শেষটা এখন প্রায় চোখের সামনে।
আগামী গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোয় বসছে ২০২৬ বিশ্বকাপ। সেই মঞ্চেই হয়তো শেষবারের মতো আর্জেন্টিনার জার্সিতে দেখা যাবে লিওনেল মেসিকে।
অবশ্য ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের পর মেসির অবসর নিয়ে অনেক গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। কিন্তু কোচ লিওনেল স্কালোনির অধীন তিনি খেলাটাকে এতই উপভোগ করেছেন যে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর জাদু দেখার সুযোগ তাই আরও কিছুটা সময় পেল ফুটবল–বিশ্ব।
এই ফাঁকে চলুন ফিরে দেখা যাক জাতীয় দলের জার্সিতে মেসির ১০টি স্মরণীয় মুহূর্ত—২০০৬ সালে বিশ্বমঞ্চে আত্মপ্রকাশ থেকে শুরু করে ১৬ বছর পর স্বপ্নের সেই বিশ্বকাপ ট্রফি জেতা পর্যন্ত।
বার্সেলোনার হয়ে দুর্দান্ত মৌসুমের শেষ দিকে চোটে পড়েছিলেন। তবু ২০০৬ বিশ্বকাপের দলে জায়গা পান কিশোর মেসি। গোটা দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমীরা তখন অপেক্ষায়—জার্মানির মঞ্চে কখন দেখা যাবে তাঁকে।
আইভরি কোস্টের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে পুরোটা সময় বেঞ্চে ছিলেন। দ্বিতীয় ম্যাচে সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোর বিপক্ষে শেষ দিকে নামেন মাঠে। আর নামার কিছুক্ষণ পরেই বাজিমাত।
মাত্র ১৬ মিনিটের ঝলকে ১ গোল করেন, আরেকটি করান। গ্যালারিতে বসে খুশিতে চোখ চকচক করছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনার; যিনি পরে বলেছিলেন, ‘ও শুধু ভালো খেলোয়াড় নয়, ও অনন্য।’
বিশ্বকাপে অভিষেকেই গোল করেছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয় গোলের জন্য মেসিকে অপেক্ষা করতে হলো পুরো আট বছর। ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ ছিল তাঁর ও ম্যারাডোনার জন্য দুঃস্বপ্নের। জার্মানির কাছে ৪–০ গোলে হেরে বিদায়, এরপরই আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে ম্যারাডোনার বিদায়।
তাই ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে মেসির ওপর চাপ ছিল পাহাড়সমান। যদিও শিরোপা জেতা হয়নি শেষমেশ, তবে শুরুটা করেছিলেন দারুণ।
প্রথম ম্যাচে বসনিয়া–হার্জেগোভিনার বিপক্ষে গোল করলেন বক্সের বাইরে দারুণ এক মুভ থেকে। পরের ম্যাচে ইরানের বিপক্ষে যোগ হওয়া সময়ে অসাধারণ এক শটে ভেঙে দিলেন প্রতিপক্ষের হৃদয়।
গ্রুপ পর্ব শেষ করলেন নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ৩-২ জয়ে আরও ২ গোল দিয়ে। তার মধ্যে দ্বিতীয়টি ছিল দুর্দান্ত এক ফ্রি–কিকে।
২০২২ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ষোলো—মেসির পেশাদার ক্যারিয়ারের ১০০০তম ম্যাচ। আর তিনি যে মেসি, সেটা আবারও প্রমাণ করলেন ওই ম্যাচে।
আর্জেন্টিনার ২-১ জয়ে প্রথম গোলটি করেন বক্সের ঠিক ভেতর থেকে নিখুঁত শটে। অস্ট্রেলিয়ার মিডফিল্ডার কিয়ানু ব্যাকাস বলেছিলেন, ‘মেসিকে মাঠে অবিশ্বাস্য লাগে। মনে হয় মোমের মূর্তি নড়াচড়া করছে। সবকিছু এত সহজে করে যে বোঝাই যায় না সে কতটা আলাদা। আমি তো বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে শুধু ওকে দেখছিলাম, আসলে কী করছে।’
২০১২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্ট রাদারফোর্ডে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল ‘স্রেফ’ এক প্রীতি ম্যাচ। কিন্তু মেসির জন্য তা ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু। সেদিন তিনি যে জাদু দেখিয়েছেন, সেটা আর্জেন্টাইনরা ভুলবে না কোনো দিন—সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক। আর্জেন্টিনা জিতল রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে ৪–৩ ব্যবধানে।
প্রথম দুটি গোল নিখুঁত ফিনিশিংয়ে। শেষটা যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো চোখজুড়ানো দৃশ্য। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে ছুটলেন, এরপর বুলেটগতির শট সোজা ব্রাজিলের জালে। ম্যাচ শেষে ব্রাজিল কোচ মানো মেনেজেস অসহায় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘মেসির সমাধান এখনো কেউ খুঁজে পায়নি। চারটা সুযোগ পেল, তিনটা গোল করল।’
আর্জেন্টিনা কোচ আলেহান্দ্রো সাবেয়া শুধু বলেছিলেন, ‘আমাদের ভাগ্য ভালো, লিও আর্জেন্টাইন।’
কাতার বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার তরুণ ডিফেন্ডার ইওস্কো গাভারদিওল ছিলেন প্রায় সবার চোখে সেরা ডিফেন্ডারদের একজন। তাঁর জন্যই ম্যানচেস্টার সিটি খরচ করেছিল ৭৭ মিলিয়ন পাউন্ড।
কিন্তু সেই গাভারদিওল মেসির সামনে দাঁড়াতে পারলেন না। প্রথমার্ধেই পেনাল্টি থেকে গোল করেন মেসি। তারপর দ্বিতীয়ার্ধে ডান পাশ দিয়ে বল পায়ে ঢুকতে গিয়ে যেন গাভারদিওলকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেললেন। শেষমেশ হুলিয়ান আলভারেজকে যে পাসটা দিলেন, সেটা দেখে গাভারদিওল যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য। গোল।
ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক লুকা মদরিচ পরে বলেছিলেন, ‘লুসাইলে মেসি আবারও দেখিয়ে দিল কেন সে-ই সেরা।’ আর গাভারদিওল? হারের পরেও হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘হেরে গেলেও খুশি। কারণ, আমি ৯০ মিনিট ধরে মেসিকে মার্ক করেছি—এই গল্পটা আমার সন্তানদের বলতে পারব।’
ফুটবল–রসিকদের চোখে ২০২২ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার নাটকীয় জয়ের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত? নিঃসন্দেহে নাহুয়েল মলিনার গোলে মেসির সেই অবিশ্বাস্য পাস; যে পাস অন্য কেউ হয়তো কল্পনাই করতে পারতেন না, দেওয়া তো দূরের কথা! অনেকেই বলেন, ওটা বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা পাসগুলোর একটি।
তবে বেশির ভাগ আর্জেন্টাইনের মনে ‘লুসাইলের যুদ্ধ’ মানেই অন্য এক দৃশ্য—ম্যাচ শেষে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মেসির হঠাৎ রাগ ঝাড়ার মুহূর্ত। ডাচ ফরোয়ার্ড ভাউট ভেগহোর্স্টের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘কী দেখছিস, বোকা? কী দেখছিস? চলে যা এখান থেকে, গর্দভ!’
পরে অবশ্য মেসি স্বীকার করেছেন, এমন আচরণ করা তাঁর উচিত হয়নি। ম্যাচে রেকর্ড ১৭টি হলুদ কার্ড, উত্তেজনা, হাতাহাতি—সব মিলিয়ে পরিবেশ ছিল উত্তপ্ত। সেই আবহেই এমন প্রতিক্রিয়া।
তবে আর্জেন্টাইনরা তখন মেসির ওই রূপে মুগ্ধ। অনেকেই তো আগে বলতেন, ম্যারাডোনার মতো ‘ঔদ্ধত্য’ মেসির নেই। অধিনায়ক হিসেবে তিনি নাকি ‘অতটা আগ্রাসী’ নন। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে মেসি দেখালেন, তাঁর ভেতরেও আগুন আছে। আর সেই আগুন দেখেই তাঁকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলল আর্জেন্টিনা।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে উরবানা প্লেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেসি বলেছিলেন, ‘ঘটনাটা আসলে কীভাবে যেন হয়ে ঘটে গিয়েছিল। ওই খেলোয়াড়ের (ভেগহোর্স্ট) সঙ্গে কিছু হয়েছিল, ম্যাচে আরও কিছু উত্তেজনার মুহূর্ত ছিল। ম্যাচটা মাত্রই শেষ হয়েছে, আবেগ তখনো টাটকা। তবে এ ধরনের পরিস্থিতি আমি পছন্দ করি না, কিন্তু এসব হয়।’
কাতারে আর্জেন্টিনা গিয়েছিল তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে। একদিকে তারা ছিল কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন, অন্যদিকে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত।
কিন্তু শুরুতেই বাজিমাত করল সৌদি আরব। লুসাইলে মেসির পেনাল্টি থেকে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ২–১ গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম বড় অঘটন!
এরপর মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচটা হয়ে গেল বাঁচামরার লড়াই। হেরে গেলে বিদায় নিশ্চিত, সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল, গোল আসছিল না।
ঠিক তখনই ৬৪ মিনিটে দি মারিয়ার পাস এক স্পর্শে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ২৫ গজ দূর থেকে নিচু শটে গোল করলেন মেসি। পরের ইতিহাস সবার জানা—আর্জেন্টিনা ২–০ গোলে জিতল আর মেসি বললেন, ‘আজ থেকেই আর্জেন্টিনার জন্য নতুন বিশ্বকাপ শুরু।’ সত্যিই তা–ই হয়েছিল। অঘটনের শিকার থেকে শুরু করে গৌরবের যাত্রা—সব এক বিশ্বকাপেই।
টানা তিনটি ফাইনালে হার—আর সহ্য করতে পারেননি মেসি। ২০১৬ কোপা আমেরিকার টাইব্রেকারে চিলির কাছে হেরে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর ঘোষণা দেন।
তবে আর্জেন্টাইনরা তাঁকে ছাড়তে রাজি ছিলেন না। তখনকার প্রেসিডেন্ট মরিসিও ম্যাক্রিও বলেছিলেন, ‘মেসি, তুমি আমাদের জন্য ঈশ্বরের উপহার।’ সবার অনুরোধে ফিরে আসেন মেসি। আর তাতেই বাঁচে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ–স্বপ্ন।
২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর, রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচ। উচ্চতার কারণে কিটোতে খেলা কঠিন, তার ওপর শুরুতেই গোল খেয়ে বসে আর্জেন্টিনা। কিন্তু মেসি ছিলেন যে! একাই করেন হ্যাটট্রিক, দলকে পৌঁছে দেন বিশ্বকাপে।
ম্যাচ শেষে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরের কৃপায় আমরা আমাদের লক্ষ্য পূরণ করেছি।’ আর গোটা আর্জেন্টিনা বলেছিল, ‘ধন্যবাদ, মেসি!’
সত্যি বলতে, ২০২১ কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে খুব ভালো খেলেননি মেসি। কিন্তু তাতে কী যায়–আসে? ফাইনালে না জ্বললেও আগের ম্যাচগুলোয় ছিলেন দুর্দান্ত। আর্জেন্টিনার ১২ গোলের মধ্যে ৯টিতে সরাসরি অবদান, ৫টি নিজেই করেছেন। তাই রিওতে ১-০ ব্যবধানে আর্জেন্টিনার জেতার পর গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট—দুটিই জেতেন মেসি।
কিন্তু এসব তাঁর কাছে গৌণ। আসল ব্যাপার ছিল প্রিয় আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম কোনো বড় ট্রফি জেতা। তাই তো ফাইনাল শেষে বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুধারা।
তিন মাস পর ইএসপিএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যে স্বপ্ন এতবার হাতছাড়া হয়েছে, সেটা পূরণ করে এখন শান্তি অনুভব করি। এটা ছিল স্বপ্নের মতো, অসাধারণ মুহূর্ত। তখন ঠিক বুঝতেই পারিনি কী ঘটছে। এখন ছবি দেখে বেশি উপভোগ করি।’
আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের কোপা আমেরিকা–খরা ঘুচে যাওয়ার পরই শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধ্যায়। ফাইনালে দি মারিয়ার সেই গোল যেন ছিল এক মহাকাব্যের সূচনা।
মেসির ক্যারিয়ারের রাজমুকুট। কাতারের সেই বিশ্বকাপ ফাইনাল। ফ্রান্সের বিপক্ষে নাটকীয় ম্যাচ, ৩–৩ গোল, টাইব্রেকার। গঞ্জালো মন্তিয়েলের শেষ শট জালে জড়াতেই আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান। আর মেসি? যেন ‘সর্বকালের সেরা’র বিতর্কটা একরকম শেষই করে দিলেন।
১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার পর আর কোনো খেলোয়াড় এতটা দাপট দেখাতে পারেননি বিশ্বকাপে। নকআউট পর্বে প্রতিটি ম্যাচেই ম্যাচসেরা মেসি।
ফাইনালে দুটি গোল করে ছাড়িয়ে গেলেন ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলেকেও। বিশ্বকাপে গোল–অবদান হলো ২১টি। আর ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে দুবার জিতলেন গোল্ডেন বল। সবই ঘটল ৩৫ বছর বয়সে, যা ম্যারাডোনাও পারেননি।
সেই ফাইনালের পর গ্যারি লিনেকার লিখেছিলেন, ‘প্রায় দুই দশক ধরে মেসিকে দেখতে পারাটা পরম সৌভাগ্যের। মুহূর্তের পর মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন বিস্ময়ের, আনন্দের। ফুটবলের জন্য সে ঈশ্বরের উপহার!’