১৯ আগস্ট সকালে টটেনহাম জানত, ক্রিস্টাল প্যালেস থেকে এবেরেচি এজেকে কিনতে যাচ্ছে তারা। দুই ক্লাবের কথাবার্তা চূড়ান্ত, নিজেদের দিক থেকে কাগজপত্রও প্রস্তুত করে রেখেছিল টটেনহাম। কিন্তু দিন পেরোতেই দৃশ্যপট বদলে গেল। জানা গেল, এজে টটেনহামে আসছেন না। আর্সেনালে নাম লেখাচ্ছেন। ক্রিস্টাল ও আর্সেনালের মধ্যে ৯ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারে চুক্তির সমঝোতাও হয়ে গেছে।
২৭ বছর বয়সী এজের টটেনহামের গাড়িতে ওঠার আগমুহূর্তে আর্সেনালে উঠে পড়াটাকে বলা যায় ‘হাইজ্যাক’। ফুটবল ট্রান্সফারে এমন ঘটনার প্রায়ই দেখা মেলে। এক দলে নাম লেখানোর প্রায় সবই চূড়ান্ত, হঠাৎ করে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় অন্য ক্লাব। ফুটবল ট্রান্সফারের এমনই স্মরণীয় চারটি ঘটনা জানুন।
১৯৮৮ সালের ঘটনা এটি। নিউক্যাসল মিডফিল্ডার পল গাসকোয়াইনকে দলে নেওয়ার কথা পাকা করে ফেলেছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ অ্যালেক্স ফার্গুসন। গ্রীষ্মের ছুটিতে ফার্গুসন যেদিন মাল্টায় রওনা দেন, এর আগের রাতেও সব ঠিকঠাক। গাসকোয়াইন ইউনাইটেড কোচকে বলেন, ‘তুমি যাও, ভ্রমণটা উপভোগ করো। আমি ইউনাইটেডেই সই করব।’
পরে ১৯৯৯ সালে ফার্গুসন আত্মজীবনীতে লেখেন, মাল্টায় বসে তিনি ইউনাইটেড চেয়ারম্যান মার্টিন এডওয়ার্ডসের ফোন পান, ‘গাসকোয়াইন তো টটেনহামে সই করেছে’।
গাসকোয়াইন নিজের আত্মজীবনীতে লেখেন, ১ লাখ পাউন্ড সাইনিং ফি পাওয়ার পর এর মধ্যে ৭০ হাজার পাউন্ড খরচ করেছিলেন মা–বাবার জন্য বাড়ি কিনে দিতে। টটেনহামে তিনি সই করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ রেকর্ড ২২ লাখ পাউন্ডে। মূলত বড় অর্থ দিয়েই তাঁকে ইউনাইটেড থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল টটেনহাম। গাসকোয়াইন চার বছর টটেনহামে ছিলেন, এ সময়ে দলটির বড় সাফল্য বলতে ১৯৯১ এফএ কাপ।
নটিংহাম ফরেস্ট ছেড়ে ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সে নাম লেখাবেন—কথা দিয়েছিলেন রয় কিন। ৪০ লাখ পাউন্ড ট্রান্সফার ফি–ও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। ব্ল্যাকবার্ন কোচ কেনি ডালগ্লিশের সঙ্গে হাতও মিলিয়ে ফেলেন কিন। বাকি ছিল চুক্তি সই। তবে সই করার আগে ডালগ্লিশ দেখেন, সব কাগজপত্র প্রস্তুত হয়নি। তখন শুক্রবার বিকেল, অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। পরের দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি, ব্ল্যাকবার্নের কার্যালয় বন্ধ। ঠিক হয়, সোমবার সকালে চুক্তি সইয়ের কাজ সেরে নেওয়া হবে।
এদিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অ্যালেক্স ফার্গুসনের কানে যায় বিষয়টি। তিনি কিনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, ইউনাইটেডে আগ্রহ আছে কি না। তাঁর দলের কাছে সব কাগজপত্র প্রস্তুত আছে বলেও নিশ্চিত করেন। ব্যস, শনিবারই ৩৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে ইউনাইটেডে নাম লেখান কিন, যা তখনকার ব্রিটিশ রেকর্ড।
পরে ‘স্টিক টু ফুটবল’ পডকাস্টে রয় কিন আচমকাই ইউনাইটেডে যোগ দেওয়া নিয়ে বলেন, ‘ডালগ্লিশের সঙ্গে আমি হাত মিলিয়েছিলাম আর স্কটল্যান্ডে একবার হাত মেলানো মানেই চুক্তি চূড়ান্ত। যদি সেই রাতেই (যেদিন আমি প্রথম ব্ল্যাকবার্নে যোগ দিতে রাজি হয়েছিলাম) সবকিছু সেরে ফেলা হতো, আমি ব্ল্যাকবার্নেই সই করতাম। তাদেরও এর দায় নিতে হবে।’
সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় ট্রান্সফার টানাপোড়েনের একটি। জন ওবি মিকেলের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেওয়া এতটাই নিশ্চিত ছিল যে তাঁকে নতুন খেলোয়াড় হিসেবে উপস্থাপনও করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই শুরু হয়, যার পরিণতিতে তিনি যোগ দেন চেলসিতে।
নরওয়ের ক্লাব লিনে ছিলেন মিকেল। ২০০৫ সালে নাইজেরিয়ান এই মিডফিল্ডার ১৮ বছর পূর্ণ করার পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ঘোষণা দেয় যে তারা মিকেলকে সই করিয়েছে। এমনকি তাঁকে জার্সি পরিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়। কিন্তু পরে জানা যায়, তাঁকে এজেন্ট ছাড়া চাপ দিয়ে চুক্তি করানো হয়েছিল। মিকেল হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে লন্ডনে চলে যান, যেখানে তিনি জানান যে তাঁর আসল ইচ্ছা ছিল চেলসিতে যোগ দেওয়া।
এ নিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, লিন এবং ফিফার মধ্যে আইনি টানাপোড়েন শুরু হয়। ইউনাইটেড চেলসিকে অপহরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করে, আবার লিনও ফিফার কাছে অভিযোগ তোলে। শেষ পর্যন্ত জুন ২০০৬ সালে সমঝোতা হয়—চেলসি ১ কোটি ৬০ লাখ পাউন্ড দিয়ে মিকেলকে দলে ভেড়ায়। এর মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ পায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, বাকি ৪০ লাখ লিন।
পরে লিনের পরিচালক মরগান অ্যান্ডারসেন জালিয়াতি ও মিথ্যা অভিযোগের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এবং স্থগিত কারাদণ্ড পান। চেলসি পরে তাঁর ও লিনের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ দাবি করলেও বিষয়টি আদালতের বাইরে মিটমাট হয়। এককথায় মিকেলের ট্রান্সফার ছিল এক পাগলাটে নাটক, যা শেষ পর্যন্ত চেলসির জয়ে শেষ হয়। মিকেল ১১ বছর চেলসিতে ছিলেন।
২০১৩ সালের আগস্টের ঘটনা এটি। টটেনহাম ভেবেছিল উইলিয়ানকে পাওয়া নিশ্চিত। ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার নর্থ লন্ডনের ক্লাবটির হয়ে মেডিকেলও শেষ করেছিলেন। কিন্তু টটেনহামের ট্রেনিং গ্রাউন্ড থেকে উইলিয়ানকে ‘ছিনতাই’ করে নিয়ে যায় চেলসি।
উইলিয়ান পরে দ্য অ্যাথলেটিককে বলেন, ‘আমি দুই সপ্তাহ লন্ডনে ছিলাম, অপেক্ষা করছিলাম, টটেনহাম যেন সিদ্ধান্ত নেয়। তখন গ্যারেথ বেল রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল। আমাকে নিয়ে লিভারপুলও আগ্রহী ছিল। চেলসির আগ্রহ ছিল, তবে প্রথমে খুব জোরালো ছিল না। চেলসি এগিয়ে আসে ঠিক যেদিন আমি স্পার্সের সঙ্গে চুক্তি সই করতে যাচ্ছিলাম। আমি টটেনহামের ট্রেনিং গ্রাউন্ডে ছিলাম চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য, তখন ফোন এলো। আমার এজেন্ট বলল, ‘‘চেলসি আমাকে ফোন দিয়েছে, তারা তোমাকে চায়।’’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি ওখানেই যেতে চাই!’
পরের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে—‘তারপর আমি ট্রেনিং গ্রাউন্ড থেকে বের হয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম। পরিস্থিতিটা বেশ জটিলই ছিল। কারণ, আমি মোটামুটি টটেনহামে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মনে তখন শুধু চেলসি। এটা আমার ক্যারিয়ারের সেরা সিদ্ধান্ত ছিল।’
বর্তমানে ফুলহামে খেলা উইলিয়ান ২০২০ পর্যন্ত চেলসিতে ছিলেন। এ সময়ে জিতেছেন দুটি প্রিমিয়ার লিগ আর একটি ইউরোপা লিগের ট্রফি।