সান সিরোত আজ কি ইন্টার মিলানের রক্ষণ–বাধা চুরমার করতে পারবেন ইয়ামালরা?
সান সিরোত আজ কি ইন্টার মিলানের রক্ষণ–বাধা চুরমার করতে পারবেন ইয়ামালরা?

‘চীনের প্রাচীর’ টপকাতে পারবেন তো ইয়ামাল–রাফিনিয়ারা

সান সিরোর জিউসেপ্পে মিয়াৎসা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আছড়ে পড়া নীল ঢেউয়ের শব্দে হয়তো মাঝেমধ্যেই কেঁপে উঠবে বার্সেলোনা। আবার বার্সেলোনার আক্রমণগুলো যখন আছড়ে পড়বে বহু বছর ধরে চীনের প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ইন্টার মিলান রক্ষণের নীল দেয়ালে, মুহূর্তেই হয়তো স্তিমিত হবে ৮০ হাজার দর্শকের হৃদ্‌কম্প। জিউসেপ্পে মিয়াৎসার গ্যালারিতে নেমে আসবে আশ্চর্য নীরবতা।

গত ৩০ এপ্রিল বার্সার মাঠে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালের প্রথম লেগের ম্যাচটি ৩-৩ গোলে ড্র হওয়ার পর থেকেই টগবগ করে ফুটছিল মিলানের ফুটবল স্বর্গ সান সিরো। ধীরে ধীরে স্টেডিয়ামটি প্রস্তুত হচ্ছিল আরেকটি আগুনে লড়াইয়ের জন্য। অবশেষে অপেক্ষা ফুরোচ্ছে আজ, ফাইনালে ওঠার জন্য দ্বিতীয় লেগের লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে ইন্টার মিলান ও বার্সেলোনা।

বার্সার মাঠে প্রথম লেগের ম্যাচটি যেন ছিল দাবা খেলার মতো। যেখানে শুরুতে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়া বার্সা লেখে ঘুরে দাঁড়ানোর দুর্দান্ত এক গল্প। সেই ম্যাচে বার্সা কোচ হান্সি ফ্লিক যেন হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি দাবাড়ু মিখাইল তাল। বার্সার প্রথম দুই গোল হজম করাকে কেউ চাইলে তালের ‘স্যাক্রিফাইস’ কৌশলের সঙ্গেও মেলাতে পারেন। যেখানে প্রতিপক্ষকে শুরুতে সুযোগ দিয়ে তারপর চেপে ধরা হয়। শেষ পর্যন্ত ফলটা পুরোপুরি বার্সার পক্ষে আসেনি। ঘরের মাঠে সমতাতেই শেষ হয়েছে ম্যাচ। তবে একদিক থেকে বার্সা নিজেদের ভাগ্যবানও ভাবতে পারে—এখন আর অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নেই! নয়তো ৩টি অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে এগিয়ে থাকা ইন্টারের বিপক্ষে ম্যাচটা আরও কঠিন হতে পারত বার্সার জন্য।

প্রথম লেগে ঘরের মাঠে ০–২ গোলে পিছিয়ে পড়েও বার্সেলোনা ইন্টার মিলানের সঙ্গে ৩–৩ গোলে ড্র করেছে

প্রায় সব দিক থেকেই বার্সা-ইন্টার দ্বৈরথ এখন সমতায়। এরপরও একটা বাড়তি সুবিধা ইন্টার পাচ্ছেই। এই ম্যাচটা তারা খেলবে নিজেদের মাঠে। সমর্থকদের জন্য সান সিরো এক অনবদ্য আবেগের নাম। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সেই আবেগ নিশ্চিতভাবে বাঁধ ভাঙবে। সাধারণ সমর্থকদের পাশাপাশি ইন্টারের আল্ট্রার্স সমর্থক ‘কারভা নর্ড’ তো আছেই, যারা বার্সার জন্য রাতটাকে নরকসম করে তুলতে সম্ভাব্য সবকিছুই করবে। রোমাঞ্চের অপেক্ষায় থাকা ম্যাচে এই একটি সুবিধাই শেষ পর্যন্ত বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। যে সুবিধা বার্সা নিতে পারেনি, এখন ইন্টারের পালা।

নিজেদের মাঠে আরও একটি পরিসংখ্যান অনুপ্রেরণা দিতে পারে ইন্টারকে। ২০১০ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের সর্বশেষ শিরোপা জয়ের পথে এ মাঠেই সেমিফাইনালে বার্সাকে হারিয়েছিল তারা। আজ আবারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তির অপেক্ষা। কিন্তু ফুটবল কি আর হিসাবনিকাশ, ইতিহাস বা পরিসংখ্যান মেনে এগোয়! ফুটবলে দিনের খেলাটাই শেষ কথা। ফলে আজ মাঠে নামার আগে ইতিহাস ও পরিসংখ্যানকে এক পাশে সরিয়ে রেখেই নামতে হবে দুই দলকে। যেখানে বার্সার চোখ থাকবে যেকোনো মূল্যে ইন্টারকে হারিয়ে ফাইনালে যাওয়া, ইন্টারের হিসাবটাও তাই।

মাঠ, দর্শক, ইতিহাস বা পরিসংখ্যান—এসব একেকটি প্রেরণার নাম হতে পারে। আসল কাজটা মাঠেই করে দেখাতে হবে। ফলে মূল লড়াইটা হবে কৌশলের আর স্নায়ুর। ইন্টারের রক্ষণকে যেখানে লড়তে হবে বার্সার পরাক্রমশালী আক্রমণভাগের সঙ্গে। তবে সব বাদ দিয়ে অলআউট আক্রমণে যাওয়াও বিপদে ফেলতে পারে বার্সাকে। প্রতি–আক্রমণে ইন্টার কতটা বিধ্বংসী হতে পারে, তার প্রমাণ তারা প্রথম লেগেই দিয়েছে। আজ তাই ফ্লিককে আক্রমণ ও রক্ষণের মধ্যে সমন্বয় রাখতে হবে। কারণ, ম্যাচের কোনো পর্যায়ে ইন্টার যদি আগে গোল করে, তাহলে স্বাগতিকদের রক্ষণপ্রাচীর ভেঙে সেই গোল শোধ করা কঠিনই হবে বার্সার জন্য। চলতি মৌসুমে ইন্টারের রক্ষণশক্তি বোঝা যাবে একটি পরিসংখ্যানে। চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সার ২০ গোল হজম করার বিপরীতে ইন্টার হজম করেছে মাত্র ৮ গোল। তবে ঘরের মাঠে ইন্টার খেয়েছে ৬ ম্যাচে মাত্র ৩ গোল। এমন রক্ষণের সঙ্গে প্রায় ৮০ হাজার দর্শকের গর্জন তো আছেই।

প্রথম লেগে বার্সার আক্রমণের প্রধান মুখ ছিলেন ইয়ামাল। দ্বিতীয় লেগেও সেই ইয়ামালের ওপরই চোখ থাকবে সবচেয়ে বেশি। মাঠের এক প্রান্ত অনেকটা একাই দখল করে রাখবেন ১৭ বছর বয়সী এই কিশোর। আগের ম্যাচে ডাবল মার্কার লাগিয়েও আটকানো যায়নি ইয়ামালকে। দুজনের বেশি মার্কার রাখারও অবশ্য সুযোগ নেই ইন্টার কোচ সিমোনে ইনজাগির। কারণ, ইয়ামালকে থামাতে যদি দুজনের বেশি খেলোয়াড় পাহারায় রাখা হয়, তাহলে মাঠের অন্য জায়গাগুলো ফাঁকা হয়ে পড়বে। আর এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য আছেন রাফিনিয়া–ফেরমিন লোপেজসহ অন্যরা।

কাল সান সিরোতে অনুশীলনে বার্সেলোনার লামিনে ইয়ামাল

দারুণ ছন্দে থাকা রাফিনিয়া কখনো কখনো ইয়ামালের চেয়েও বিপজ্জনক। বিশেষ করে রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তগুলোতে জাদুকরের বেশে আবির্ভূত হন ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার। আজও তেমন ত্রাতা হয়ে সামনে আসার অপেক্ষায় থাকবেন রাফিনিয়া। বার্সার জন্য আরও একটি সুখবর আছে, এ ম্যাচে বদলি হিসেবে মাঠে নামতে পারেন চোট কাটিয়ে ফেরা রবার্ট লেভানডফস্কিও। লেভার ফেরা বার্সার গোল করার সম্ভাবনা নিশ্চিতভাবে বাড়িয়ে দেবে এবং অ্যাটাকিং থার্ডে দলটিকে গতিময় থাকতেও সাহায্য করবে। পাশাপাশি পোলিশ স্ট্রাইকারের উপস্থিতি ইয়ামাল কিংবা রাফিনিয়ার ওপর থেকে গোল করার চাপও অনেক কমিয়ে দেবে। নিজেদের খেলাটা আরও বেশি স্বাধীনতা নিয়ে খেলতে পারবেন এ দুজন। যার প্রভাব বার্সার সামগ্রিক পারফরম্যান্সেও নিশ্চিতভাবেই পড়বে। চলতি মৌসুমে এই তিনজন মিলে ১৫০ ম্যাচে করেছেন ৮৬ গোল।

আক্রমণের পাশাপাশি মাঝমাঠেও বার্সা বেশ শক্তিশালী। বিশেষ করে মাঝমাঠে পেদ্রি এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা। রক্ষণ থেকে খেলা তৈরিতে রীতিমতো অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন এই স্প্যানিশ তরুণ। সুযোগ পেলে আচমকা শটেও চমকে দিতে পারেন প্রতিপক্ষকে। আজ ইন্টারের রক্ষণপ্রাচীর ভাঙতেও বিশেষভাবে প্রয়োজন হবে পেদ্রিকে। পেদ্রির পাশাপাশি ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংও বার্সার মাঝমাঠে শক্তি বাড়াবেন। বিশেষ করে রক্ষণের সঙ্গে সংযোগ করায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে হতে পারে তাঁকে।

ইন্টার মিলানের রক্ষণের অন্যতম ভরসা ফ্রান্সেসকো আচেরবি

বার্সার মূল দুশ্চিন্তার নাম রক্ষণ। বিশেষ করে চোটের কারণে জুলস কুন্দের ছিটকে যাওয়া বার্সাকে বেশ ভোগাতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে দারুণ ছন্দে ছিলেন এই রাইটব্যাক। ইয়ামালের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়াও চমৎকার। ইন্টারের বিপক্ষে আজ তাঁকে বিশেষভাবে প্রয়োজন ছিল বার্সার। এমনকি কুন্দের না থাকা রক্ষণেও বার্সাকে ভয়ের মধ্যে রাখবে। কুন্দের অভাব মেটাতে ফ্লিক এখন কোন কৌশল নিয়ে আসেন, সেটা দেখার বিষয় হবে।

ইন্টারের মাঠে দলটির বিপক্ষে জিততে হলে বার্সাকে প্রতিপক্ষের দুর্বলতার চেয়ে নিজেদের শক্তির ওপরই বেশি নির্ভর করতে হবে। আর নিজেদের শক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে জয় আদায় করার মতো সেই সামর্থ্যও দলটির আছে। এখন সব শক্তি উজাড় করে শেষ পর্যন্ত সেই চূড়ান্ত সাফল্য বার্সা পায় কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।