ব্রাজিলের ভরসা এস্তেভাও
ব্রাজিলের ভরসা এস্তেভাও

এস্তেভাও: ব্রাজিলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

প্রতিভার জোরে পেশাদার ফুটবলে আবির্ভাবের আগেই তাঁকে ডাকা হচ্ছিল ‘মেসিনিও’ নামে। বাড়ি ব্রাজিলে হলেও বয়সভিত্তিক ফুটবলে তাঁর খেলার ধরন মনে করিয়ে দিয়েছিল লিওনেল মেসির কথা। তাঁর পছন্দের খেলোয়াড়ও আবার মেসি। সব মিলিয়ে প্রত্যাশা ও ‘মেসিনিও’ নামের বিশাল চাপ নিয়েই পেশাদার ফুটবলের দুনিয়ায় আগমন ঘটে এস্তেভাওয়ের।

তা–ও আবার এমন এক সময়ে, যখন ব্রাজিলের ফুটবলের পার করছিল নিজেদের ইতিহাসের অন্যতম খারাপ সময়। ফলে অন্য অনেক প্রতিভার মতো দুঃসময়ের কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরই হারিয়ে যেতে পারতেন এস্তেভাও নামের তারাটিও। কিন্তু কোনো কোনো তারা উদিত হয় অন্ধকার আকাশকে আলোকিত করবে বলে। ব্রাজিলের জন্য যেন সেই তারা হয়েই এসেছেন এস্তেভাও।

মাত্র ১০ ম্যাচে মাঠে নেমেই এখন বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ‘সেলেসাও’দের। এর মধ্যে শেষ তিন ম্যাচে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়ে করেছেন তিন গোল। সর্বশেষ গতকাল রাতে সেনেগালের বিপক্ষেও অসাধারণ এক গোল করেছেন এই উইঙ্গার। সাম্প্রতিক সময়ে গোল ও পারফরম্যান্স মিলিয়েই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে তুরুপের তাস হয়ে উঠেছেন এস্তেভাও।

প্রতিভা—ব্রাজিলের ফুটবলে অতি ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে পড়া একটি শব্দ। প্রায় নিয়মিতই নতুন পেলে এবং নতুন রোনালদো নাজারিওদের আগমনের খবর পাওয়া যায় দেশটিতে। কিন্তু এর মধ্যে খুব অল্পজনই নিজেদের প্রতিভাকে দীর্ঘয়িত করে ধারাবাহিকতায় রূপান্তর করতে পারেন। বেশির ভাগই মূলত অঙ্কুরেই ঝরে পড়ে। যেমন সাম্প্রতিক সময়ের তুমুল আলোচিত দুটি নাম এনদ্রিক ও ভিতর রকি।

একজন রিয়াল মাদ্রিদ এবং অন্যজন বার্সেলোনায় গিয়ে নিজেদের সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বলও করেছিলেন। কিন্তু এরপরই হঠাৎ পথহারা হলেন এই দুজন। এখন তাঁরা ব্রাজিলের ফুটবল কক্ষপথ থেকে অনেক দূরে ছিটকে গেছেন। অন্যদিকে শুরুতে এনদ্রিক ও রকির মতো আলোচনায় না থাকলেও সুপ্ত প্রতিভাকে এখন পর্যন্ত ঠিকই মাঠে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন এস্তেভাও। দীর্ঘ পথের যাত্রাটা যদিও এখনো বাকি, কিন্তু শুরুটা যে আশা–জাগানিয়া হয়েছে, তা বলাই যায়।

সেনেগালের বিপক্ষে ব্রাজিলের প্রথম গোলটি করছেন এস্তেভাও

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেক হয় এস্তেভাওয়ের। সেদিন ইকুয়েডরের বিপক্ষে ব্রাজিলের ১–০ গোলে জেতা ম্যাচে বদলি হিসেবে মাঠে নেমেই ইতিহাস গড়েন এই কিশোর। অভিষেকের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ১৩৫ দিন, যা তাঁকে ব্রাজিলের জার্সিতে মাঠে নামা সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলারদের মধ্যে যৌথভাবে শীর্ষ পাঁচে জায়গা করে দেয়। এই তালিকায় তাঁর ওপরে আছেন পেলে, এদু, কুতিনিও ও এনদ্রিক।

এরই মধ্যে এস্তেভাও ব্রাজিলের হয়ে ১০ ম্যাচে মাঠে নামলেও ম্যাচটাইম কিন্তু খুব বেশি পাননি। এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচেই পুরো ৯০ মিনিট খেলা হয়নি তাঁর। এমনকি প্রথম চার ম্যাচে তিনি মাঠে ছিলেন মাত্র ৫০ মিনিট। আর সব মিলিয়ে তিনি মাঠে কাটিয়েছেন ৩৭৭ মিনিট। অর্থাৎ ৯০ মিনিট হিসেবে মাত্র ৪ ম্যাচে খেলার সমান সময় পেয়েছেন এস্তেভাও। তবে এটুকু সময়ে ঠিকই নিজেকে প্রমাণ করেছেন চেলসিতে খেলা এই তরুণ তুর্কি।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেক হয় এস্তেভাওয়ের। সেদিন ইকুয়েডরের বিপক্ষে বদলি হিসেবে মাঠে নেমেই ইতিহাস গড়েন এই কিশোর।

এখন পর্যন্ত এস্তেভাওয়ের কাছ থেকে এসেছে ৪ গোল। শেষ তিন ম্যাচে ৩ গোল করার কথা আগেই বলা হয়েছে। এখানেও অবশ্য ‘ফাঁকি’ আছে। জাপানের বিপক্ষে ব্রাজিলের ৩–২ গোলে হারার ম্যাচে এস্তেভাও মাঠে ছিলেন মাত্র ১৫ মিনিট। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের ৫–০ গোলে জেতা ম্যাচে ৭০ মিনিটে খেলে করেছিলেন জোড়া গোল এবং গতকাল রাতে ৮৩ মিনিট মাঠে থেকে করেন এক গোল। বলে রাখা ভালো, ব্রাজিলের জার্সিতে গতকাল সেনেগোলের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ম্যাচটাইম পেয়েছেন এস্তেভাও। শুধু জাতীয় দলেই নয়, চেলসির হয়েও এস্তেভাওয়ের পারফরম্যান্স বেশ উজ্জল। ১৬ ম্যাচে ৪ গোলের সঙ্গে করেছেন একটি অ্যাসিস্টও।

শুধু গোল বা পরিসংখ্যান দিয়ে নয়, এস্তেভাওয়ের উপস্থিতিও ব্রাজিল দলকে ইতিবাচকভাবে উজ্জ্বীবিত করছে। যেখানে দলের আক্রমণভাগের বাকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে সমন্বয়ের পাশাপাশি ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলকও দেখাচ্ছেন ১৮ পেরোনো এই তরুণ। কিছুটা নিচে নেমে যেমন খেলা তৈরি করছেন, আবার বুদ্ধিদীপ্ত পজিশনিংয়ের কারণে বের করছেন গোলের সুযোগও।

২০২৬ বিশ্বকাপ সামনে রেখে এখন ব্রাজিল–সমর্থকদের ভরসা হয়ে উঠেছেন এস্তেভাও। তাঁর এই উত্থানের পেছনে কৃতিত্ব দিতে হবে কোচ কার্লো আনচেলত্তিকেও। নিজের পরিকল্পনা ও কৌশলে এস্তেভাওকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করছেন তিনি।

সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তাঁকে (আনচেলত্তি) আমার জীবনে এনেছেন। তিনি অসাধারণ একজন কোচ।
এস্তেভাও, উইঙ্গার, ব্রাজিল ফুটবল দল

সেনেগাল ম্যাচের পর এস্তেভাওকে নিয়ে আনচেলত্তি বলেছেন, ‘এস্তেভাও অসাধারণ প্রতিভা। এত কম বয়সী একজন খেলোয়াড়ের এমন প্রতিভা, এমন শক্তিশালী শট দেখে আমি বিস্মিত। এস্তেভাওয়ের মতো খেলোয়াড়েরা থাকায় ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ নিরাপদ।’

একইভাবে আনচেলত্তিকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন এস্তেভাও–ও, ‘আনচেলোত্তি এমন একজন কোচ, যাঁর ঝুলিতে অসংখ্য শিরোপা আছে। তাঁর ক্যারিয়ারও অনেক সমৃদ্ধ। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তাঁকে আমার জীবনে এনেছেন। তিনি অসাধারণ একজন কোচ। আমরা প্রতিদিন কথা বলি। তিনি আমাকে উপদেশ দেন এবং অনেকভাবে সাহায্যও করেন।’

সেনেগালের বিপক্ষে গোলের পর মিলিতাওয়ের সঙ্গে উদ্‌যাপন করছেন এস্তেভাও

দুজনের মন্তব্যই বলে দিচ্ছে, ব্রাজিল দলে আনচেলত্তি–এস্তেভাও জুটি জমে উঠেছে। এই জুটির কার্যকারিতার ওপর ২০২৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সাফল্য বা ব্যর্থতার অনেক কিছু নির্ভর করছে। এখন এস্তেভাও নিজের প্রতিভা ও ধারাবাহিকতাকে দীর্ঘায়িত করতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা