা হয়েছিল হাত দিয়ে। তবু আমরা কাউকে উপাস্য করতে এতটাই ব্যগ্র ছিলাম যে, সেটাকেই প্রায় স্বর্গীয় ঘটনায় রূপ দিয়েছি!’
সব সময়ই আবেগে টগবগ করে ফুটতে থাকা ম্যারাডোনার তুলনায় মেসিকে অনেকটাই নিরাবেগ মনে হয়। এই চারিত্রিক বৈপরীত্যেও দুজনকে আর্জেন্টিনায় ভিন্ন চোখে দেখার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন রাসকোভস্কি, ‘সমাজে মূল্যবোধের যে সংকট, চারদিকে যে অন্যায় ও নৈরাজ্য; তাতে ওই অন্যায় কাজটিও (হাত দিয়ে গোল) আমাদের কাছে ম্যারাডোনাকে দেবতাতুল্য আসনে তুলে দিয়েছে। অন্যদিকে মেসি অনেক অনেকটাই বিনয়ী, স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের।’
তবে দেশের জন্য মেসির আবেগও কিন্তু কম নয়। টানা তিন ফাইনালের হতাশায় অবসর নিয়ে ফেলাটাকেও যেটির প্রমাণ হিসেবে ধরতে পারেন। মেসির শৈশবের ক্লাব নিউয়েল ওল্ড বয়েজের কোচ এনরিকে ডমিঙ্গেজ যেমন বললেন, ‘আমি ওকে ছোট থেকে চিনি। ওর চেহারায় প্রকাশ পায় না, তবে সে-ও যথেষ্ট আবেগপ্রবণ, অনুভূতিপ্রবণ।’
১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী দলের ডিফেন্ডার হোসে ব্রাউন বলেছেন, সেই দলের সবাই মেসিকে সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য অনুরোধ করবেন। শিরোপার আকাঙ্ক্ষাই তো জন্ম দিল এত বড় ঘটনার। আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত শিরোপাজয়ী দল যখন অনুরোধ করবেন থেকে যাওয়ার, সে অনুরোধ কি ফেলতে পারবেন মেসি?
হাজার হলেও মেসি তো একজন আর্জেন্টাইন! তথ্যসূত্র: এএফপি।