‘আর্জেন্টাইনদের কাছে ডিয়েগো ঈশ্বর। সব সময় তাই থাকবেন’—কথাটা কার্লোস তেভেজের। ফ্যাবিও ক্যানাভারো অবশ্য দাবি করেন, নেপলসবাসীর কাছেও ‘ঈশ্বর’। আর ফুটবল মাঠে তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরাদের মধ্যেও খুব সংক্ষিপ্ত তালিকার মানুষ। আর্জেন্টিনার ’৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের মহানায়ক। নাপোলির বিশ্বসেরা ক্লাবের কাতারে উঠে আসার চাবিকাঠি। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ৬৫ বছর। ২০২০ সালে অনন্তলোকে পাড়ি জমানো সেই কিংবদন্তি ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনার আজ জন্মদিন।
৩০ অক্টোবর ১৯৯৮।
রোজারিওর লা তাবলাদা মফস্সল শহর। ঘড়িতে রাত ১২টা বেজে ১৫ মিনিট। এরনান আমেজ একটু হাঁটতে বের হয়েছিলেন। নিশুতিরাতের উদ্দেশ্যহীন পায়চারি আরকি। পথিমধ্যে দেখা হলো বন্ধু হেক্টর ক্যাম্পোমারের সঙ্গে। বন্ধুকে তো কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেই হয়। হেক্টর বললেন, ‘আরে এরনান! কী খবর?’
‘এই তো হেক্টর...চলে যাচ্ছে আরকি...শুভ বড়দিন (মেরি ক্রিসমাস)।’
হেক্টর তো অবাক। এখন বড়দিন কেন! হেক্টর একটু বিচলিত হয়েই জানতে চাইলেন, ‘মানে কী?’
‘শুভ বড়দিন। একটু ভাবো, বুঝতে পারবে,’ এরনানের কণ্ঠ দ্বিধাহীন।
হেক্টরের এবার মনে পড়ল, ‘ঠিক বলেছ! শুভ বড়দিন।’
দুই বন্ধু এরপর একে অপরকে আলিঙ্গন করে শুভরাত্রি বলে যে যাঁর পথ ধরলেন।
৩০ অক্টোবর ১৯৯৮। রাত ১২টা ৪৫ মিনিট।
ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং। লা তাবলাদা থেকে কয়েক ব্লক দূরে লা গুয়ার্দিয়ায় ফোন বাজছে আলেহান্দ্রো ভেরনের ঘরে। ফোনটা করেছে তাঁর বন্ধু এরনান।
‘হ্যালো?’
‘হ্যালো অ্যালে, এরনান বলছি। শুভ বড়দিন।’
‘এখন রাত (প্রায়) ১টা বাজে। কী খেয়েছ? ফরমালডিহাইড?’
‘একটু ভেবে দেখো। আজ কোন দিন, অ্যালে?’
‘(একটু ভেবে) হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আজ “ঈশ্বর“–এর জন্মদিন। শুভ বড়দিন, ভাই মারাদোনিয়ান।’
পরের দিন সন্ধ্যায় তিন বন্ধু মিলে বিয়ারের ক্যান খুলে উদ্যাপন করলেন প্রথম ‘মারাদোনিয়ান ক্রিসমাস’। পরের দুটি বছরে এই দিনে তাঁদের দল আরও ভারী হলো। আরও কিছু বন্ধুবান্ধব যোগ দিল তাঁদের উদ্যাপনে। কিন্তু ২০০১ সালে ব্যাপারটা একটু পাল্টে গেল। সেবার একটু আগেভাগেই (৭ অক্টোবর) প্রস্তুতি নিলেন এরনান ও আলেহান্দ্রো। আশপাশের এলাকা থেকে ম্যারাডোনার ভক্তদের নিয়ে একটি ডিনার অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হলো। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যাঁরা আসবেন এই নিমন্ত্রণে, তাঁদের ‘মারাদোনিয়ান’ বলা হবে।
দুই বন্ধু মিলে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ঠিক করলেন, ‘ডিয়েগো যেহেতু ফুটবল–ঈশ্বর, তাই তাঁর নামে একটি চার্চ থাকা উচিত—মারাদোনিয়ান চার্চ (ইগলেসিয়া মারাদোনিয়ানা)। প্রশ্ন উঠল, রক্তমাংসের এক মানুষকে রীতিমতো ‘ঈশ্বর’ (আর্জেন্টিনায় তারও বহু আগে থেকেই তিনি এই নামে স্বীকৃত) বানিয়ে তাঁর নামে চার্চ তৈরির অর্থ তো আসলে নতুন এক ধর্মের উদ্ভব ঘটানো। এলাকার ‘পাদ্রি আমাদের আস্ত রাখবে তো?’ ‘যে পছন্দ করবে ভালো। যার ভালো লাগবে না, পাত্তা না দিলেই হয়।’
৩০ অক্টোবর ২০০১। রোজারিওর সেন্ট্রাল কর্ডোবা ক্লাব রেস্টুরেন্ট।
ডিনারে উপস্থিত ১২০ জন ম্যারাডোনা–ভক্ত। অনেকটাই ধর্মসভার আঙ্গিকে সেই অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই পাদ্রির পোশাকে হাজির আলেহান্দ্রো ভেরন। ম্যারাডোনার পরিবারকে ‘হলি ফ্যামিলি’ সম্বোধন করে শুরু করলেন স্তোত্রপাঠ, ‘তোতার (ম্যারাডোনার মা) নামে শুরু করছি...ডন ডিয়েগো...এবং তার ভালোবাসার মানুষেরা...।’
উপস্থিত সভাসদ ‘ডিয়েগো...ডিয়েগো’ স্লোগানে সম্মতি দিলেন।
সেই রাতে এরনান ও আলেহান্দ্রো অন্যদের বলে দেন, আগামী ১০ নভেম্বর বোকা জুনিয়র্সের মাঠ লা বোমবোনেরা স্টেডিয়ামে শেষ ম্যাচটি খেলবেন ম্যারাডোনা। উপস্থিত অতিথিরা চাইলে সেখানে আসতে পারেন।
১০ নভেম্বর ২০০১। লা বোমবোনেরা স্টেডিয়াম।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ম্যারাডোনার ৫২ জন অনুসারী পৌঁছালেন বোকা জুনিয়র্সের স্টেডিয়ামে। সকাল প্রায় সাড়ে ৯টা বাজে। ম্যারাডোনার শেষ ম্যাচ বলেই হয়তো সেদিন আকাশও কাঁদছিল। ১২ নম্বর গেট দিয়ে অনুসারীরা ঢুকলেন তাঁদের ‘ঈশ্বর’কে দেখতে। ১০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ মিটার প্রস্থের একটি পতাকা বের করলেন তাঁরা। সেখানে আর্জেন্টাইন রঙে লেখা হলো ‘মারাদোনিয়ান চার্চ দ্য হ্যান্ড অব গড রোজারিও’।
ব্যস, এরপরই লিওনেল মেসির জন্মভূমি রোজারিওতে জন্ম হলো ‘মারাদোনিয়ান চার্চ’ এর, যেটা আসলে ম্যারাডোনার নামে উপাসনালয়। আর সেই উপাসনা, স্তুতি যা–ই বলুন না কেন, সেটার ভিত হলো ‘ইগলেসিয়া মারাদোনিয়া’ বা ‘ডি১০এস’—ম্যারাডোনার নামে চালু হওয়া ধর্মের অন্য নাম। স্প্যানিশ ভাষায় ‘ডিআইওএস’ শব্দের অর্থ ‘সৃষ্টিকর্তা’। ১০ নম্বর কেন, সে তো সবারই জানা।
তবে আরেকটু আনুষ্ঠানিকতা বাকি ছিল। সেটা হলো পরের বছরের (২০০২) ২২ জুন।
২২ জুন ১৯৮৬। মেক্সিকোর আজতেকা স্টেডিয়ামে সেদিন ’৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে দুটি গোল করেন ম্যারাডোনা। একটি ‘হ্যান্ড অব গড’, আরেকটি সর্বকালেরই অন্যতম সেরা গোল।
সেই ম্যাচের ১৬ বছর পর একই দিনে, অর্থাৎ ২০০২ সালের ২২ জুন রোজারিওর সেজারিনি গ্রাউন্ডে জমায়েত হলেন ম্যারাডোনার অনুসারীরা। সেদিন প্রথমবারের মতো ‘মারাদোনিয়ান ইস্টার’ পালন করা হলো। পাশাপাশি ‘মারাদোনিয়ান ব্যাপ্টাইজড’ (ম্যারাডোনার ধর্মে দীক্ষা নেওয়া) হলেন ৪২ জন অনুসারী। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এখন থেকে প্রতিবছরের ২২ জুন ‘মারাদোনিয়ান ইস্টার’ পালন করা হবে। সেদিন কেউ এই ধর্মে দীক্ষা নিতে চাইলে তাঁর ‘পরীক্ষা’ নিয়ে দীক্ষিত করা হবে।
পরীক্ষা? সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। সবার আগে অন্য একটি কৌতূহলের রহস্য ভাঙতে হয়। এই প্রশ্ন জাগা খুব স্বাভাবিক যে স্রেফ ভালোবাসা থেকে কয়েক বন্ধু মিলে তৈরি করা এ ধর্মযাত্রা শুরুতে কতটা বাধার সম্মুখীন হয়েছিল?
পাঁচ বছর আগেই আর্জেন্টিনার অনলাইন সাময়িকী ‘এল গ্রাফিকো’কে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ভেরন, ‘শুরুতে আমাদের ধর্মসমাজ সাড়া ফেলেছিল। অনেকেই বিষয়টা বুঝতে পারেনি, বিশেষ করে ক্যাথলিক অনুসারীরা। তাদের বোঝাতে কিছুটা সময় লেগেছিল যে আমাদের ধর্মটা আসলে খেলাধুলাকেন্দ্রিক এবং (প্রচলিত ধর্ম থেকে) একটু আলাদা।’
ভেরনের পরের কথাগুলো বেশ গভীর, ‘খ্রিষ্টানরা যেমন একত্র হয় এই বিশ্বাসে যে ঈশ্বর আকাশ থেকে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন, তেমনি আমরাও বিশ্বাস করি—ঈশ্বর যেকোনো মুহূর্তে আমাদের সামনে উপস্থিত হতে পারেন। আমরা এখনো আশা হারাইনি যে কোনো এক দিন কেউ দরজায় কড়া নাড়বে, আর তিনি হবেন ডিয়েগো।’
প্রশ্ন হচ্ছে, ভেরন এই কথাগুলো বলেছিলেন কেন? ‘ইগলেসিয়া মারাদোনা’ নামের এই ধর্মের উদ্ভবের সময় ম্যারাডোনা জীবিত। এই ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে অনেকবারই তাঁর দেখা হয়েছে। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে আর্জেন্টাইন ফুটবল–‘ঈশ্বর’ এবং তাঁর অনুসারীদের মধ্যে। জন্মদিনে ম্যারাডোনা নিজেই রোজারিওতে তাঁর চার্চে ফোন করে অনুসারীদের শুভেচ্ছা জানাতেন। কিন্তু ভেরনের এই কথাগুলো এল গ্রাফিকোয় যেদিন (২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর) প্রকাশিত হলো, সেদিন আর তিনি এই মর্ত্যে নেই। ভেরন–এরনানরা তাই আজও চার্চের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে শোনার অপেক্ষায়।
সেই অপেক্ষাটা আসলে কেমন, ২০০৮ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে তা প্রকাশ করেছিলেন আমেরিকান লেখক ও সাংবাদিক জোনাথন ফ্রাঙ্কলিন।
রোজারিওতে গিয়ে দেখে এসেছিলেন কেউ ‘মারাদোনিয়ান’ ধর্মে দীক্ষিত হতে চাইলে সেই প্রক্রিয়াটা কী। ম্যারাডোনা তখন জীবিত। তাই ‘ঈশ্বর’ তাঁর চার্চের দরজায় কড়া নাড়বেন, সেই প্রত্যাশা নয়, একটা ফোন পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতেন সবাই। জোনাথন নিজেই মারাদোনিয়ান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে দেখেছিলেন সেই সব অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
***
উপাসকেরা এত জোরে আওয়াজ করছিলেন যে একটু উঁচু বেদিতে দাঁড়ানো পাদরির কথা শুনতে কষ্ট হচ্ছিল সামনের কাতারে দাঁড়ানো জোনাথনের। শত শত ‘মারাদোনিয়ান’ সমবেত হয়ে এক সুরে পাঠ করছিলেন তাঁদের নিজস্ব আঙ্গিকে বানানো প্রার্থনা, যেটা শুনলে খ্রিষ্টধর্মের প্রার্থনার সঙ্গে কিছুটা মিল পেতে পারেন—
‘আওয়ার ডিয়েগো
হু আর্ট অন আর্থ
হ্যালোড বাই দাই লেফট ফুট
দাই ম্যাজিক কাম
দাই গোলস বি রিমেম্বারড’
প্রার্থনা শেষে কক্ষের আলোটা বেশ কমে এল। একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে গা ছমছমে অনুভূতি। সাদা আলখাল্লা পরা ছয়জন ব্যক্তি (পিঠে ম্যারাডোনোর ১০ নম্বর) সবার সামনে এসে দাঁড়ালেন। অল্প বয়সী এক ছেলে এই ছয় পাদরির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের সহকারীর ভূমিকায়। ছেলেটির হাতে একটি ফুটবল। বলটিকে দেখে মনে হয় অত্যাচারে জর্জরিত। ছোপ ছোপ রক্ত গড়িয়ে পড়ছে বল থেকে। আর বলের ওপরিভাগে তার দিয়ে বানানো কাঁটার মুকুট বসানো (ঠিক ধরেছেন, যিশুখ্রিষ্টের মতো)। ছেলেটির পেছনে বিশাল এক ছবি। ছবির সেই মানুষকে উপাসনা (প্রশংসা, স্মরণ) করতে এসেছেন সবাই। ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা!
ম্যারাডোনা সন্ত নন, সুপারহিরোও নন। স্রেফ রক্তমাংসের একজন মানুষ, যিনি ফুটবলটা কারও কারও চেয়ে ভালো (দুঃখিত) খেলতেন। তবু আর্জেন্টাইনদের জীবনে তাঁর উপস্থিতি কার্লোস গার্দেল, ইভা পেরন কিংবা চে গুয়েভারার মতোই প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। ট্যাঙ্গোর ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য গার্দেল, রাজনীতিবিদ ইভা কিংবা বিপ্লবী গুয়েভারাকে নিয়ে সেখানে কেউ ধর্মের উদ্ভব ঘটানোর কথা ভাবেনি। তবে ম্যারাডোনাকে নিয়ে কেন?
উত্তরটা দিয়েছিলেন নোবেলজয়ী দক্ষিণ আমেরিকার প্রখ্যাত লেখক মারিও ভার্গাস ইয়োসা, ‘ম্যারাডোনা আশির দশকের পেলে। গ্রেট খেলোয়াড়? তার চেয়েও বেশি কিছু; জীবন্ত এক দেবদূত যাকে মানুষ পূজা করে।’
কেন পূজা করে, সেই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন পেরুর এই লেখক, ‘মানুষের সমকালীন নায়কের প্রয়োজন পড়ে, যাকে সে পূজা করতে পারে, অনুসরণ করতে পারে। কোনো দেশই এই ধারার বাইরে নয়। সভ্য বা অসভ্য, ধনী কিংবা দরিদ্র, পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক—প্রতিটি সমাজই কোনো না কোনো সময় রক্তমাংসের মানুষকে দেবতার আসনে বসিয়ে তাঁর সামনে ধূপ জ্বালানোর আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। ফুটবলাররাই সম্ভবত সবচেয়ে নিরীহ মানুষ, যাঁদের ওপর এই পূজারি মনোভাবটি আরোপ করা যায়। অবশ্যই তাঁরা রাজনীতিক বা যোদ্ধাদের চেয়ে অসীমভাবে নিরীহ...কোনো ফুটবলারের প্রশংসা করা মানে আসলে বিশুদ্ধ কবিতা বা বিমূর্ত চিত্রকলার মতো কিছু একটাকে ভালোবাসা।’
ম্যারাডোনার প্রতি মানুষের সেই নিঃশর্ত ভালোবাসার বয়ানেই জোনাথনের অভিজ্ঞতায় ফিরতে হয়।
‘মারাদোনিয়ান’ অনুসারীদের কাতারে জোনাথনের পেছনেই টি–শার্ট পরা এক ব্যক্তি। তাঁর টি–শার্টের ওপর লেখা, ‘পোপ জার্মান হতে পারেন, কিন্তু ঈশ্বর আর্জেন্টাইন’। বদ্ধ ঘরে জোনাথনের কেমন গরম লাগতে শুরু করল। চারপাশে ঘামের গন্ধ। বিয়ারের কড়া গন্ধও! ম্যারাডোনার জীবনে তাকালে বিয়ারই তো প্রত্যাশিত, সেটা হোক না ধর্মসভা। অনুসারীদের হাতে হাতে বিয়ারের গ্লাস উঠে এল। জোনাথনসহ কয়েকজন ছোট্ট একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানালেন এই চার্চের ‘ঈশ্বর’কে—
‘তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ, অত্যাচার ও হত্যা করা হয়েছিল
মাঠ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল
পা কেটে (রূপক অর্থে) নেওয়া হয়েছিল
কিন্তু তিনি ফিরে এসে অলৌকিকতার পুনর্জন্ম দেন।’
চার্চে ২৯ অক্টোবর পেরিয়ে তখন ৩০ অক্টোবর রাত ১২টা। শুরু হলো পার্টি। ওয়েটারের হাতে শ্যাম্পেনের বোতল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। শব্দটা জোনাথনের কানে লাগল। কারণ, ফোনটি বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কক্ষজুড়ে পিনপতন নীরবতা। স্বয়ং ‘ঈশ্বর’ ফোন করেছেন!
কেউ একজন কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁর হাতভর্তি ম্যারাডোনার ট্যাটু। পাশেই তাঁর ছেলে দাঁড়িয়ে। জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। সে–ও বাবার মতোই ‘মারাদোনিয়ান’। লোকটির ইচ্ছা তাঁর ছেলে যেন এই চার্চে অন্তত পাদরিদের সহকারী হতে পারে। মারাদোনিয়ানরা এভাবেই তাঁদের এই ধর্মকে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছে। আরও একটি পথ আছে। ‘মারাদোনিয়ান’ ধর্মের অনুসারী নারী ও পুরুষের মধ্যে বিয়ে, যেটা ম্যারাডোনার নামে তৈরি করা চার্চেই হয়। এমন বিয়ের সংখ্যা অসংখ্য। জোনাথনকে ভেরন বলেন, ‘এই কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা বুঝিয়ে দেয় ম্যারাডোনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা কতটা নিঃশর্ত। ফুটবল আমাদের ধর্ম এবং অন্য সব ধর্মের মতো এই ধর্মেও অবশ্যই একজন ঈশ্বর থাকতে হবে। আমরা মাঠে তাঁর অলৌকিকত্ব ভুলব না কখনো।’
মঞ্চ থেকে জোনাথনকে ডাক দিলেন পাদরি, ‘এবার আপনার দীক্ষা নেওয়ার পালা।’
জোনাথন মঞ্চে উঠলেন। কী করতে হবে, কী বলতে হবে আগেই জানতেন। একটু ভয়ও করছিল তাঁর। কারণ, ভুল করলে অন্তত এবার আর দ্বিতীয় সুযোগ মিলবে না। মঞ্চের ওপর ’৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের গোলকিপার পিটার শিলটনের লাফানোর বেশ বড় এক পোস্টার, যেখান থেকে ম্যারাডোনা ও বলকে ফটোশপের মাধ্যমে মুছে ফেলা হয়েছে। জোনাথনকে এখন ম্যারাডোনার ভূমিকা নিতে হবে। বলটা পাদরি শূন্যে ছুড়ে দিলেন। জোনাথন ’৮৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার সেই গোলের মতোই লাফিয়ে মাথাটা একটু নিচু করে হাত দিয়ে গুঁতো মারলেন বলে। বলটা শিলটনের পোস্টারকে ফাঁকি দিয়ে জমা পড়ল। গোল নয় ব্যাপ্টাইজড! অর্থাৎ জোনাথন এখন ‘মারাদোনিয়ান’—নিবন্ধন বইয়ে সই করে অফিশিয়াল সদস্য হয়ে গেলেন।
চার্চে ২৯ অক্টোবর পেরিয়ে তখন ৩০ অক্টোবর রাত ১২টা। শুরু হলো পার্টি। ওয়েটারের হাতে শ্যাম্পেনের বোতল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। শব্দটা জোনাথনের কানে লাগল। কারণ, ফোনটি বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কক্ষজুড়ে পিনপতন নীরবতা। স্বয়ং ‘ঈশ্বর’ ফোন করেছেন! স্পিকার অন হলো। ওপাশ থেকে ম্যারাডোনা বললেন, ‘আমাকে এত ভালোবাসার জন্য এবং আমার জন্মদিনে একত্র হওয়ার জন্য তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’
কেউ কেউ অস্ফুটে কিছু একটা বলে উঠলেন। কেউ কেঁদে ফেললেন। এই মানুষগুলোর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। বিভিন্ন ধর্ম ও দেশের মানুষ সেখানে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ডেনমার্ক, ইতালির মতো দূরের দেশ থেকে এসেছেন শুধু ম্যারাডোনাকে একটু ভালোবাসতে। জনতার সেই কাতারের পাশেই একটি টেবিলের ওপর ‘মারাদোনিয়ান’দের শতচ্ছিন্ন পুরোনো বাইবেল। আসলে সেটা ম্যারাডোনার সেরা জীবনী হিসেবে স্বীকৃত বই ‘ইয়ো সয় এল ডিয়েগো (আই অ্যাম ডিয়েগো)’।
মঞ্চে তখন চলছিল কুইজ প্রতিযোগিতা। ম্যারাডোনার জীবন সম্বন্ধে কে কতটা জানেন, সেই লড়াই। তবে জোনাথনের আশ্চর্য হওয়ার তখনো বাকি। অন্য ধর্মের মতো এই ধর্মের অনুসারীদের সাল গণনার নিজস্ব রীতিও আছে। পৃথিবীতে তাঁদের সাল গণনা শুরু হয়েছে ম্যারাডোনার জন্মদিন থেকে (১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর), অর্থাৎ ‘আফটার ডিয়েগো’ (এডি)। এই হিসাবে ২০২৫ সাল আসলে ৬৫এডি!
জোনাথন এক অনুসারীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন ম্যারাডোনা সম্পর্কে। হোসে গাবিনো নামের সেই ভদ্রলোক সোজা কথায় বললেন, ‘ডিয়েগোকে স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছে। ঈশ্বর তাঁর সঙ্গে কথা বলেন না, তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে বলেন।’ গাবিনো না থেমেই জোনাথনকে বলেন, তাঁদের এই ধর্মের অনুসারীরা কখনো কমবে না, বরং বাড়বে, ‘আমি আমার সন্তানের নাম রেখেছি ডিয়েগো। এক ভক্ত মরবে, শত শত জন্মাবে।’
বাইবেলে যেমন ‘টেন কমান্ডমেন্টস’ আছে, তেমন কিছু ‘ইগলেসিয়া মারাদোনিয়া’ ধর্মেও তৈরি করেছেন অনুসারীরা।
মারাদোনিয়ান চার্চের ১০টি আদেশনামা:
১. বলে কখনো কলঙ্কের দাগ লাগে না।
২. ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
৩. ফুটবলের সৌন্দর্য ও ডিয়েগোকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসো।
৪. আর্জেন্টাইন জার্সির পক্ষে দাঁড়াও।
৫. গোটা পৃথিবীতে ডিয়েগোর অলৌকিকত্ব ছড়িয়ে দাও।
৬. সেই মন্দিরকে (স্টেডিয়াম) ভালোবাসো, যেখানে তিনি খেলেছেন এবং তাঁর জার্সিকে।
৭. ডিয়েগো কোনো নির্দিষ্ট একটি দলের নন।
৮. মারাদোনিয়ান চার্চের আদর্শ ছড়িয়ে দাও।
৯. তোমার নামের মাঝের অংশটুকু ‘ডিয়েগো’ রাখো।
১০. প্রথম সন্তানের নাম রাখো ডিয়েগো।
অবশ্যই আপনি এ নিঃশর্ত ভালোবাসাকে পাগলামি বলতে পারেন। তাহলে এটাও জানিয়ে রাখতে হয়, মারাদোনিয়ান চার্চ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। স্পেন, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড, জাপান, আফগানিস্তান, পেরু, ব্রাজিল, চিলি, মেক্সিকো, উরুগুয়ে ও যুক্তরাস্ট্রে বিস্তৃত এই চার্চ। শুধু স্পেনেই মারাদোনিয়ান ধর্মের অনুসারীসংখ্যা প্রায় হাজার দশেক। ২০২১ সালে মেক্সিকোয় এই চার্চের উদ্বোধনের সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছিল, পৃথিবীতে মারাদোনিয়ান ধর্মের অনুসারীসংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি। তবে অন্য সব সংবাদমাধ্যমের মতে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হবে। অনুসারীদের মধ্যে আছেন লিওনেল মেসি, রোনালদিনিও, রিও ফার্ডিনান্ডের মতো কিংবদন্তিরা। রোনালদিনিও তো রোজারিও চার্চে খবর পাঠিয়ে অনুসারী হয়েছিলেন।
প্রশ্ন হলো, তাহলে তো পৃথিবীতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ম্যারাডোনার এই অনুসারীরাই আসলে পাগল। সত্যিই কি তা–ই? অবশ্যই না, আবার হ্যাঁ–ও। কারণ, আমরা সবাই জানি ভালোবাসার বশে মানুষ পৃথিবীতে অদ্ভুত সব কাজ করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। জোনাথন দেখলেন, এক লোক নিমগ্ন মনে প্রার্থনা করছে—
‘আমি ডিয়েগোতে বিশ্বাস করি,
সর্বশক্তিমান ফুটবল খেলোয়াড়।
জাদু ও আবেগের স্রষ্টা।
আমি পেলুসাতে বিশ্বাস করি—আমাদের রাজা, আমাদের প্রভু,
ফুটবলের রাজাদের অনুগ্রহে এই ধরায় এসেছিলেন।
তিনি জন্মেছিলেন ভিলা ফিওরিতোতে,
হাভেলাঞ্জের শাসনে কষ্ট ভোগ করেছিলেন,
ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন, মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং সমাধিস্থ হয়েছিলেন,
খেলার মাঠ থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন,
কিন্তু ফিরে এসে অলৌকিকত্বের পুনর্জন্ম দেন।
তিনি আমাদের হৃদয়ে থাকবেন,
অনন্তকাল।’
রোজারিও, স্পেন, ব্রাজিল অথবা পৃথিবীর কোনো এক কোণে, যেখানে মারাদোনিয়ান চার্চ আছে, সেখানে আজ নিশ্চয়ই এমন প্রার্থনা চলছে? আজ যে ‘ঈশ্বর’–এর জন্মদিন। শুধু একটাই কষ্ট। কেউ আর ফোন দেবে না কোনো দিন।
তবু দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনার অপেক্ষাটা চিরকালের।
ভালোবাসা যে এমনই হয়।