ফুটবলে বাইসাইকেল কিক: কীভাবে শুরু, প্রথমে কে মেরেছিলেন

নেপালের বিপক্ষে গত ১৩ নভেম্বর হয়ে যাওয়া প্রীতি ম্যাচটা জিততে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু সেই ম্যাচেই বাংলাদেশের হামজা চৌধুরীর অসাধারণ বাইসাইকেল কিকের গোল এ দেশের ফুটবলপ্রেমীদের চোখে লেগে থাকবে দীর্ঘদিন। হামজা-জাদুতে নতুন করে আলোচনায় এসেছে বাইসাইকেল কিক। ফুটবল মাঠে চোখজুড়ানো এই দৃশ্য, এই অ্যাক্রোবেটিক জাদুর জন্ম আসলে কোথায় হয়েছিল? জার্মান লেখক ও সাংবাদিক উলরিখ হেসে ও ফুটবল সাময়িকী ফোর ফোর টু-র সাবেক সম্পাদক পল সিম্পসন–এর লেখা হু ইনভেন্টেড দ্য বাইসাইকেল কিক: সকার’স গ্রেটেস্ট লেজেন্ডস অ্যান্ড লোর বইয়ে আছে এই প্রশ্নের উত্তর। আছে বাইসাইকেল কিক নিয়ে দারুণ সব গল্পও—

বাইসাইকেল কিক প্রথম কে মেরেছিলেন?

বিখ্যাত উরুগুইয়ান লেখক এদুয়ার্দো গালেয়ানো যদি ঠিক বলে থাকেন, তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। ফুটবল ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘চিলির বন্দর শহর তালকাহুয়ানোর মাঠে রামোন উনসাগা প্রথম এই কৌশল দেখান। তাঁর শরীর ছিল আকাশে ভাসমান, পিঠ মাটির দিকে, হঠাৎ পায়ের ঝটকায় বলটাকে পেছনের দিকে পাঠালেন, যেন কাঁচি দিয়ে কিছু কাটা হচ্ছে।’

রামোন উনসাগা, বাইসাইকেল কিকের জনক

গালেয়ানো সময় উল্লেখ করেননি। তবে প্রচলিত বিশ্বাস, ১৯১৪ সালের দিকে তালকাহুয়ানোতেই উনসাগা প্রথম এই কিক দেখান। বিলবাও থেকে মা–বাবার সঙ্গে ১৯০৬ সালে চিলিতে যাওয়া উনসাগা আক্রমণ ও রক্ষণ দুই ক্ষেত্রেই বাইসাইকেল কিক মারতে ভালোবাসতেন। ১৯১৬ ও ১৯২০ সালের কোপা আমেরিকায় তাঁর এই কৌশল দেখে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম এর নাম দেয় ‘লা চিলেনা’।

গল্পটা বেশ গোছানো। তবে পেরুর বৃহত্তম বন্দর শহর কলাও-এর লোকজন এই গল্প মানতে নারাজ। আর্জেন্টিনার সাংবাদিক হোর্হে বারাসার অনুসন্ধান বলছে, কলাও শহরের আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এক খেলোয়াড় ব্রিটিশ নাবিকদের সঙ্গে ম্যাচে প্রথম এই কৌশল দেখিয়েছিলেন। পেরুর ইতিহাসবিদ হোর্হে বাজাদ্রে লিখেছেন, সেই ঘটনাটি সম্ভবত ১৮৯২ সালের দিকে। বারাসার ধারণা, চিলিয়ানরা হয়তো পেরুর কলাও ও ভালপ্যারাইসো শহরের দলগুলোর ম্যাচ নিয়মিত দেখে এই কৌশল নকল করেছিল।

যে ক্রস থেকে বাইসাইকেল কিক হয়, সেটা আসলে ভালো ক্রস নয়।
ক্লাউস ফিশার, সাবেক জার্মান ফুটবলার

১৯৬৩ সালে লেখা উপন্যাস দ্য টাইম অব দ্য হিরো-তে লেখক মারিও ভার্গাস য়োসা লিখেছেন, কলাওয়ের মানুষ হাতের মতোই দক্ষতার সঙ্গে পা ব্যবহার করতে পারত। তাই বাইসাইকেল কিকের জন্ম সেখানে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে বিতর্কটা সেখানেই থামেনি। চিলি কিংবা পেরু কোনো দেশই এই চোখধাঁধানো কৌশল আবিষ্কারের কৃতিত্ব ছাড়েনি, ছাড়বেও না।

পেলের সেই বিখ্যাত বাইসাইকেল কিক

মজার বিষয় হলো, যে কৌশল আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিয়ে এত টানাটানি, সেটি আসলে তখনই সম্ভব হয় যখন অন্য কেউ তার কাজ ঠিকঠাক করতে পারে না। জার্মান বিজ্ঞানী হারমান শভামেদার যেমন বলেছেন, ফুটবলে বাইসাইকেল কিকের জন্য দরকার ‘অন্তর্দৃষ্টি, প্রচণ্ড সাহস আর একটা খারাপ ক্রস।’ বিশ্বকাপে সবচেয়ে বিখ্যাত সাইকেল কিক করা ক্লাউস ফিশারও একমত। ১৯৮২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে বাইসাইকেল কিকে গোল করা জার্মান এই ফরোয়ার্ড বলেছিলেন, ‘যে ক্রস থেকে বাইসাইকেল কিক হয়, সেটা আসলে ভালো ক্রস নয়।’

আবার একবার একটা খারাপ পেনাল্টি থেকেও জন্ম নিয়েছিল দুর্দান্ত বাইসাইকেল কিক। ২০১০ সালের মে মাসে হাঙ্গেরির লিগে হোনভেদ ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী ফেরেনসভারোসের বিপক্ষে। পেনাল্টি পায় তারা। ইতালিয়ান ফরোয়ার্ড অ্যাঞ্জেলো ভাকারো শট নেন। গোলরক্ষক বলটা ধরতে না পারলেও বাতাসে ঠেলে দেন। ভাকারো অপেক্ষা করছিলেন। বল নামতেই নিলেন বাইসাইকেল কিক। গোলরক্ষক আর ডিফেন্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে বল জালে!

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বাইসাইকেল কিক শটের গোল

কখনো কখনো বাইসাইকেল কিক আপনাকে কিংবদন্তি বানিয়ে দিতে পারে। কখনো আবার সেই খ্যাতি খুব বেশি টেকে না। ২০১২ সালের নভেম্বরে জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ  ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে দুর্দান্ত বাইসাইকেল কিক করেছিলেন, সেটাকে ইতিহাসের সেরাগুলোর একটি মনে করা হয়। কিন্তু সেই ইব্রাহিমোভিচই একই মাসে ফরাসি কাপের ম্যাচে সেঁত এতিয়েনের বিপক্ষে সেই কিক নকল করতে গিয়ে বলই মিস করেছিলেন!

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ম্যানচেস্টার ডার্বিতে ওয়েইন রুনি যে বাইসাইকেল কিকে গোল করেছিলেন, সেটি প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের সেরা গোল হিসেবে ভোট পেয়েছিল। যে গোলটা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রুনি অবশ্য ব্যাপারটাকে খুব বেশি রোমান্টিক করেননি। বলেছিলেন, ‘বল বক্সে আসতে দেখে ভাবলাম—দেখি, হয় কি না!’

হয়তো এই সরল ভাবনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এ কিকের আসল রহস্য। জীবনে এমন মুহূর্ত খুব কমই আসে, যখন আমরা মানবীয় ভুল (একটি বাজে ক্রস) খুব দ্রুত মানবীয় প্রতিভার (বাইসাইকেল কিক) মাধ্যমে এমন চমৎকারভাবে শুধরে যেতে দেখি।

বাইসাইকেল কিক করছেন জার্মানি সিলার

কখনো কখনো একটা ব্যর্থ বাইসাইকেল কিকও কারও কারও ভাগ্য বদলে দিতে পারে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র শেষ মুহূর্তে ২-১ গোলে জয়ের খুব কাছাকাছি। ঠিক তখনই মার্সেলো বালবোয়া এক দারুণ বাইসাইকেল কিক নিলেন। কিন্তু বলটা চলে গেল বাঁ পোস্টের গা ঘেঁষে বাইরে। যদি সেটা গোল হতো, ফুটবলের সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিওগুলোর একটি হতো নিঃসন্দেহে। তবু সেটি দেখে ডেনভারের বিলিয়নিয়ার ধনকুবের ফিলিপ আনশুটজ বলেছিলেন, ‘এই ছেলেকে আমি আমার দলে চাই।’ পরে তিনি বালবোয়াকে সই করান তাঁর ক্লাব কলোরাডো র‌্যাপিডসে। এবং পরে তিনি এতটাই ফুটবল–অনুরাগী হয়ে উঠলেন যে একসময় মেজর লিগ সকারের ১০টির মধ্যে ৬টি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে বিনিয়োগ করে ফেলেন! সুতরাং বালবোয়ার ওই মিস করা বাইসাইকেল কিকেই এমএলএসে নতুন যুগের শুরু হয়েছিল, এটা বোধ হয় বলাই যায়।

১৯২৭ সালে চিলির ক্লাব কোলো কোলো ইউরোপ সফরে গিয়েছিল। তাদের ২৪ বছর বয়সী স্ট্রাইকার, অধিনায়ক ও প্রতিষ্ঠাতা দাভিদ আরেল্লানো ওই সফরে এতবার বাইসাইকেল কিক মারেন যে স্পেনে তিনি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।

বাইসাইকেল কিকের আবিষ্কারক হিসেবে আরও কিছু দাবি আছে, তবে সেগুলো খুব শক্ত নয়। ব্রাজিলের কিংবদন্তি লিওনিদাস, শরীরের নমনীয়তার কারণে যাকে বলা হতো ‘রাবার ম্যান’, দাবি করেছিলেন তিনিই এই কিকের উদ্ভাবক। কিন্তু রেকর্ড বলছে, তিনি প্রথম এটা ব্যবহার করেন ১৯৩২ সালে, উনসাগার এক দশক পর। সময়ের হিসাবে আরও পিছিয়ে পড়েন জুভেন্টাসের সেন্টার ব্যাক কার্লো পারোলা, যিনি এত বেশি বাইসাইকেল কিক মারতেন যে ইতালিতে তাঁকে বলা হতো ‘সিনর রোভেসিয়াতা’ (মি. রিভার্স কিক)। অ্যাস্টন ভিলার চেয়ারম্যান ডগ এলিসও এই দাবি করেছিলেন, তিনি নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাউথপোর্টের হয়ে খেলার সময় এটি উদ্ভাবন করেছিলেন। কিন্তু তত দিনে এই শট বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করে ফেলেছে।

দাভিদ আরেল্লানো

১৯২৭ সালে চিলির ক্লাব কোলো কোলো ইউরোপ সফরে গিয়েছিল। তাদের ২৪ বছর বয়সী স্ট্রাইকার, অধিনায়ক ও প্রতিষ্ঠাতা দাভিদ আরেল্লানো ওই সফরে এতবার বাইসাইকেল কিক মারেন যে স্পেনে তিনি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এক ম্যাচে বাইসাইকেল কিক মারতে গিয়েই তিনি ভায়াদোলিদের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে বিশাল ধাক্কা খেলেন এবং ভীষণ আঘাত পেয়ে পেরিটোনাইটিসে আক্রান্ত হলেন, শেষ পর্যন্ত মারাই গেলেন!

এখন কোলো কোলো ক্লাবের লোগোর ওপরে যে কালো দাগ—সেটা অসময়ে চলে যাওয়া সেই দুঃসাহসী স্ট্রাইকারের স্মরণে। আরেল্লানোর গল্পটা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ফুটবলে কখনো কখনো দুঃসাহসের ভয়ানক মূল্য দিতে হয়।