মেসির সঙ্গে মাস্তানতুনো
মেসির সঙ্গে মাস্তানতুনো

মেসির উত্তরসূরি এ কোন নতুন ‘মাস্তান’

‘এই নষ্ট শহরে নাম না জানা যে কোনো মাস্তান’— ‘মাস্তানতুনো’ নামটা সামনে আসতেই মনে পড়ল ফরহাদ মজহারের লেখা ও সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া গানটার কথা। নাহ, নামটা বাংলা কোনো নাম নয়। ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা গেল, এই নামটি এসেছে ইতালি থেকে। তবে ওই যে কথায় বলে, ‘এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি’, এখানেও বিষয়টাও অনেকটা তেমনই কাকতালীয়।

অবশ্য আমাদের মেলানোটাও খানিকটা জোরপূর্বকই। নয়তো ‘মাস্তান’ ও ‘মাস্তানতুনো’ যে এক নয়, সেটা দুই শব্দের উচ্চারণ ও দর্শনই বলে দেয়। তবু স্বনামে বিখ্যাত হওয়ার পর ফ্রাঙ্কো মাস্তানতুনোকে বাংলাদেশিরা আদর করে মাস্তান বলে ডাকবে না, সেটাইবা কে বলতে পারে!

মাস্তানতুনো এখন পর্যন্ত ফুটবল দুনিয়ায় খুব জনপ্রিয় কোনো নাম নয়। আর্জেন্টিনার ঘরোয়া ফুটবলের খবর না রাখলে তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি মানুষের জানারও কথা নয়। তবে যে কেউ চাইলে ইউটিউবে গিয়ে মাস্তানতুনোর খেলার কিছু ঝলক দেখে নিতে পারেন। ড্রিবল করে প্রতিপক্ষকে নাকানি খাওয়ানো, উইং ধরে আগ্রাসীরূপে আক্রমণে যাওয়া কিংবা নিখুঁত ফ্রি-কিকে গোলরক্ষককে বোকা বানানোর দারুণ সামর্থ্য আছে বাঁ পায়ের এই ফুটবলারের।

মাঠে নামার অল্প সময়ের মধ্যে মাঝমাঠে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন মাস্তানতুনো। এককভাবে ম্যাচের ধারা বদলে দেওয়ার সক্ষমতা যেমন আছে, তেমনি সতীর্থদের দিয়েও করাতে পারেন দারুণ সব গোল। তাঁর পাসগুলোও যেন বয়সের চেয়েও বেশি পরিপক্ব। আর খাটো উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে মার্কারদেরও সহজে বোকা বানাতে পারেন ১৭ বছর বয়সী এই কিশোর।

নান্দনিকতা ও ক্র্যাফটের দিক থেকে মাস্তানতুনো অনেক সময় মনে করিয়ে দেন মেসির কথা। আর্জেন্টিনায় বাড়ি হওয়ায় মেসির সঙ্গে তুলনা হওয়াটা স্বাভাবিকও। ফুটবল বিশ্লেষক স্কট ক্রিস্টিনসেনের মতো কেউ কেউ অবশ্য তাঁর খেলার সঙ্গে ফিল ফোডেনের খেলার মিল খুঁজে পান। কিছু মিল যে আছে সেটা স্বীকার করেই বলতে হয়, মাস্তানতুনো যেন আরও বেশি পরিপূর্ণ ফুটবলার।

আর্জেন্টিনার তরুণ তুর্কি মাস্তানতুনো

তাঁর কাছে সেরা হওয়ার মতো সব রসদই আছে। বিশেষ করে সৃষ্টিশীলতা ও কারিকুরিতে ফোডেনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সামর্থ্য আছে তাঁর। এমনকি তাঁর কিছু কিছু পায়ের কাজ মনে করিয়ে দিতে পারে নেইমারের কথাও। তবে মিল যার সঙ্গেই থাকুক, কিছুদিনের মধ্যে এই উদীয়মান ফুটবলার যে নিজের নামেই সুবাস ছড়াবেন, সেটা অনুমান করা যায়।

রিভার প্লেটে খেলা মাস্তানতুনোর জন্ম বুয়েনস এইরেস প্রদেশের শহর আজুলে। শৈশবে অবশ্য ফুটবল ও টেনিস দুটোতেই মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টাইনদের হৃদয় উৎসারিত খেলা ফুটবলকেই বেছে নেন তিনি। ২০১১ সালে রিভার দি আজুলের বয়সভিত্তিক দলের হয়ে যাত্রা শুরু হয় তাঁর। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।

এরপর ক্লাব সিমেন্টোতে এক বছর থেকে তিনি চলে যান আর্জেন্টিনার সেরা ক্লাবগুলোর একটি রিভার প্লেটে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ক্লাবটির বয়সভিত্তিক দলে থেকে এরপর মূল দলের হয়ে খেলা শুরু করেন মাস্তানতুনো। রিভার প্লেটের মূল দলে খেলা শুরুর পরই তিনি সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে আসেন। আর এখন তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে রেখেছে ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলো।

ট্রান্সফারমার্কেটের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো দামের এই মিডফিল্ডারকে পেতে এখন ক্লাবগুলোর লাইন লেগেছে। এরই মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, আর্সেনাল, চেলসি ও বার্সেলোনার আগ্রহের কথা জানা গেছে।

অনুশীলনে প্রস্তুত হচ্ছেন মাস্তানতুনো

আগ্রহী ক্লাবগুলোর নামই বলে দিচ্ছে, দলবদলের বাজারে মাস্তানতুনোকে নিয়ে উত্তেজনা চরমে উঠতে যাচ্ছে। উদীয়মান এই ফুটবলারকে ঘিরে আগ্রহের আরেকটি কারণ, তাঁর পজিশন ও খেলার ধরন। ইউরোপিয়ান ফুটবলে সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনের খেলোয়াড়ের কদর বেশ বেড়েছে। কোচরাও এমন আগ্রাসী ও গতিময় একজন ফুটবলারের খোঁজে তক্কে-তক্কে থাকেন।

আর স্কোয়াডে এমন একজন ফুটবলার অন্তত তিনজন খেলোয়াড়দের অভাব মেটাতে পারেন। ফলে মাস্তানতুনো যে ইউরোপিয়ান জায়ান্টদের আরাধ্য হতে যাচ্ছেন, তা বলাই যায়। ক্রিস্টিনসেনও মনে করছেন, মাস্তানতুনোর ইউরোপে যাওয়া এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার।

এমনকি তাঁর ইউরোপ যাত্রা ভেঙে দিতে পারে আর্জেন্টাইন দলবদলের রেকর্ডও। আর্জেন্টিনার ইতিহাসে সবচেয়ে দামে বিক্রি হওয়া ফুটবলার হ্যাভিয়ের সাভিওলা। প্রায় ২৫ বছর আগে ৩ কোটি ৭০ লাখ ইউরোতে রিভার প্লেট ছেড়ে বার্সেলোনায় গিয়েছিলেন সাভিওলা। সেই রেকর্ডকে পেছনে ফেলার সুযোগ আছে মাস্তানতুনোর।  
বছরের পর বছর ধরে ফুটবলকে অসামান্য সব নক্ষত্র উপহার দিয়েছে আর্জেন্টিনা।

আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, মারিও কেম্পেস, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, হুয়ান রিকেলমে এবং লিওনেল মেসিসহ সাম্প্রতিক সময়ের হুলিয়ান আলভারেজ বা এনজো ফার্নান্দেজদের কথা বলা যায়। সেই ধারাতেই এবার সামনে এসেছেন মাস্তানতুনো। এখন সামনের দিনে ফুটবল দুনিয়ায় মাস্তানতুনো নিজের ‘মাস্তানি’ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।