এ মুহূর্তে খুব ব্যস্ত শেখ মোরছালিন। দম ফেলার সময়টুকুও নেই। ২০২৩ সালে দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এই তরুণের ব্যস্ততা ফুটবল নিয়ে হওয়াটাই স্বাভাবিক। ঘরোয়া ফুটবল মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু মোরছালিনের আসল ব্যস্ততা পড়াশোনা নিয়ে।
গত বছর ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র তিনি। ১৪ জানুয়ারি থেকে পরীক্ষা। মন দিয়ে পড়াশোনা করছেন। প্রাইমারিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন, এসএসসি, এইচএসসির ফলও ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মর্যাদাটা রাখতে চান, ‘ফুটবল খেলছি সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু পড়াশোনাটাও ঠিকমতো করতে হবে। ১৪ তারিখ থেকে পরীক্ষা। বাড়িতে এসেছি। সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছি। অনেক পড়া।’
‘গতিশীল অবস্থায় আমি কয়েকটি সহজ সুযোগ নষ্ট করেছি। এটা আমাকে ভাবাচ্ছে। নিজের বল আদান–প্রদান ক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে এ ব্যাপারটিও আসছে। বল প্লেতে আমি দেশের সেরা হতে চাই।’শেখ মোরছালিন
নতুন বছরে নিজের পারফরম্যান্স ধরে রাখার চ্যালেঞ্জটাও কম কঠিন নয়। ২০২৩ সালে আবির্ভাব যেভাবে, তাতে দ্রুতই পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত খেলোয়াড়ে। ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে তাঁর নাম। কিছুটা চাপ কি অনুভব করছেন? মোরছালিন বাস্তববাদী, ‘আমি গত কয়েক মাসে যেভাবে খেলেছি, তাতে আমার নিজের মধ্যেই একধরনের চ্যালেঞ্জ বোধ হচ্ছে। পারফরম্যান্স তো ধরে রাখতেই হবে। সেই সঙ্গে নিজেকে নিয়ে যেতে হবে আরও উঁচুতে। আরও বেশি গোল পেতে হবে। দেশকে আর ক্লাবকে জেতাতে হবে। সামনের দিনগুলো মোটেও সহজ নয়।’
২০২৪ তাঁর জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েই হাজির হয়েছে। এ বছর অনেক কিছুই করতে চান। বেশি বেশি গোল পাওয়া, আরও ভালো পারফরম্যান্স—এসব তো আছেই। তবে নির্দিষ্ট করে মোরছালিন পাঁচটি প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন করতে চান বছরজুড়ে। নিজের উন্নতির জন্যই এই পাঁচ প্রতিজ্ঞা মোরছালিনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পাঁচ প্রতিজ্ঞার মধ্যেই আছে তাঁর চ্যালেঞ্জ জয়ের মিশন...
প্রতিজ্ঞা–১: স্কোরিং ক্ষমতা বাড়ানো
দেশের হয়ে মাত্র ৯ ম্যাচ খেলেছেন। গোল করেছেন ৪টি। গত বছর জুনে বেঙ্গালুরুর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের বিপক্ষে গোল করে শুরু। এরপর ভুটানের বিপক্ষে জয়ে করেছেন দর্শনীয় এক গোল। গত সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা তৃতীয় গোলটির পর নভেম্বরে কিংস অ্যারেনায় লেবাননের বিপক্ষে আলোচিত সেই দূরপাল্লার শটের গোল। তবে মোরছালিনের আক্ষেপ সহজ কিছু সুযোগ হাতছাড়া করা, ‘আমি আসলে প্রথাগত “নাম্বার নাইন” না হয়েও গোল করার দায়িত্বে খেলছি কোচ হাভিয়ের কাবরেরার অধীনে। সাধারণত নাম্বার নাইনরা ডি–বক্সের আশপাশেই বেশির ভাগ সময় থাকে। কিন্তু আমাকে বল প্লেও করতে হয়। সে কারণেই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছি না নাকি, সেটি নিয়ে ভাবছি।’
ফুটবলের ব্যস্ততা থাকবেই। যেহেতু আমি পেশাদার ফুটবলার। সেই সঙ্গে পড়াশোনাটাও মনোযোগ দিয়ে করতে হবে।শেখ মোরছালিন
প্রতিজ্ঞা–২: বল পায়ে দৌড়ানোর সময় আরও ভালোভাবে পাস দেওয়া
এট মোরছালিনের শক্তিরই জায়গা। তাঁর বল প্লে আর আদান–প্রদান ভালোই। কিন্তু এই জায়গায় নিজেকে আরও ভালো জায়গায় নিতে চান। এই জায়গায় তাঁর গোল করার ব্যাপারটিও আছে, ‘গতিশীল অবস্থায় আমি কয়েকটি সহজ সুযোগ নষ্ট করেছি। এটা আমাকে ভাবাচ্ছে। নিজের বল আদান–প্রদান ক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে এ ব্যাপারটিও আসছে। বল প্লেতে আমি দেশের সেরা হতে চাই।’
প্রতিজ্ঞা–৩: ঘরোয়া ফুটবলে নিয়মিত একাদশে খেলা
কিংসের আবিষ্কার তিনি। মাঝখানে মোহামেডানে ধারে খেলেছেন। জাতীয় দলের নিয়মিত একাদশে জায়গা করে নিলেও ঘরোয়া ফুটবলে কিংসের জার্সিতে প্রথম একাদশে খেলার সুযোগ সেভাবে পান না। কারণটা খুব সহজ। একাদশে তাঁর জায়গায় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার রবসন দা সিলভাই যে প্রথম পছন্দ। নতুন বছরে তিনি ক্লাবের জার্সিতেও প্রথম একাদশে নিয়মিত হতে চান, ‘আমার জায়গাটা কিংসে রবসনের। সে–ই প্রথম পছন্দ কোচ ব্রুজোনের। এটাই স্বাভাবিক। দুর্দান্ত এক খেলোয়াড়। একাদশে নিয়মিত হতে হলে রবসনকে পেছনে ফেলতেই হবে। আমিও লড়াই করতে চাই। রবসনের সঙ্গে লড়াইটা আমার খেলোয়াড়ি যোগ্যতারও একটা পরীক্ষা।’
ভালো খেলোয়াড় হতে গেলেও পড়াশোনা লাগে—এটা মোরছালিন মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করেন
প্রতিজ্ঞা–৪: ফিটনেস নিয়ে কাজ করা
মোরছালিনের নিজেরই মনে হয়, এখনো নিজের ফিটনেসকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে পারেননি। নতুন বছরে এই জায়গাটায় কাজ করতে চান, ‘আমার ফিটনেসে উন্নতি করতে হবে। এটা আমার প্রতিজ্ঞা। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের সঙ্গে বল দখলের লড়াইয়ে আমাকে জিততে হবে বারবার, বেশির ভাগ সময়ই। বড় বড় প্রতিপক্ষের সঙ্গে গোল পেতে হলেও এটা জরুরি।’
প্রতিজ্ঞা–৫: পড়াশোনা
শুরুতেই বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত মোরছালিন। মন দিয়ে পড়াশোনা করছেন। এই মনোযোগটা সব সময়ই ধরে রাখতে চান। ভালো খেলোয়াড় হতে গেলেও পড়াশোনা লাগে—এটা তিনি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করেন, ‘এটা জীবনের জন্যই দরকার। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসে ভর্তি হয়েছি। পড়াশোনা খুব কম নয়। ফুটবলের ব্যস্ততা থাকবেই। যেহেতু আমি পেশাদার ফুটবলার। সেই সঙ্গে পড়াশোনাটাও মনোযোগ দিয়ে করতে হবে।’
এই পাঁচ প্রতিজ্ঞার বাইরেও নতুন বছরে মোরছালিনের একটা বড় লক্ষ্যও আছে। সেটি অনুমিতই। এ বছর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চারটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জাতীয় দলের। অস্ট্রেলিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিন—নিজের গ্রুপের এই তিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে এ চারটি ম্যাচের দুটি ঘরের মাঠে, দুটি বিদেশে। মোরছালিন অন্তত দুটি ম্যাচে জিততে চান। নিজেকে উজাড় করে দিতে চান। গত বছরের পারফরম্যান্সকে ছাপিয়ে এমন কিছু করে দেখাতে চান, যা আনন্দে ভাসাবে দেশের ফুটবলপ্রেমীদের।