হংকংয়ের কাছে বাংলাদেশের ৪–৩ গোলে হারের পর সমর্থকদের কাঠগড়ায় কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। কোচের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে হারের জন্য তাঁকেই দায়ী করছেন তাঁরা। কিন্তু কতটা দায়ী তিনি?
এটি স্পষ্ট যে, কাবরেরার মধ্যে একধরনের একগুঁয়েমি রয়েছে। যা ভেবে রাখেন, সেটিই করেন। ৬০ মিনিটের পর জামালকে নামাবেন, অমুককে তুলবেন। এটা যেন মুখস্থ হয়ে গেছে; কিন্তু কোচিং গৎ বাঁধা নিয়মে চলে না।
কাবরেরাকে দেখে মনে হয়, চাকরি বাঁচানোর জন্য কাজ করেন। কাউকে খুশি করার চেষ্টা থাকে। তাঁর ম্যাচ পরিকল্পনা, কৌশল কাজে আসছে না। সঠিক জায়গায় সঠিক খেলোয়াড় দিতে পারছেন না অনেক ক্ষেত্রেই। পাশাপাশি সহকারীরা তাঁকে সঠিক তথ্য দেন কি না, সেটিও প্রশ্ন।
সবচেয়ে বড় কথা, কোচের সিদ্ধান্তের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। আজ একে নিচ্ছেন তো কাল ওকে বাদ দিচ্ছেন। কেন নিচ্ছেন কেন বাদ দিচ্ছেন সঠিক উত্তর নেই। যেমন ১০ জুন সিঙ্গাপুর ম্যাচে যাঁকে একাদশে রাখেন, সেই কাজেম শাহকে হংকং ম্যাচের ২৩ জনের দলেই রাখা হয়নি।
হংকং ম্যাচের প্রাথমিক দলে চারজন গোলকিপার ডাকা প্রয়োজন ছিল না, তবু তিনি ডেকেছেন। কোচ জামাল ভূঁইয়াকে অধিনায়ক রেখেছেন; কিন্তু তাঁকে খেলান না। খেলালেও বদলি হিসেবে এবং প্রতি ম্যাচেই গৎবাঁধা প্রায় একই সময়ে।
এখন পর্যন্ত একটি নির্ভরযোগ্য একাদশ তৈরি করতে পারেননি কাবরেরা। হামজা চৌধুরী, শমিত সোমরা আসার পরও নয়। পাশাপাশি স্বীকার করতে হবে, সামর্থ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে।
হংকংয়ের খেলোয়াড়েরা ব্যক্তিগত স্কিলে বাংলাদেশের ফুটবলারদের চেয়ে এগিয়ে। ফলে জয়টা তাদের প্রাপ্যই। চীনের শীর্ষ লিগে খেলেন হংকংয়ের কয়েকজন। বাংলাদেশের ফুটবল লিগের যে মান, তার চেয়ে ঢের ভালো চীনের লিগ। বাংলাদেশের লিগের মান না বাড়ালে খেলোয়াড়দের স্কিল বাড়বে না, আর স্কিলের কতটা দরকার তা বোঝা গেছে হংকং ম্যাচে।
হংকংয়ের হ্যাটট্রিকম্যান রাফায়েল মেরকিস চীনের সুপার লিগের ক্লাব শানডং তাইশানের হয়ে খেলছেন। ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া এই ফুটবলার একাই যেন হারিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। এই মানের ফুটবলার যত দিনে না আসবে, তত দিন নিজেদের চেয়ে ৩৮ ধাপ এগিয়ে দলকে হারানো কঠিন এবং শেষ সময়ে গোল খেয়ে আশাভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হবে।
কেউ বলতে পারেন, বাংলাদেশ দলে ইংলিশ ক্লাব লেস্টার সিটিতে খেলা ফুটবলার আছে। হ্যাঁ আছে। কিন্তু একজন হামজার পক্ষে কী আর করা সম্ভব! এই বাংলাদেশ দলে একজন হামজা চৌধুরী যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ দলের খেলা দেখে মনে হয়েছে, জিততে হলে আরও হামজা দরকার।
ভারতের বিপক্ষে গোলের সুযোগ কাজে লাগাতে না পারা থেকে শুরু করে হংকং ম্যাচে বাজে রক্ষণ—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ দল বারবার হোঁচট খাচ্ছে। হংকং ম্যাচে ডিফেন্ডারদের প্রতিপক্ষের ছক না পড়া, বিপজ্জনক মুহূর্তে তালগোল পাকিয়ে দলের জন্য বিপদ ডেকে আনা ব্যাক পাসও দেখতে হয়েছে। সব মিলিয়ে গোল খাওয়ার প্রতিযোগিতা যেন।
বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় সমস্যা—পুরো ৯০ মিনিট একই ছন্দে খেলতে না পারা। জিততে হলে ৯০ মিনিট মনোযোগ ধরে রাখতে হয়। কথাটা নিজে জামাল ভূইয়া বলেন হংকং ম্যাচের আগে; কিন্তু মাঠে তার বাস্তবায়ন হয়নি। শেষ মুহূর্তে স্নায়ুচাপে ভুগে ম্যাচ হাতছাড়া হওয়ার পুরোনো গল্প আবারও ফিরে এসেছে।
তবুও আশার কথা, হংকং ম্যাচে গোল করতে পেরেছে বাংলাদেশ। যেখানে পুরো বছরে মাত্র তিনটি-চারটির বেশি গোল করতে গলদঘর্ম অবস্থা হয়, এবার এক ম্যাচেই তিনটি গোল। এটা ইতিবাচক। আত্মবিশ্বাস বাড়াবে অবশ্যই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে গোল খাওয়ার পুরোনো সমস্যা থেকে মুক্তি মেলেনি। সেটিই সব পরিশ্রম ও আশা শেষ করে দিয়েছে।
হামজার আগমন ফুটবলে নতুন প্রাণ এনেছে। মানুষ মাঠে ফিরেছে, টিকিট বিক্রি বেড়েছে, টিভিতে খেলা দর্শকও এখন অনেক। বাফুফে ম্যাচের আগে কনসার্ট করছে (যদিও অপ্রয়োজনীয়))। হামজার উপস্থিতি ফুটবলের বাণিজ্যিক মূল্য বাড়িয়েছে। মাঠেও তিনি প্রত্যাশা পূরণ করছেন। রক্ষণে যেসব ব্লক করছেন, তা তাঁর মানের খেলোয়াড়ের পক্ষেই সম্ভব। লালসবুজ জার্সিতে চার ম্যাচে দুই গোল করে দেখিয়েছেন, শুধু রক্ষণে নয়, গোল করতেও সক্ষম তিনি; কিন্তু কারও না কারও ভুলের কারণে হামজার পরিশ্রম আর চেষ্টা সবই বৃথা যাচ্ছে।
অনেকে বলছেন, এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী দল। হামজা আছেন। কিন্তু ফুটবল এক ব্যক্তির খেলা নয়; এটি দলীয় খেলা। দল হিসেবে খেলতে না পারাই বাংলাদেশের বড় ব্যর্থতা। বাংলাদেশ দল আজ দুপুরে হংকং রওনা হয়েছে। ১৪ অক্টোবর হংকংয়ের সঙ্গে ফিরতি ম্যাচ। সে ম্যাচেও জয়ের আশার বাণী শুনিয়ে গেছেন কোচ কাবরেরা। কিন্তু জয়ের জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা, সঠিক দল নির্বাচন আর মাঠে পুরো ৯০ মিনিটের মনোযোগ। সেটির ঘাটতি কীভাবে পূরণ করবেন কাবরেরা?