
ফেসবুকের প্রচ্ছদে লেখা, ‘প্রাউড টু বি এ সিলেটি।’ আবাহনীর জার্সিতে ক্লাব মাঠে তোলা ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিটা স্ট্রাইকার ওয়াহেদ আহমেদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের নাম দিয়েছেন ‘সুপারস্টার ওয়াহেদ’! এ নিয়ে ফুটবলপাড়ায় রসিকতাও কম নেই। ফেসবুকে ওয়াহেদ আহমেদ ফ্যানস ক্লাব নামে একটা ফ্যান ক্লাবও রয়েছে। সদস্যসংখ্যা সাড়ে ২৬ হাজারের বেশি। নিজের নামে একটা ফেসবুক পেজও আছে, যেটি এ বছর মার্চে স্বীকৃতি পায় (ভেরিফায়েড পেজ)। এই পেজের অনুসারী বর্তমানে ৮৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
ভার্চ্যুয়াল-জগতে এমন তারকাখ্যাতি ফুটবলার ওয়াহেদকে নিশ্চয়ই আত্মতৃপ্তি দেয়। অথচ বাংলাদেশের ফুটবলের সর্বশেষ তারকা বলা হয় দেশের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার আলফাজ আহমেদকে। যিনি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এশিয়ায় একবার হয়েছিলেন মাসের সেরা ফুটবলার। নব্বইয়ের দশকে মাঠ মাতানো স্ট্রাইকারের নাড়িপোঁতা সিলেটের জকিগঞ্জে। আর ওয়াহেদের বাড়ি শহরের শিবগঞ্জে।
স্বাধীনতার আগে থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত সিলেট অনেক ফুটবলার উপহার দিয়েছে দেশকে। বি রায় চৌধুরী, রণজিৎ দাস, কামরুজ্জামান, নাজির হোসেন, প্রবীর রঞ্জন দাস ভানু, রামা লুসাই, দিলীপ দাস, রেহান আহমেদ, কায়সার হামিদ, মোহাম্মদ কার্জন, জুয়েল রানা ও আলফাজ আহমেদরা সদর্পে খেলেছেন। সিলেট থেকে তাঁদের উত্তরাধিকার বহন করে জাতীয় ফুটবলে খেলছেন এখন হাতে গোনা কয়েকজন।
গত কয়েক বছর বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও বয়সভিত্তিক দলের জার্সি গায়ে তোলা সিলেটি ফুটবলার রয়েছেন আটজন—ওয়াহেদ আহমেদ, ইয়ামিন মুন্না, তকলিচ আহমেদ, মাসুক মিয়া জনি, বিপলু আহমেদ, সাইফুল ইসলাম, মনসুর আমিন ও সাদ উদ্দিন।
ওয়াহেদ ও সাদ খেলছেন আবাহনীতে। ওয়াহেদ একাধিকবার জাতীয় দলে খেলেছেন। গত বছর সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়ন দলের মিডফিল্ডার সাদকে পরশু জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডেকেছেন কোচ টম সেন্টফিট। জাতীয় দলে কয়েক বছরের প্রায় নিয়মিত মুখ ডিফেন্ডার ইয়ামিন মুন্না ও স্ট্রাইকার তকলিচ চোট ও খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য এখন দলের বাইরে। দুজনই এই মৌসুমে খেলছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে। মিডফিল্ডার জনি, বিপলু ও গোলরক্ষক সাইফুল মোহামেডানে খেলছেন। তিনজনই অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পেয়েছেন। জনি ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক। গত মৌসুমের মতো এবারও লিগের সব ম্যাচে প্রথম একাদশে খেলছেন জনি। মনসুর আমিন আরামবাগের ফুটবলার। সর্বশেষ ভুটানের বিপক্ষে জাতীয় দলে ছিলেন এই ডিফেন্ডার।
শ্রীমঙ্গলে বাড়ি জনি ও সাইফুলের। দুজনেরই উঠে আসা শ্রীমঙ্গলের একরাম রানা ফুটবল একাডেমি থেকে। শহরের সুবিদবাজারের ছেলে বিপলু, তকলিচ ও মনসুরের বাস মেজরটিলায়। ইয়ামিন মুন্না কাজী টুলার। সাদের বাড়ি দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই গ্রামে।
সবাই সিলেটি হলেও একসঙ্গে হননি তাঁরা কখনোই। পরশু সাতসকালে শহরের চৌহাট্টা মোড়ের এক রেস্তোরাঁয় সবাইকে জড়ো করলেন ওয়াহেদ। পাশের গৌড়গোবিন্দ টিলার ঢালু রাস্তায় একফাঁকে চলল ফটোসেশন। জাতীয় ফুটবলারদের এক নজর দেখতে রেস্তোরাঁর কর্মচারী থেকে শুরু করে পথচারীদের ভিড় জমে গেল!
সিলেটের মানুষ ফুটবলপ্রেমী। ফুটবল হলেই মাঠ ভরে যায়। এবারই ব্যতিক্রম। ইয়ামিন মুন্না আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘এবার প্রচারণাটা ঠিকমতো হয়নি বলেই ফাঁকা গ্যালারি।’ গ্যালারিতে প্রতিদিন একটা ব্যানার চোখে পড়বেই সবার। ‘পেশাদার লিগে সিলেটের ক্লাব চাই’ লিখে এমসি কলেজের ছাত্র সৈয়দ আবদুল হামিদ মাহফুজসহ একদল তরুণ খেলা দেখতে আসেন প্রতিদিন। ফুটবল সাপোর্টার্স অব বাংলাদেশের সিলেট প্রতিনিধির দাবির সঙ্গে গলা মেলালেন তকলিচ, ‘সিলেটে নামীদামি লোক আছেন, অর্থমন্ত্রী সিলেটের। তাঁরা যদি চেষ্টা করেন তাহলে ফেনী সকার, চট্টগ্রাম আবাহনীর মতো একটা দল সিলেটেও হবে।’
ঘরের ছেলেদের খেলা দেখতে প্রতিদিনই বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ভিড় করেন মাঠে। কিন্তু কোচ খেলাচ্ছেন না বলে বিপলু আহমেদের মনে খুব কষ্ট, ‘অন্য ম্যাচে একাদশে ছিলাম। কিন্তু নিজের বাড়িতে এসে খেলতে পারছি না বলে।’
জাতীয় দল এখন ভুগছে সাফল্যখরায়। সিলেটের ফুটবলাররাও দলে অনিয়মিত। এসব দেখে দুঃখ হয় কিশোর সাদের, ‘জাতীয় দলে তকলিচ ভাই, ওয়াহেদ ভাইয়েরা খেলছেন। তবে অনিয়মিত। আমি চাই দেশের সেরা খেলোয়াড় হতে। দলে ঢুকলে যেন আর বাদ না পড়ি। একাদশের অন্তত পাঁচ-ছয়জন যেন সিলেটের থাকে, সেটাই চাই।’
ওয়াহেদ-তকলিচদের মনের কথাটাই কি বেরিয়ে এল সাদের মুখে!