
২০২৬ বিশ্বকাপে খেলবেন, নাকি খেলবেন না?
লিওনেল মেসির সামনে বিশাল এক সিদ্ধান্ত। বিশ্বকাপ শুরু হতে আর আট মাস বাকি, অথচ এখনো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না, তিনি আর্জেন্টিনার জার্সিতে শিরোপা ধরে রাখার মিশনে নামবেন কি না। ‘আমার বয়স যা, তাতে না খেলাটাই যৌক্তিক’, গত মাসে টিওয়াইসি স্পোর্টসকে বলেছিলেন ৩৮ বছর বয়সী মেসি।
কিন্তু মেসির জীবনে কখনো কিছুই তো ‘যৌক্তিক’ভাবে ঘটেনি।
তিনি ফুটবলের এক অলৌকিক মানব। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শারীরবিদ্যা ও পদার্থবিজ্ঞানের যাবতীয় সূত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফুটবল খেলাকে নিজের মতো বানিয়ে নিয়েছেন। খুব বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপেই মেসি যা করেছেন, সেটাও সম্ভব হওয়ার কথা নয়। বয়স তখন ৩৫, তবু তরুণদের মতো দৌড়েছেন, ইওস্কো গাভারদিওলের মতো তাঁর হাঁটুর বয়সী ডিফেন্ডারকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছেড়েছেন, গোলের পর গোল করে আর করিয়ে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। এর কোনো কিছুই কোনো সূত্র মেনে হয়নি।
তবু মেসি যদি হুট করে ঠিক করেন আর আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলবেন না, তাহলে আর্জেন্টিনা সামলাবে কীভাবে? কোচ লিওনেল স্কালোনি অনেকবার স্বীকার করেছেন, ‘ওটা (জাতীয় দল থেকে মেসির অবসর) হবে বিশাল ক্ষতি। কারণ, মেসির কোনো উত্তরসূরি নেই।’
মেসি আসলে বদলযোগ্য নন—খেলোয়াড় হিসেবে তো নয়ই, নেতা হিসেবেও না। কিন্তু মেসি কোনো একদিন বিদায় বলবেন। স্কালোনিকেও তাই প্রস্তুতি রাখতে হচ্ছে সেই ভবিষ্যতের জন্য।
সেই ভবিষ্যতের আর্জেন্টিনা কেমন হবে? স্কালোনি একটা আশার কথা শুনিয়ে রেখেছেন আর্জেন্টিনা সমর্থকদের, অধিনায়কের অনিবার্য অবসরের কারণে যে ক্ষতি হবে, তা সামাল দেওয়ার মতো খেলোয়াড় দলে চলে এসেছেন। নিকো পাজ তাঁদেরই একজন।
লাতিন আমেরিকার স্ট্রিট-ফুটবলারদের মধ্যে একরকম জন্মগত প্রতিভা থাকে, যেটা তাঁদের অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। নিকো পাজকে খেলতে দেখলে বোঝা যায়, তিনিও ওই ঘরানার। যদিও তাঁর জন্ম স্পেনের তেনেরিফেতে। তবে ডিএনএ তো লাতিনই। তাঁর বাবা পাবলো পাজ ছিলেন আর্জেন্টিনার সাবেক সেন্টারব্যাক। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ১৪ ম্যাচ, ১৯৯৮ বিশ্বকাপেও খেলেছেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, হাভিয়ের জানেত্তি, ডিয়েগো সিমিওনে, হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন, হার্নান ক্রেসপোদের মতো তারকাদের সঙ্গে।
বাবার মতো নিকো পাজও ছেলেবেলায় শুরু করেছিলেন রক্ষণেই। ১২ বছর বয়সেই যোগ দিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ একাডেমিতে। রিয়াল খুব দ্রুত বুঝে ফেলে, পাজের পায়ের সেই স্ট্রিট–স্কিল রক্ষণে নয়, আক্রমণেই উজ্জ্বল হবে। ফলে যখন ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর ব্রাগার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগে যখন পাজের অভিষেক হয়, তার আগেই তিনি রিয়াল মাদ্রিদের যুবদলে উইঙ্গার ও সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে নাম কামিয়ে ফেলেছেন।
তখনকার রিয়াল মাদ্রিদের কোচ কার্লো আনচেলত্তির একটা সমালোচনা প্রায়ই হতো—তিনি নাকি তরুণদের সুযোগ দেন না, বড় তারকাদের ওপরই আস্থা রাখেন। কিন্তু পাজকে অনেকবার মূল দলে ডেকেছেন আনচেলত্তি। খেলাতে না পারলেও সিনিয়র দলের অনুশীলনে রাখতেন সব সময়ই। সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার টনি ক্রুস তো পাজকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটা প্রতিদিন আমাদের সঙ্গে অনুশীলন করুক, ও খুব ভালো।’
কয়েক সপ্তাহ পরই আনচেলত্তি তাঁকে আবার নামান নাপোলির বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধের মাঝপথে, স্কোর তখন ২–২। সিদ্ধান্তটা কী যে কাজে দিয়েছিল! ম্যাচের শেষের দিকে পাজ বল পেয়ে বাঁ পায়ের দারুণ কাজে ঢুকে পড়েন নাপোলির সীমানায়, তারপর ২০ গজ দূর থেকে নিচু এক শটে করেন দারুণ এক গোল। পরে হোসেলু আরেক গোল করলেও ম্যাচ শেষে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু গলা ফাটাচ্ছিল নিকো পাজের নামে। ৪–২ গোলে সেই ম্যাচ জয়ের পর আনচেলত্তি বলেছিলেন, ‘ও রিয়াল মাদ্রিদের ভবিষ্যৎ। একজন মাদ্রিদ খেলোয়াড়ের যা যা থাকা দরকার, এই ছেলেটার মধ্যে আছে সবই আছে।’
২০২৩–২৪ মৌসুমে পাজ লা লিগায় খেলতে পারলেন মাত্র ৪টি ম্যাচ, চ্যাম্পিয়নস লিগে ৩টি। রিয়ালে মূল দলে যাঁরা চোটে ছিলেন, সবাই একে একে দলে ফিরলেন। পাজ আবার নেমে গেলেন রিজার্ভ দলে, স্প্যানিশ তৃতীয় ডিভিশনে। কিন্তু তাঁর আরও নিয়মিত শীর্ষ পর্যায়ে খেলার ইচ্ছা ছিল। তাই ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে পাজ দলবদলের অনুরোধ করেন ক্লাবের কাছে। রিয়ালও রাজি হয়, তবে শর্ত দেয়—চুক্তিতে অবশ্যই ‘বাই–ব্যাক ক্লজ’ রাখতে হবে। তাতে পাজও খুশি ছিলেন। কারণ এর মানে, বার্নাব্যুতে ফেরার সুযোগ থাকছে।
এরপর তাঁর জন্য বড় সিদ্ধান্ত ছিল, কোন দলে যাবেন? ইতালির কোমো তখন দারুণ আগ্রহী। ক্লাবের পরিচালক কার্ল আলবের্তো লুদি জানালেন, তাঁরা পাজকে ঘিরেই নতুন প্রজেক্ট গড়তে চান। লুদি পরে বলেছেন, ‘(পাজকে পেতে) অনেক দল আগ্রহী ছিল। আমরা তো সেই লড়াইয়ে প্রথম সারির দল ছিলাম না। কিন্তু ওকে নেওয়ার ব্যাপারে আমরা সবচেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম।’ আর তাঁদের হাতে ছিল এক বড় অস্ত্র, কোমোর কোচ সেস্ক ফ্যাব্রেগাস। বিশ্বকাপজয়ী স্প্যানিশ এই তারকার প্রভাবেই শেষ পর্যন্ত ৬০ লাখ ইউরোর চুক্তিটা সম্পন্ন হয়।
গ্রিসে তখন পরিবারের সঙ্গে ছুটিতে ছিলেন পাজ। হঠাৎ তাঁর বাবার ফোনে মেসেজ—প্রেরক ফ্যাব্রেগাস। ‘আমার জন্য সেটা দারুণ এক মুহূর্ত ছিল’, পরে বলেছিলেন পাজ। এরপরই কোমোকে ‘হ্যাঁ’ বলেন তিনি।
কোমোর অফিশিয়াল মিডিয়ায় পাজ পরে বলেছেন, ‘একজন কিংবদন্তি (ফ্যাব্রেগাস) যখন আপনার কোচ হন, সেটা অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। মাঠের ভেতরে–বাইরে দুটো জায়গাতেই তিনি আমাকে অনেক কিছু শেখান।’ দুজন একই ভাষায় কথা বলেন—ফুটবলের ভাষা।
ফ্যাব্রেগাস মিডফিল্ডে খেলার আনন্দ জানেন খুব ভালোভাবেই, পাজের কাছ থেকে সেই আনন্দ কখনো কেড়ে নিতে চাননি। ‘সবচেয়ে ভালো লাগে, তিনি আমাকে নিজের মতো খেলতে দেন, বল নিয়ে নিজের মতো অনেক কিছু করতে পারি’, কোচকে নিয়ে পাজের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস।
আর ফ্যাব্রেগাস তো বলেছেনই, ‘পাজ বিশেষ এক খেলোয়াড়। ওকে বেঁধে রাখা যাবে না।’ কোচের কাছ থেকে অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে পাজ কখনো হয়ে ওঠেন জিনেদিন জিদান, কখনো কাকা, কখনো তাঁর মধ্যে দেখা যায় মার্টিন ওডেগার্ডকেও।
কিন্তু যাঁর কাছ থেকে পাজ সবচেয়ে বেশি শিখেছেন, সেই লোকটার নাম লিওনেল মেসি। এখনো পাজ ইউটিউবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেসির ভিডিও দেখেন। বলেন, ‘তিনি কীভাবে শেষ পাসটা দেন, কখন বক্সে ঢুকতে হবে—এসব আমি শেখার চেষ্টা করি।’
২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রথমবার জাতীয় দলে ডাক পান পাজ। প্রথমবার মেসির সামনে গিয়ে তিনি প্রায় কথা হারিয়ে ফেলেছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘ওকে দেখলেই নার্ভাস হয়ে যাই, তাই বেশি কিছু বলতে পারিনি, লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম!’
মুখে কিছু না বলতে পারলেও মাঠে কথা বলেছেন ঠিকই এবং সেটা বল পায়ে। বলিভিয়ার বিপক্ষে ৬-০ গোলে জয়ের ম্যাচে তাঁর পাস থেকেই হ্যাটট্রিক হয়েছিল মেসির।
‘আমার ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত’, সেই ম্যাচের পর বলেছিলেন পাজ, ‘বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়কে অ্যাসিস্ট করা, সেটাও নিজের অভিষেক ম্যাচে! আমি ভাবতেই পারিনি, মেসির সঙ্গে খেলব।’
মুগ্ধ হয়েছিলেন মেসিও। বলেছিলেন, ‘নিকোর অনেক গুণ। ও খেলাটা বোঝে, মাথা ঠান্ডা রাখে। আমি আশা করি, এমনই থাকবে।’ পাশে থাকা সাংবাদিক মেসিকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বার্সেলোনায় অভিষেকের সময় পাজের বয়স ছিল মাত্র এক মাস। হাসতে হাসতে মেসি বলেছিলেন, ‘আমি জানি!’
এখন প্রশ্ন, আগামী গ্রীষ্মে বিশ্বকাপে মেসি–পাজ জুটিকে আবার দেখা যাবে কি? বয়সের ব্যবধান ১৭ বছর, কিন্তু পারফরম্যান্সে সে ফারাক যেন মুছে যাচ্ছে। পাজ ইতিমধ্যেই আর্জেন্টিনার হয়ে চার ম্যাচ খেলেছেন। আগামীকাল ভেনেজুয়েলা কিংবা এরপর পুয়ের্তো রিকোর বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে শুরুর একাদশে দেখা যেতে পারে তাঁকে। এই দুটি ম্যাচে মেসি খেলবেন কি না, এ নিয়ে সন্দেহ আছে। খেললে দুজনকে পাশাপাশিই দেখা যাবে হয়তো।
এরই মধ্যে কোমোর হয়ে দুর্দান্ত মৌসুম শেষে ২০২৪–২৫ সালে সিরি আর বর্ষসেরা তরুণ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন পাজ। এ মৌসুমেও ফর্ম আরও উজ্জ্বল—৬ ম্যাচে ৩ গোল, ৩ অ্যাসিস্ট। ফ্যাব্রেগাস মজা করে বলেছেন, ‘এখন ওর ওপর ডিফেন্ডাররা যে নজর দিচ্ছে, সেটা ভালো লক্ষণ। মেসির সময়ও আমি এমনই দেখতাম।’
ওদিকে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি বলেছেন, ‘নিকো একেবারে ঠিক জায়গাতেই আছে। সেস্ক (ফ্যাব্রেগাস) ওকে যেভাবে খেলায়, যেভাবে ওকে স্বাধীনতা দেয়—ওটা আমাদের জাতীয় দলের স্টাইলের সঙ্গেও মিলে যায়।’
এমন একটা ছেলে, যে জাতীয় দল হিসেবে স্পেনকেও বেছে নিতে পারত, সেই ছেলেটাকে আর্জেন্টিনায় পেয়েছেন বলে দারুণ খুশি স্কালোনি। মজা করে বলেছিলেন, ‘এই জায়গায় আমরা খুব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছি, তাই না?’
আর্জেন্টিনার হয়ে পাজের অভিষেক করিয়ে রাখা আসলেই একটা দারুণ সিদ্ধান্ত। মেসির বিদায়ে যে শূন্যতা তৈরি হবে, তা পূরণ করা তো অসম্ভব। তবু সেই শূন্যতার মাঝে নিকো পাজের মতো কেউ কেউ আলো জ্বালাবেন, এই আশা তো আর্জেন্টিনা করতেই পারে।