মিরাকল: রূপকথা নয়, বরফের মাঠে লেখা বাস্তবের গল্প

পরিচালক গ্যাভিন ও’কনোরের টান ছিল অনুপ্রেরণার গল্পে। পাশে পেলেন প্রযোজক মার্ক টমাস চার্ডিকে। দুজন মিলে ঠিক করলেন সিনেমা বানাবেন এমন এক ঘটনা নিয়ে, যেটিকে স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড বলেছিল—‘বিশ শতকের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে মহান মুহূর্ত’।

১৯৮০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্রের লেক প্লাসিডে শীতকালীন অলিম্পিক। আইস হকির পদক লড়াইয়ে মুখোমুখি স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতরা আগের ছয় আসরের পাঁচটিতেই চ্যাম্পিয়ন। টানা চারবার জিতেছে সর্বশেষ চার আসর। অন্যদিকে আমেরিকান দলে অপেশাদার খেলোয়াড় বেশি, কজনের অভিজ্ঞতা মাইনর লিগ পর্যন্ত।

ম্যাচটা যে সোভিয়েতদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ঘটল অলৌকিক কিছু। ৪–৩ ব্যবধানে জিতে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিল যুক্তরাষ্ট্র। বরফের মঞ্চে সেই অলৌকিকতার জন্ম দিলেন কোচ হার্ব ব্রুকস। মার্কিন ক্রীড়াগাথায় এই ম্যাচের নাম হয়ে গেল ‘মিরাকল অন আইস’। গ্যাভিন আর চার্ডি সেই আবেগ থেকে সরে আসেননি। তাই ২০০৪ সালে বানানো সিনেমার নামও রাখলেন ‘মিরাকল’।

চিত্রনাট্যের কেন্দ্রবিন্দুতে দল নয়, বরং কোচ ব্রুকস। কৈশোর পেরোনো তরুণ খেলোয়াড়দের ছিন্নভিন্ন ব্যক্তিগত গল্প থাকলেও সেগুলো ছায়ার মতো ঘোরে ব্রুকসের চারপাশে। তাঁর চরিত্রে কঠোরতা আর কোমলতা একসঙ্গে মিশে আছে। কোনো ম্যাচ বাজেভাবে হারলে খেলোয়াড়দের দিয়ে একের পর এক রাউন্ড দৌড়াতে বলা যেমন কঠোরতার চূড়া, আবার গভীর রাতে বসে দলের প্রত্যেক ছেলেকে নিয়ে ভাবা সেই কঠোরতার উল্টো পিঠ।

এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দরকার ছিল এমন কাউকে, যিনি শুধু অভিনয় নয়—খেলাটাও বোঝেন। গ্যাভিন সেই ভাবনা থেকেই বেছে নেন তাঁর প্রথম পছন্দ, সাবেক মাইনর লিগ বেসবল খেলোয়াড় কার্ট রাসেলকে। আর সেই সিদ্ধান্ত একদম সঠিক প্রমাণিত হয়। ব্রুকসের চরিত্রে রাসেল এমন অভিনয় করেছেন, যা তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা কাজগুলোর একটি বলেই ধরা হয়।

মিরাকল ছবির একটি দৃশ্য

তবে সিনেমা মুক্তির আগেই ঘটে এক বেদনার ঘটনা। শুটিং শেষ হওয়ার পর, মুক্তির প্রায় ছয় মাস আগে, এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান হার্ব ব্রুকস। সিনেমার শেষ দৃশ্যেও তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। সেই দল অলৌকিক জয়ের দুই দিন পর ফিনল্যান্ডকে হারিয়ে সোনা জিতেছিল।

সিনেমায় ব্রুকসের চরিত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো—তাঁর খেলোয়াড়দের মতো দর্শকেরাও শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারেন না, তাঁকে ভালোবাসবেন কি না। ব্রুকস নিজেও একসময় যুক্তরাষ্ট্রের হকি দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। তাই অলিম্পিকের আগে শেষ মুহূর্তে আরও একজনকে বাদ দেওয়ার সময় তাঁর ভেতরের যন্ত্রণা দর্শক টের পান। খেলাধুলাকেন্দ্রিক সাফল্যের সিনেমায় যেসব ‘ক্লিশে’ দৃশ্য থাকে, এরিক গাগেনহেইমের চিত্রনাট্যে সেগুলো প্রায় নেই। শুধু সোভিয়েতদের উপস্থাপনটা পরিচিত মনে হতে পারে। হলিউডে রাশান মানেই একটু কম হাসি, একটু বেশি রাফ খেলা আর কিছু ‘ডার্টি ট্রিকস’—এই চেনা ফর্মুলা এখানেও আছে।

৪৫ বছর আগের সেই ম্যাচের শেষ কয়েক সেকেন্ডে এবিসি টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকার আল মিশেলসের একটি লাইন যুক্তরাষ্ট্রের খেলাধুলায় অমর হয়ে গেছে—‘ডু ইউ বিলিভ ইন মিরাকলস? ইয়েস!’ সিনেমায় পুরো ম্যাচের ধারাভাষ্য নতুন করে ডাবিং করা হলেও শেষ ৩০ সেকেন্ডে রাখা হয় আসল অডিও। মিশেলসের যুক্তি ছিল, সেই মুহূর্তের আবেগ ডাবিংয়ে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।

চিত্রনাট্যের কেন্দ্রবিন্দুতে দল নয়, বরং কোচ ব্রুকস

মাত্র ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার বাজেটে নির্মিত ‘মিরাকল’ বক্স অফিসে আয় করে ৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। জায়গা করে নেয় খেলাধুলাভিত্তিক ক্ল্যাসিক সিনেমার তালিকায়। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সেরা ১০০ অনুপ্রেরণামূলক সিনেমার মধ্যেও আছে এর নাম।

মিরাকল (২০০৪)

পরিচালক: গ্যাভিন ও’কনোর

প্রযোজক: মার্ক চার্ডি

অভিনয়: কার্ট রাসেল, প্যাট্রিসিয়া ক্লার্কসন, নোয়া এমেরিখ

রেটিং: ৭.৫/১০

রানটাইম: ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট