ক্যারিশম্যাটিক, ঠোঁটকাটা আর বিতর্কিত।
তবু অনেকের চোখে তিনি সর্বকালের সেরা কোচদের একজন। ইতিহাসে মাত্র চারজন কোচ দুটি আলাদা ক্লাবের হয়ে ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগ জিতেছেন, তিনি তাঁদের একজন।ডার্বি কাউন্টি আর নটিংহাম ফরেস্টের হয়ে তাঁর সাফল্য জায়গা করে নিয়েছে ফুটবলের গল্পগাথায়। সুন্দর ফুটবল খেলানোর দর্শন আর স্পোর্টসম্যানশিপ নিয়ে আলাদা অধ্যায় লেখা যায় তাঁর নামেই। তবু প্রশ্ন থেকে যায়—কেন তিনি কখনো ইংল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ হতে পারেননি? আজও সেই প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসে নানা পডকাস্ট আর আলোচনায়।
তিনি ব্রায়ান ক্লফ—‘গ্রেটেস্ট ম্যানেজার ইংল্যান্ড নেভার হ্যাড।’
তাঁর ঝলমলে কোচিং ক্যারিয়ারে যেমন আলো আছে, তেমনি ছায়াও। ১৯৭৪ সালে লিডস ইউনাইটেডের কোচ হিসেবে টিকেছিলেন মাত্র ৪৪ দিন। প্রশ্নটা তখনো ছিল, এখনো আছে। না, ক্লফ ব্যর্থ হয়েছিলেন কেন, এ প্রশ্ন নয়। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, তিনি লিডসের দায়িত্বই–বা নিয়েছিলেন কেন?
কারণ, ফুটবল–দর্শনের জায়গা থেকে ক্লফ আর লিডসের আগের কোচ ডন রেভি—দুজন ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। রেভির লিডস বিশ্বাস করত শক্তি ও শারীরিক লড়াইয়ের ফুটবলে, যেটাকে অনেকে বলতেন ‘ডার্টি ফুটবল’। সেই লিডস ও রেভির তীব্র সমালোচক ছিলেন ক্লফ নিজেই। কিন্তু ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ে রেভি যখন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের দায়িত্ব নিলেন, তখনই তাঁর রেখে যাওয়া ক্লাবটির দায়িত্ব নেন ক্লফ।
রেভির খেলোয়াড়দের একসময় ‘হুলিগান’ বলেছিলেন তিনি। সেই দলের কোচ হয়ে যাওয়া মানে তো আগুনে পা রাখা। সেই ৪৪ দিনের আগুনঝরা সময় নিয়েই ব্রিটিশ লেখক ডেভিড পিস ২০০৬ সালে লেখেন বই ‘দ্য ড্যামড ইউনাইটেড’। তিন বছর পর সেই বই নিয়েই তৈরি হয় একই নামের সিনেমা, পরিচালনা করেন ‘দ্য কিংস স্পিচ’-এর অস্কারজয়ী পরিচালক টম হুপার।
পিসের বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরে তৈরি হয় মঞ্চনাটকও, নাট্যকার আন্দেয়ার্স লাস্টগার্টেনের হাতে। তবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সিনেমাটাই। বক্স অফিসে খুব একটা সাড়া না পেলেও সমালোচকদের প্রশংসায় ভেসেছিল। এখন সেটি ব্রিটিশ ফুটবলভিত্তিক সিনেমার ‘কাল্ট ক্ল্যাসিক’-এর তালিকায়।
তবে সিনেমাটিকে ক্লফের জীবনের নির্ভুল প্রতিচ্ছবি ভাবলে ভুল হবে। পিসের বই জীবনীভিত্তিক হলেও ইতিহাসের তথ্যগুলো পুরোপুরি সঠিক নয়। কিন্তু ক্লফের অন্তর্গত আগুনটা, তাঁর জেদের তাপটা, সেটা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ওয়েলসের অভিনেতা মাইকেল শিন। অনেকে বলেন, ‘দ্য কুইন’-এ টনি ব্লেয়ার আর ‘ফ্রস্ট/নিক্সন’-এ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করা শিনের সেরা কাজ এই ক্লফ চরিত্রটাই।
‘ডার্টি লিডস’কে শুদ্ধ ফুটবলের দলে পরিণত করতে চেয়েছিলেন ক্লফ। নাকি তিনি নিজেই নিজের পতনের দিকে হাঁটছিলেন, সিনেমায় দর্শক এই প্রশ্নটা খুঁজে পেতে পারেন অনুচ্চারে। ক্লফের ঘনিষ্ঠ সহকারী পিটার টেলরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ওঠানামাও গল্পে গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এনে দিয়েছে। টেলর চরিত্রে ব্রিটিশ অভিনেতা টিমোথি স্পাল ছিলেন অনবদ্য।
‘দ্য কুইন’ ও ‘ফ্রস্ট/নিক্সন’-এর অস্কার মনোনীত চিত্রনাট্যকার পিটার মরগান সিনেমায় ক্লফের গল্পটা বলেছেন ডার্বি কাউন্টি ও লিডসের দিনগুলোকে মিলিয়ে। ডার্বিতে তাঁর সাফল্যের ভেতরই লুকিয়ে ছিল লিডসের সেই আত্মবিধ্বংসী সময়ের বীজ—এমন ইঙ্গিত আছে পুরো গল্পে।
নটিংহামে ক্লফ পরে টানা দুবার ইউরোপিয়ান কাপ জেতেন। কিন্তু তাঁর ভেতরের মানুষটাকে বুঝতে হলে ফিরে যেতে হয় সেই ৪৪ দিনের লিডস–অধ্যায়ে।
২১ বছর আগে না–ফেরার দেশে চলে যাওয়া এই কোচকে নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে মাইকেল শিন বলেছিলেন, ‘তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীটা নিজের মতো করে বদলে দিতে। কিন্তু আমাদের ভেতর এমন কিছু আছে, যা আগুন নিয়ে খেলার মতো। আর আগুন নিয়ে খেললে শাস্তি পেতেই হয়।’
শিনের কথার মধ্যেই যেন ক্লফের জীবনগাথা, তাঁর লিডসের দিনগুলোর সারসংক্ষেপ লুকিয়ে আছে।
তবে সবাই সিনেমাটিকে ভালোভাবে নেননি। ক্লফের স্ত্রী বারবারা সরাসরি আপত্তি জানিয়েছিলেন, পিসের বইয়ের সমালোচনাও করেছিলেন তিনি। সিনেমার প্রিভিউ দেখার আমন্ত্রণও প্রত্যাখ্যান করে ক্লফ পরিবার। ক্লফের ছেলে নাইজেল পরে বলেন, ‘যাঁরা ফুটবল বোঝেন, তাঁরা সিনেমাটা দেখে বলেছেন—বিরক্তিকর, আর আসল ঘটনার সঙ্গে কোনো মিল নেই।’
হয়তো ঠিকই বলেছেন নাইজেল। ‘দ্য ড্যামড ইউনাইটেড’ ক্লফের জীবনের হুবহু চিত্র নয়। কিন্তু তাঁর ভেতরের আগুনটা, যা তাঁকে একদিকে কিংবদন্তি করেছে, অন্যদিকে পুড়িয়ে দিয়েছে, সেই আগুনের আঁচটা এই সিনেমায় স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায়।
দ্য ড্যামড ইউনাইটেড (২০০৯)
পরিচালক: টম হুপার
চিত্রনাট্য: পিটার মরগান
অভিনয়: মাইকেল শিন, টিমোথি স্পাল, কম মেয়ানি, জিম ব্রডবেন্ট
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৫/১০
রানটাইম: ১ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট