ক্লাব বিশ্বকাপের ট্রফি।
ক্লাব বিশ্বকাপের ট্রফি।

ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ: কী, কেন, কীভাবে

ফিফা বিশ্বকাপ বলতে অনেকে যা বোঝেন, জাতীয় দলগুলোকে নিয়ে আয়োজিত সেই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের জুন–জুলাইয়ে। এবারের জুন–জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ক্লাব নিয়ে আয়োজিত বিশ্বকাপ। আনুষ্ঠানিকভাবে যা ‘ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ’ নামে পরিচিত।

ক্লাব বিশ্বকাপ কি নতুন কিছু

না। ২০০০ সাল থেকেই ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ হয়ে আসছে। কখনো ৬ দল, কখনো ৭ দল নিয়ে। তবে বিভিন্ন মহাদেশের ক্লাব প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে আয়োজিত সেই বিশ্বকাপ খুব বেশি সাড়া ফেলতে পারেনি। বছরের শেষ দিকে ১০ দিনের মধ্যে অল্প কটি ম্যাচের মধ্যে শেষ হয়ে যেত ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ। এই করে করে এরই মধ্যে আয়োজিত হয়ে গেছে ২০টি আসর। তবে এবার ক্লাব বিশ্বকাপকে বৈশ্বিক রূপ দেওয়ার জন্য টুর্নামেন্টের কলেবর বাড়িয়েছে ফিফা। পৃথিবীর ছয় মহাদেশ থেকে অংশ নিচ্ছে মোট ৩২টি ক্লাব, যেমনটা জাতীয় দলের বিশ্বকাপে এত দিন হয়ে এসেছে।

ফরম্যাট কি বিশ্বকাপের মতোই

হ্যাঁ, জাতীয় দলগুলোকে নিয়ে আয়োজিত ফিফা বিশ্বকাপের মতোই (যদিও ২০২৬ আসরে অংশ নেবে ৪৮টি দেশ)। ৩২টি দল মোট ৮টি গ্রুপে ভাগ হয়েছে। প্রতি গ্রুপের সেরা দুই দল উঠবে শেষ ষোলোয়, সেখান থেকে একের পর এক নকআউট। এক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি শহরে অনুষ্ঠিত হবে মোট ৬৩টি ম্যাচ।

৩২ দল কীভাবে চূড়ান্ত হয়েছে?

দল চূড়ান্ত হয়েছে বিভিন্ন পদ্ধতিতে। মোটের ওপর সর্বশেষ চার মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়নদেরই জায়গা দেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ ১২টি ক্লাব আছে ইউরোপের, দক্ষিণ আমেরিকার আছে ৬টি। আবার অপেক্ষাকৃত দুর্বল ওশেনিয়া ফুটবল ফেডারেশন থেকেও দল আছে একটি। আয়োজক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি জায়গা। ২০২৪ এমএলএস সাপোর্টাস শিল্ড জিতে সেটি পেয়েছে ইন্টার মায়ামি। এমএলএস থেকে দল অবশ্য আরও একটি আছে। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী যোগ্যতা থাকলেও একই মালিকানার দুটি ক্লাব টুর্নামেন্টে খেলতে পারবে না। প্লে–অফের মাধ্যমে একটি চূড়ান্ত হবে। এই প্রক্রিয়ায় লস অ্যাঞ্জেলেস এফসি যুক্ত হয়েছে।

দলগুলো কারা

এশিয়া (এএফসি): আল হিলাল (সৌদি আরব), উরাওয়া রেড ডায়মন্ডস (জাপান), আল আইন (সংযুক্ত আরব আমিরাত), উলসান (দক্ষিণ কোরিয়া)।

আফ্রিকা (সিএএফ): আল–আহলি (মিসর), ওয়াইদাদ (মরক্কো), এসপেরানস দি তিউনিস (তিউনিসিয়া), মামেলোদি সানডাউনস (দক্ষিণ আফ্রিকা)।

উত্তর, মধ্য ও ক্যারিবিয়ান (কনক্যাকাফ): মনটেরি (মেক্সিকো), সিয়াটল সাউন্ডার্স (যুক্তরাষ্ট্র), পাচুয়া (মেক্সিকো), লস অ্যাঞ্জেলেস এফসি (যুক্তরাষ্ট্র)।

দক্ষিণ আমেরিকা (কনমেবল): পালমেইরাস (ব্রাজিল), ফ্ল্যামেঙ্গো (ব্রাজিল), ফ্লুমিনেজ (ব্রাজিল), বোতাফোগো (ব্রাজিল), রিভার প্লেট (আর্জেন্টিনা), বোকা জুনিয়র্স (আর্জেন্টিনা)।

ইউরোপ (উয়েফা): চেলসি (ইংল্যান্ড), রিয়াল মাদ্রিদ (স্পেন), ম্যানচেস্টার সিটি (ইংল্যান্ড), বায়ার্ন মিউনিখ (জার্মানি), পিএসজি (ফ্রান্স), ইন্টার মিলান (ইতালি), পোর্তো (পর্তুগাল), বেনফিকা (পর্তুগাল), বরুসিয়া ডর্টমুন্ড (জার্মানি), জুভেন্টাস (ইতালি), আতলেতিকো মাদ্রিদ (স্পেন), রেড বুল সালজবুর্গ (অস্ট্রিয়া)।

ওশেনিয়া (ওএফসি): অকল্যান্ড সিটি (নিউজিল্যান্ড)।

আয়োজক দেশের দল: ইন্টার মায়ামি (যুক্তরাষ্ট্র)।

ক্লাব বিশ্বকাপের ট্রফি যখন মিসরে।

কোন দেশের ফুটবলার বেশি

সবচেয়ে বেশি ১৪২ জন ফুটবলার আছে ব্রাজিলের। এ ছাড়া আর্জেন্টিনার আছে ১০০ জন। ক্লাব বিশ্বকাপে এক শর বেশি ফুটবলার আছেন শুধু এ দুই দেশেরই। এ ছাড়া স্প্যানিশ (৫৪), পর্তুগিজ (৪৯), আমেরিকান (৪২), মেক্সিকান (৪০), ফরাসি (৩৭), জার্মান (৩৬), ইতালিয়ান (৩৬), মরোক্কান (৩১) এবং দক্ষিণ আফ্রিকান (৩১) জন খেলোয়াড় আছেন বিভিন্ন ক্লাবে।

প্রাইজমানি কত

মোট প্রাইজমানি ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। অঙ্কটা বেশ বড়ই। জাতীয় দলগুলোকে নিয়ে আয়োজিত ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের প্রাইজমানি ছিল ৪৪ কোটি ডলার। মোট প্রাইজমানির অর্ধেকের বেশি খরচ হবে স্রেফ দলগুলোর অংশগ্রহণ বাবদ। যেমন ওশেনিয়ার দল অকল্যান্ড সিটি মাঠে যেমনই করুক, পাবে ৩৫.৮০ লাখ মার্কিন ডলার। আবার আফ্রিকা, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর ক্লাব পাবে ৯৫.৫০ লাখ ডলার করে। দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলোর জন্য বরাদ্দ ১ কোটি ৫২.১০ লাখ ডলার। আর ইউরোপের দলগুলো পাবে ১ কোটি ২৮.১০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৮১.৯০ লাখ ডলারের মধ্যে (ক্রীড়া ও বাণিজ্যিক মানদণ্ড অনুসারে)।

এ ছাড়া দলগুলোর প্রতিটি জয়–হার ও নকআউট অনুসারে অঙ্ক আরও বাড়বে। চ্যাম্পিয়ন দল পাবে ৪ কোটি ডলার। এই প্রাইজমানি যাবে ক্লাবের অ্যাকাউন্টে, খেলোয়াড়েরা কেমন পাবেন বা আদৌ পাবেন কি না, সেটা ক্লাবই সিদ্ধান্ত নেবে।

খেলা হবে কোথায়?

১২টি ভেন্যুতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধারণক্ষমতার মাঠ ক্যালিফোর্নিয়ার রোজ বোল, যেখানে আসন আছে ৮৮৫০০। এ ছাড়া নিউজার্সির মেটলাইফ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে পারবেন ৮২৫০০ দর্শক। ফাইনাল হবে এ মাঠেই। ২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালও এখানেই হওয়ার কথা।

নতুন কী আছে

ফিফার প্রতিটি টুর্নামেন্টে নতুন কিছু থাকে, ক্লাব বিশ্বকাপেও আছে। রেফারিদের শরীরে থাকবে ‘বডি ক্যামেরা’, যেটির ফুটেজ টিভি সম্প্রচারে ব্যবহার করা হবে। তবে বিতর্কিত দৃশ্যের ফুটেজ দেখানো হবে না। রেফারি এমন একটি ছোট ক্যামেরা পরবেন, যা তাঁদের কানে লাগানো ইয়ারপিস থেকে সামান্য বেরিয়ে থাকবে এবং রেফারির দৃষ্টিকোণ থেকে ভিডিও ধারণ করতে পারবে, যার মাধ্যমে সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান গোল কিংবা সেভের ভিন্নধর্মী অ্যাঙ্গেল দেখাতে পারবে, এমনকি ম্যাচ শুরুর আগের কয়েন টসের ক্লোজআপ লাইভ ভিডিও ও শব্দও সরাসরি সম্প্রচার করা যাবে। তবে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত বা বিতর্কিত মুহূর্তগুলো এই অ্যাঙ্গেল থেকে দর্শকদের দেখানো হবে না।

এই টুর্নামেন্টে আরও একটি নতুন নিয়মের প্রাথমিক প্রয়োগ দেখা যাবে। যেখানে গোলকিপারকে বল কুড়িয়ে নেওয়ার পর আট সেকেন্ডের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে, নইলে প্রতিপক্ষ কর্নার কিক পাবে। আগে গোলকিপার বল রাখতে পারতেন ৬ সেকেন্ড, দেরি করলে প্রতিপক্ষকে দেওয়া হতো পরোক্ষ ফ্রি–কিক। তবে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার আগে রেফারি এক হাতে আঙুল দেখিয়ে গোলকিপারকে পাঁচ সেকেন্ডের সতর্কবার্তা দেবেন।

যে তারকাদের দেখা যাবে না

দল খেলছে না বলে ক্লাব বিশ্বকাপে দেখা যাবে না লামিনে ইয়ামাল (বার্সেলোনা), মোহাম্মদ সালাহ (লিভারপুল), নেইমার (সান্তোস), ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (আল নাসর) ও বুকায়ো সাকাদের (আর্সেনাল)।

ফেবারিট কোন দল

সব সময়ের মতো ইউরোপের ক্লাবগুলোই। ক্লাব বিশ্বকাপের সর্বশেষ ২০ আসরের ১৬টিই জিতেছে ইউরোপের ক্লাব, এমনকি সর্বশেষ ১১টি টানা। তবে দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করতে পারে। লাতিন আমেরিকার মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট কোপা লিবার্তাদোরেসের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের বোতাফোগো যেমন অন্যতম ফেবারিট। ইউরোপের দলগুলোর মধ্যে স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ, বর্তমান উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাজয়ী পিএসজি আর জার্মান চ্যাম্পিয়ন বায়ার্ন মিউনিখকেও শিরোপার দাবিদার ধরা হচ্ছে।

সমালোচনা কেন

ক্লাব বিশ্বকাপ নিয়ে সমালোচনা মূলত খেলোয়াড়দের দিক থেকে। ফুটবলারদের বৈশ্বিক সংগঠন ফিফপ্রো ফিফা কর্তৃক ক্লাব বিশ্বকাপ আয়োজনকেই সঠিক মনে করছে না। যেমনটা বলেছেন লা লিগা প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের তেবাসও। ২০২৪ সালে শীর্ষস্থানীয় ফুটবলারদের বেশির ভাগ জুন–জুলাই ইউরো এবং কোপা আমেরিকায় ব্যস্ত ছিলেন। ২০২৬ সালে ব্যস্ত থাকবেন ফিফা বিশ্বকাপ নিয়ে। এবার যুক্ত হয়েছে ক্লাব বিশ্বকাপ। সারা বছর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলা ফুটবলারদের ওপর মৌসুমের বিরতিতেও চাপ হয়ে যাচ্ছে নিয়মিত, যা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর বলে বিভিন্ন খেলোয়াড়ের কথায় উঠে এসেছে।

শুরু আর শেষ কবে

উদ্বোধনী ম্যাচ ১৪ জুন (বাংলাদেশ সময় ১৫ জুন সকালে)। খেলবে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার মায়ামি ও মিসরের আল আহলি। ১৩ জুলাই ফাইনাল।