কিংস অ্যারেনায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে
কিংস অ্যারেনায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে

কিংস অ্যারেনায় খেলতে ‘অনিরাপদ’ বোধ করছে আবাহনী–মোহামেডান

ফুটবল মাঠে সমর্থক বা খেলোয়াড়দের হাতাহাতি–মারামারি নতুন কিছু নয়। কিন্তু বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় যা হচ্ছে, সেটাকে আর স্বাভাবিক বলার উপায় নেই। একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেই চলছে দেশের শীর্ষ ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের নিজস্ব ভেন্যুতে, যা শুধু ঘরোয়া ফুটবলেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, ছড়িয়ে পড়ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। এ মাঠে খেলতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে আবাহনী–মোহামেডানের মতো ক্লাবগুলো।

কিংস অ্যারেনায় গতকাল প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীকে ২-০ গোলে হারিয়েছে বসুন্ধরা কিংস। দ্বিতীয় গোলের পর কিংসের সহকারী কোচ মাহবুব হোসেন আবাহনীর উদ্দেশে ‘দেখিয়ে দিলাম’ ধরনের অঙ্গভঙ্গি করেন ডাগআউট থেকে, যার ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ম্যাচের শেষ দিকে উত্তেজনা ছড়ায় রেফারির একসঙ্গে দুই দলের তিন খেলোয়াড় কিংসের সিনিয়র সোহেল রানা ও সাদ উদ্দিন এবং আবাহনীর শাহীন আহমেদকে লাল কার্ড দেখালে।

ম্যাচ শেষে তো লঙ্কাকাণ্ডই ঘটেছে। আবাহনীর খেলোয়াড় বাবুলকে কিংসের এক কর্মকর্তা ধাক্কা দেন বলে অভিযোগ আকাশি–নীলদের। এ ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন আবাহনীর সহকারী ম্যানেজার নজরুল ইসলাম। শুরু হয় তুমুল হট্টগোল। ডাগআউটের পেছনের গ্যালারিতে মারধরের শিকার হন আবাহনীর অতিরিক্ত খেলোয়াড় ফয়জুল্লাহ। গ্যালারিতে তখন নিরাপত্তা বলে কিছু ছিল না।

আবাহনীর কোচ মারুফুল হক বলেছেন, ‘খেলার পর অতিথি দলের কর্মকর্তাদের পাশে অচেনা লোকজনের মাস্তানি বা মারমুখী আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল, এত সুন্দর একটি মাঠ, স্টেডিয়াম—যেটিকে নিয়ে আমরা গর্ব করতাম, তা আসলে দিনে দিনে অনিরাপদ হতে যাচ্ছে।’ বাইরের কোনো দলের জন্যই এই স্টেডিয়াম নিরাপদ নয় মনে করছেন আবাহনীর সহকারী কোচ প্রাণতোষও, ‘ওখানে ওরা নিজেদের ইচ্ছেমতো সব করে। দেখলেন তো আমাদের অতিরিক্ত খেলোয়াড়কে কীভাবে মারল!’

এই ছবিটা গত বছরের ২২ নভেম্বরের। মাঠে স্মোক ফ্রেয়ার ছুঁড়েছিল কিংসের সমর্থকেরা

একটু পেছনে ফিরলে দেখা যাবে কিংস অ্যারেনায় এমন ঘটনা আছে আরও। মাঠটাকে এবার হোম ভেন্যু করেছে ফর্টিসও। কিন্তু গত ১৮ জানুয়ারি কিংস অ্যারেনায় প্রিমিয়ার লিগে কিংসের বিপক্ষে ম্যাচে ফর্টিসের গোলপোস্ট লক্ষ্য করে বোতল ও ইট নিক্ষেপ করা হয়। খেলাও বন্ধ ছিল কিছু সময়। ম্যাচ শেষে ফর্টিসের টিম গাড়িতে হামলা পর্যন্ত হয়েছে। তবে এ ঘটনায় বাফুফের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তা করেনি ফর্টিস কর্তৃপক্ষ।

ঘরোয়া ফুটবলের আরেক বড় ক্লাব মোহামেডান অবশ্য সরাসরিই অভিযোগ করছে, কিংস অ্যারেনায় খেলতে গিয়ে তারা ‘অবিচারে’র শিকার হয়। গত ২২ নভেম্বর চ্যালেঞ্জ কাপ জিততে না পারার জন্য কিংসের সমর্থকদের দায়ী করে সাদা-কালোরা। কিংসের বিপক্ষে সেই ফাইনালে এগিয়ে গিয়েও হেরেছে মোহামেডান। ম্যাচের শেষ দিকে কিংস সমর্থকদের ছোড়া স্মোক ফ্লেয়ারের ধোঁয়ায় মোহামেডান আর স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারেনি বলে দাবি তাদের। সে সময় নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে কিংস অ্যারেনায় কোনো ম্যাচ না খেলার ঘোষণা দেয় মোহামেডান।

ওখানে মনে হয় একটা রাজত্ব কায়েম হয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবলে ওরাই সবকিছু শাসন করছে, এমন ভাব ওদের। মাঠে, গ্যালারিতে নিরাপত্তা নেই।
আলফাজ আহমেদ, কোচ, মোহামেডান

কিংস অ্যারেনা ‘অনিরাপদ’ দাবি করে বাফুফেকে চিঠিও দিয়েছিল মোহামেডান। প্রথমে সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি বাফুফে। কিংস অ্যারেনার নিরাপত্তা–ঘাটতির কথা উল্লেখ করা মোহামেডান ১২ এপ্রিল আবার চিঠি দেয় বাফুফেকে। এরপর বাফুফে ও কিংস দুই পক্ষই নিরাপত্তা বাড়ানোর আশ্বাস দেয়। মোহামেডানও তাতে আশ্বস্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু গতকালের ঘটনা আবার উদ্বেগ ছড়াচ্ছে।

গত বছর কিংস অ্যারেনায় বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ–অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে দর্শক ঢুকে পড়ায় জরিমানা দিতে হয়েছে বাফুফেকে

কিংস অ্যারেনার অভিজ্ঞতা নিয়ে মোহামেডানের কোচ আলফাজ আহমেদের মন্তব্য, ‘ওখানে মনে হয় একটা রাজত্ব কায়েম হয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবলে ওরাই সবকিছু শাসন করছে, এমন ভাব ওদের। মাঠে, গ্যালারিতে নিরাপত্তা নেই।’ মাঠের খেলার প্রসঙ্গেও একই অভিযোগ তাঁর, ‘একটা ফাউল হলেই কিংসের সব খেলোয়াড় গিয়ে রেফারিকে ঘিরে ধরে। রেফারিও ওদের ভয় পায়। অথচ রেফারির রিপোর্টে তেমন কিছু দেখি না। অস্কার ব্রুজোন (কোচ) থাকার সময় এমন হয়েছে, এখনো হচ্ছে।’

কিংস অ্যারেনার দর্শকের আচরণ নিয়ে সমস্যাটা শুধু ক্লাব পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকছে না। আন্তর্জাতিক ম্যাচেও তা ছড়িয়ে পড়ছে। কিংস অ্যারেনায় জাতীয় দলের ম্যাচে দর্শকের অগ্রহণযোগ্য আচরণের জন্য অন্তত তিনবার ফিফা মোটা অঙ্কের জরিমানা করেছে বাফুফেকে।

গত বছর ৬ জুন বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে মাঠে দর্শক ঢুকে যাওয়ায় বাফুফেকে ১৫ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা করে ফিফা, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ২২ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের ২১ নভেম্বর বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডে লেবাননের বিপক্ষে ম্যাচেও নিরাপত্তাবিধি ভাঙা, গ্যালারিতে বাজি-পটকা ফোটানো এবং মাঠে দর্শক ঢোকার দায়ে বাফুফেকে ১১ হাজার ২৫০ সুইস ফ্রাঁ (১৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা) জরিমানা গুনতে হয়। ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর মালদ্বীপকে ২-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ, যে জয় বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের মূল পর্বে তুলে আনে। ওই ম্যাচেও ঘটেছিল একই রকম ঘটনা, যার জন্য ১৪ হাজার সুইস ফ্রাঁ বা ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল বাফুফেকে।

কিংস অ্যারেনায় দর্শক ঢুকেছে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ–মালদ্বীপ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্লে–অফ ম্যাচে

কিংস অ্যারেনায় কেন এভাবে বারবার নিরাপত্তাবিধি ভেঙে পড়ছে, আজ এ ব্যাপারে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ও বাফুফের পেশাদার লিগ কমিটির প্রধান ইমরুল হাসান ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও উত্তর দেননি। তবে বাফুফের লিগ কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘আবাহনী-কিংস ম্যাচ নিয়ে ম্যাচ কমিশনার ও রেফারির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যা হওয়ার হবে। তবে অবশ্যই মাঠে নিরাপত্তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।’