
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সিডনির ঐতিহাসিক টাউন হল যেন পরিণত হলো এক রঙিন উৎসবের মঞ্চে। ঝকঝকে আলোর ঝলকানি, দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা আর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে আসা অতিথিদের পদচারণে মনে হচ্ছিল এ যেন কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। অথচ এটি ছিল ২০২৬ নারী এশিয়ান কাপ ফুটবলের ড্র অনুষ্ঠান, যেখানে এশিয়ার সেরা নারী ফুটবল দলগুলোর ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছিল।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় দরজা খোলার আগেই টাউন হলের সামনে জড়ো হয়েছিলেন নানা দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। তাঁদের হাতে নিজ নিজ দেশের পতাকা, পরনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক। অস্ট্রেলিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, জাপান, ভারত, ভিয়েতনাম, উজবেকিস্তান, ফিলিপাইন, ইরানসহ ১১টি দেশের ফুটবল দলের প্রতিনিধি, অধিনায়ক বা কোচের কেউ না কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিশ্ব ফুটবলের এই মিলনমেলায় সবাই নিজ দেশের নাম উজ্জ্বল করতে এসেছেন। কিন্তু এই আলো ঝলমলে মঞ্চে ছিলেন না বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের কোনো প্রতিনিধি।
অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ব ফুটবলের এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়োজন হলো, অথচ বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি নেই—এটা মেনে নেওয়া যায় না, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এখানে এসেছিলাম আমাদের মেয়েদের দেখতে, নিজেদের দেশের জার্সি গায়ে দেওয়া তারকাদের সঙ্গে ছবি তুলতে চেয়েছিলাম।সাঈদ ফয়েজ, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংস্কৃতিক কর্মী ও ইভেন্ট সংগঠক
অথচ এটা বাংলাদেশের জন্য ইতিহাস গড়ার বছর। এই প্রথম বাংলাদেশের মেয়েরা এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু সেই গৌরবময় মুহূর্তে, যখন বিশ্ব ফুটবল পরিবার সিডনিতে একত্র, তখন মঞ্চে অনুপস্থিত বাংলাদেশ। না কোনো ফুটবলার, না কোচ, না বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কোনো কর্মকর্তা। এই অনুপস্থিতি ছিল অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং বেদনাদায়ক, কারণ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ভারতের তারকা খেলোয়াড়সহ অন্যান্য দেশের ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা। তাঁরা ট্রফির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, বিশ্ব গণমাধ্যমের সামনে নিজেদের দেশকে তুলে ধরেছেন, আর স্মৃতির ক্যামেরায় ধরে রাখছেন ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বের জায়গাটিতে খাঁ খাঁ শূন্যতা।
এই দৃশ্যটি সিডনিতে বসবাসরত বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। তাঁদেরই একজন, সিডনির পরিচিত সাংস্কৃতিক কর্মী ও ইভেন্ট সংগঠক সাঈদ ফয়েজ বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ব ফুটবলের এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়োজন হলো, অথচ বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি নেই—এটা মেনে নেওয়া যায় না, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এখানে এসেছিলাম আমাদের মেয়েদের দেখতে, নিজেদের দেশের জার্সি গায়ে দেওয়া তারকাদের সঙ্গে ছবি তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আফসোস, আমাদের সেই গর্বের মুহূর্তটিই কেড়ে নেওয়া হলো। আমাদের কেউ ছিল না।’
এই বিষয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) অবশ্য একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, নারী অনূর্ধ্ব-২০ দলের লাওস সফরের কারণে কোচ পিটার বাটলার ও অধিনায়ককে সিডনিতে পাঠানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এমন একটি ঐতিহাসিক ড্র অনুষ্ঠানে, যেখানে দেশের নারী ফুটবলের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হচ্ছে, সেখানে অন্তত একজন প্রতিনিধিও পাঠানো কি এতটাই অসম্ভব ছিল?
অস্ট্রেলিয়ার ফুটবল প্রশাসকেরা এই টুর্নামেন্টকে কেবল ফুটবলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন এটিকে একটি বহুজাতিক ও বহু সংস্কৃতির মিলনমেলা হিসেবে উদ্যাপন করতে। উদ্বোধনী বক্তব্যে তাঁরা বিশেষভাবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেন। একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশে যেমন লাখো মানুষ এই সাফল্য উদ্যাপন করছে, তেমনি অস্ট্রেলিয়াতেও প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ আছেন, যাঁরা বাংলাদেশি ঐতিহ্যে গর্ববোধ করেন। তাঁদের জন্যও এই টুর্নামেন্টটি অত্যন্ত গর্বের।’ আয়োজকদের এই বক্তব্য যেন বাংলাদেশের অনুপস্থিতির ক্ষতকে আরও গভীর করে তোলে।
এই বিশাল মঞ্চে বাংলাদেশের নারীদের পদার্পণ নিঃসন্দেহে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অথচ সেই ইতিহাসের মোড়কে যখন বিশ্ব দাঁড়িয়ে, তখন সিডনির আলোকোজ্জ্বল ড্র অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নামটি শুধু কাগজে-কলমেই থাকল, মঞ্চে নয়।