লিওনেল মেসিকে নতুন করে চেনানোর কিছু নেই। গোটা বিশ্ব তাঁকে একনামে চেনে। তাঁর ফুটবলশৈলী কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। ফুটবলের সঙ্গে হকির তুলনা চলে না। তবে একটা জায়গায় ফুটবলের সঙ্গে হকির দারুণ মিল—দুটিই গোলের খেলা। গোলের কাজটা মেসি যেমন দারুণভাবে করেন, ওবায়দুল হোসেনও চান হকি মাঠে তেমনই কিছু করতে।
ওবায়দুল শৈশব থেকে মেসির খেলার ভক্ত। মনের ক্যানভাসে ফুটবলার হওয়ার ছবিও এঁকেছিলেন। জিনেদিন জিদান, রোনালদিনিও, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো ফুটবল–তারকাদের খোঁজ রাখতেন নিয়মিতই। কিন্তু বাবার স্বপ্ন পূরণে ওবায়দুল শেষ পর্যন্ত হকির স্টিক হাতে তুলে নিয়েছেন।
২০১৬ সালে বিকেএসপিএতে ভর্তি হওয়ার পর হকি হয়ে যায় ওবায়দুলের সঙ্গী। তবে প্রথম প্রেমের মতো ফুটবলকেও ভুলতে পারেননি। হকির টার্ফেই খুঁজে বেড়ান ফুটবল। স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশের হকির মেসি হওয়ার, ‘মেসি আমার পছন্দের ফুটবলার। একসময় ভাবতাম তাঁর মতো হবো। কিন্তু ফুটবলে তো আর যাওয়া হলো না। বাবার জন্য হকিতে আসা। তবে ফুটবলে না গেলেও হকির মেসি হওয়ার চেষ্টাটাই করব।’
কদিন আগে এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) কাপের জন্য দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন। দলে প্রথমবার ডাক পেয়েছেন ওবায়দুল। বিকেএসপিতে থাকাকালে ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-২১ হকি দলে জায়গা পেয়েছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে ওমানের মাসকটে জুনিয়র এশিয়া কাপে থাইল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো জুনিয়র হকির বিশ্বকাপে জায়গা করে ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশ। যে ইতিহাসের অংশ ছিলেন ওবায়দুলও। পুরো টুর্নামেন্টে করেছেন পাঁচ গোল। এরপর বিজয় দিবস হকিতেও উজ্জ্বল ছিলেন এই ফরোয়ার্ড। বিমানবাহিনীর হয়ে করেছেন ছয় গোল।
৬ এপ্রিল এএইচএফ কাপের মূল দলে নিজের নামটা দেখার পর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে ওবায়দুলের। যেখানে কি না তাঁর খুশি হওয়ার কথা, সেখানে বসে বসে চোখের জল ফেলেছেন। কেন? উত্তরে ওবায়দুল বললেন, ‘বাবাকে খুব মনে পড়েছিল। আজ বাবা থাকলে কত–না খুশি হতেন। হয়তো পুরো মহল্লায় ঘুরে বলতেন, “জানো, আমার ছেলে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে।”’
২০২৩ সালে এক দুপুরে হঠাৎই না–ফেরার দেশে পাড়ি জমান ওবায়দুলের বাবা মোহাম্মদ জুয়েল। নিজে বিভাগীয় পর্যায়ে হকি খেলেছিলেন, ছেলেকে লাল–সবুজের জার্সিতে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল তাঁর। শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পারেননি। যে শূন্যতা ওবায়দুলও বয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে বাবার ইচ্ছা পূরণ করেই থামতে চান না, হকির জন্য নিজেকে নিংড়ে দিতে চান। হকির রং দিয়ে সাজাতে চান জীবনটা, ‘এখন মনে হচ্ছে বড় কিছুই করতে হবে। চেষ্টা করব দেশকে দারুণ কিছু দিতে। প্রথমবার জাতীয় দলের হয়ে খেলব। তা–ও আবার বিদেশের মাটিতে। ভাবতেই ভালো লাগছে।’
রাজশাহীর লক্ষ্মীপুরের কাজিরহাটায় বেড়ে উঠা ওবায়দুল এখন তাঁর এলাকার মানুষের কাছেও ভালোবাসার নাম। ঈদে বাড়িতে গিয়ে টের পেয়েছেন পাড়াপড়শিরা তাঁকে কতটা কদর করছেন। তখনো তিনি জাতীয় দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে। তারপরও ওবায়দুলকে ঘিরে মানুষের আগ্রহের শেষ ছিল না।
ছোটবেলার বন্ধুরাও এখন তাঁর মতো হকি খেলোয়াড় হতে চান, ‘এবার ঈদের বাড়ি যাওয়ার পর সবার অনেক ভালোবাসা পেলাম। আশপাশের মানুষেরা খোঁজখবর নিয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কয়েকজন বলল তাঁরাও হকিতে আসতে চায়। চূড়ান্ত দলে আসার পর এলাকার অনেকের অভিনন্দনও পেয়েছি। আসলে আমার এলাকা থেকে আমিই প্রথম জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছি। তাই সবার আগ্রহটা বাড়ছে।’
এখন আর বিখ্যাত ফুটবলারদের নিয়ে ভাবার সময় পান না ওবায়দুল। তবে কিংবদন্তি হকি খেলোয়াড়দের ছবিগুলো কল্পনার শোকেসে থরেথরে সাজিয়ে রেখেছেন। এই যেমন ভারতের ধ্যান চাঁদ, পাকিস্তানের শাহবাজ আহমেদ কিংবা অস্ট্রেলিয়ার জেমি ডোয়ায়ার। আদর্শ মনে করেন হকির ম্যারাডোনা খ্যাত কিংবদন্তি শাহবাজকে। সময় পেলে ইউটিউবে হকির ভিডিও দেখেন। চেষ্টা করেন নতুন কিছু শেখার, ‘মাঝেমধ্যে হকির বিখ্যাত খেলোয়াড়দের ম্যাচ দেখি। কিংবদন্তি শাহবাজ আমার আইকন। তাদের খেলা দেখতে ভালোই লাগে।’
১৭ থেকে ২৭ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিত হবে এএইচএফ কাপ, যা একই সঙ্গে এশিয়া কাপের বাছাইপর্বও। এই প্রতিযোগিতার শেষ চার আসরের শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ। এবারের আসরে পুল ‘বি’ তে থাকা বাংলাদেশের চার প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও কাজাখস্তান। প্রথম ম্যাচ ১৮ এপ্রিল কাজাখস্তানের বিপক্ষে।