
‘মিলিয়ন ডলার বেবি’ খেলাধুলাভিত্তিক সিনেমার গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে মানবিক এক উপাখ্যান। যে চলচ্চিত্র শেষ করার পর এর রেশ রয়ে যায় অনেক দিন পর্যন্ত।
খেলাধুলার সিনেমা মানেই টান টান উত্তেজনা, শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত, আর শেষ পর্যন্ত নায়কের জয়—এমনটাই আমরা দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু কিছু সিনেমা এই চেনা ছক ভেঙে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। এমনই এক চলচ্চিত্র ‘মিলিয়ন ডলার বেবি’—যেখানে বক্সিং আছে, কিন্তু সেটি শুধু বাহানা। মূল গল্পটা আসলে জীবনের।
পরিচালক ক্লিন্ট ইস্টউড এখানে বক্সিংকে ব্যবহার করেছেন এক অসামান্য মানবিক ট্র্যাজেডির পটভূমি হিসেবে। গল্পটা মূলত এক মানুষের উত্থান-পতন, সংগ্রাম আর নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার। যেখানে জয় নেই, পরাজয়ও নেই—আছে শুধু বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি, আর শেষ পর্যন্ত নিজেই নিজের জন্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়ার সাহস।
সিনেমায় উঠে এসেছে সম্পর্কের জটিলতা। রক্তের সম্পর্ক সব সময় আশ্রয় দেয় না, অনেক সময় তারাই হয় আঘাতের উৎস। আবার একেবারে অপরিচিত কেউ হয়ে ওঠে সবচেয়ে আপন। এই দুই বিপরীত বাস্তবতাই সমান মমতায় তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ম্যাগি ফিটজগার্ল্ড, অভিনয়ে হিলারি সোয়াংক। তাঁর চোখ, মুখ, শরীর—সব মিলিয়ে তিনি যেন ম্যাগির আত্মা হয়ে উঠেছেন পর্দায়। জীবনযুদ্ধে লড়াই করে উঠে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দেখে মনে পড়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই লাইন: “মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু হার মানে না।”
ম্যাগিও হার মানেনি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনকেই ছেড়ে দিয়েছিল সে, তবু হারেনি। এমনকি বক্সিং রিংও তাকে পরাজিত করতে পারেনি—প্রতিপক্ষকে নিতে হয়েছিল প্রতারণার আশ্রয়। সিনেমার একপর্যায়ে সোয়াংকের সংলাপ না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলা, শুধু অভিব্যক্তির মাধ্যমে—সেই মুহূর্তগুলো দর্শককে তাড়া করে বেড়ায় অনেক দিন।
কিন্তু কেউ একা কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে? ম্যাগির পরিবার, এমনকি তার মা পর্যন্ত তার পাশে দাঁড়ায়নি। বরং ওর যন্ত্রণাকে করেছে আরও ভারী। তখন তার পাশে এসে দাঁড়ায় ফ্র্যাঙ্কি ডান—যার ভূমিকায় স্বয়ং পরিচালক ক্লিন্ট ইস্টউড নিজেই।
প্রথমে বক্সিং শেখাতে চাননি, কিন্তু পরে হয়ে উঠেছিলেন তার গুরু, এমনকি তার বাবার জায়গাটাও যেন পূরণ করেন। গুরু–শিষ্য সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়ে পুরো চলচ্চিত্রটি ধীরে ধীরে পরিণত হয় এক আত্মিক বন্ধনের মহাকাব্যে। শেষ কয়েকটি দৃশ্যে ইস্টউডের অভিনয় বাস্তবতাকেও ছাপিয়ে যায়।
আর এই গল্পে ভারসাম্য এনে দিয়েছেন মরগান ফ্রিম্যান। সহকারী এডির চরিত্রে তাঁর উপস্থিতি, সংলাপ, দৃষ্টিভঙ্গি—সব মিলিয়ে এই গল্পের আবেগকে করে তুলেছে আরও দৃঢ়, আরও গভীর।
অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনার চেয়ারে বসেও ইস্টউড ছিলেন অনন্য। দৃশ্যবিন্যাসে, সংলাপে কিংবা ক্যামেরার মুভমেন্টে কোথাও বাড়াবাড়ি করেননি। বরং সংযত থেকে গল্প বলেছেন হৃদয়ের গভীর থেকে। আর এখানেই ছবিটি হয়ে উঠেছে বাস্তবের মতোই জীবন্ত।
২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পরপরই ‘মিলিয়ন ডলার বেবি’ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। সেরা চলচ্চিত্র, সেরা অভিনেত্রী, সেরা পার্শ্ব–অভিনেতাসহ একাধিক বিভাগে জিতে নেয় অস্কার।
দুই দশক পার হয়ে গেলেও এই সিনেমার আবেদন একটুও ফুরোয়নি। হার না মানা মানুষদের জীবনের গল্পে ‘মিলিয়ন ডলার বেবি’ এখনো একটি প্রতীক, একটি অনুপ্রেরণা। এমনকি আরও অনেক দিন পর্যন্ত এই ছবি হয়ে থাকবে সংগ্রামী মনুষ্যত্বের এক অনন্য দলিল।
পরিচালক: ক্লিন্ট ইস্টউড
অভিনয়ে: ক্লিন্ট ইস্টউড, হিলারি সোয়াংক, মরগান ফ্রিম্যান
আইএমডিবি রেটিং: ৮.১
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ১২ মিনিট