সাঁতারের ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড অচল হয়ে পড়ে আছে
সাঁতারের ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড অচল হয়ে পড়ে আছে

‘ম্যানুয়াল’ ক্রীড়াঙ্গনে পড়েনি প্রযুক্তির আলো

বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন এখন অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোও খেলোয়াড়দের ফিটনেস, শারীরিক সক্ষমতা, প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতার উন্নয়নে ব্যবহার করছে জিপিএস ট্র্যাকার, হার্ট রেট মনিটর, স্ট্রেইন সেন্সর, কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমসহ নানা প্রযুক্তি। অথচ বাংলাদেশে বেশির ভাগ খেলায় এখনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিই ভরসা। ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলাগুলোয় প্রযুক্তির আলো বলতে গেলে পড়েইনি।

নারী ফুটবলে খাতা-কলমই ভরসা

বর্তমানে বিশ্ব ফুটবল আধুনিক সব প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে। কোচদের হাতে থাকা ট্যাবেই মিলছে খেলোয়াড়দের শক্তি, দুর্বলতা, ফিটনেস, শারীরিক সামর্থ্যের তথ্য। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলে এখনো পৌঁছায়নি প্রযুক্তির সে আলো। নারী ফুটবলের প্রশিক্ষণে হাতঘড়ি-বাঁশি আর খাতা-কলমই ভরসা। পুরুষ ফুটবলে প্রযুক্তি বলতে ফিটনেস অনুশীলনে জিপিএসের ব্যবহার। মেয়েদের ফুটবলে তো এখনো সেটাও আসেনি। নারী ফুটবল দলের কোচ পিটার বাটলারের আক্ষেপ, ‘ফুটবল এখন পুরোপুরিই প্রযুক্তিনির্ভর একটি খেলা। কিন্তু আমাদের এখানে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। এমনকি কাজ আমাদের করতে হয় জিপিএস ছাড়াই।’ বাফুফের টেকনিক্যাল কমিটির চেয়ারম্যান কামরুল হাসান এই দুর্বলতা স্বীকার করে বলেছেন, ‘জাতীয় দলে একটা জিপিএস ট্র্যাকার আছে। মাঝখানে এটাও নষ্ট ছিল, এখন আবার ঠিক করা হয়েছে। আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগত দিকটা অবশ্যই গুরুত্ব দেওয়া হবে।’

নারী ফুটবলে চলছে খাতা–কলম ব্যবহার করে অনুশীলন

হকিতে নেই জিপিএসও

দেশের আরেক জনপ্রিয় খেলা হকিও এখন প্রযুক্তিনির্ভর। তবে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হকিতে এখনো জিপিএসের ব্যবহারই শুরু হয়নি। রানিং, নিজেদের মধ্যে ম্যাচ খেলা, স্টিক নিয়ে কারিকুরি—অনুশীলনে এসব প্রথাগত কাজই হয় বেশি। হকির জাতীয় দলই এখনো পায়নি প্রশিক্ষিত কোনো পারফরম্যান্স বিশ্লেষক বা পারফরম্যান্স বিশ্লেষণের কোনো সফটওয়্যার। ‎নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় হকি দলের সাবেক এক কোচ বলেছেন, ‘আমরা অনেকেই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে আগ্রহী নই। কারণ, বেশির ভাগ কোচ ম্যানুয়ালি শিখে এসেছেন, তাই তাঁরাও কোচিং ক্যারিয়ারে সেই পন্থা অনুসরণ করতে চান।’

‎সাঁতার চলছে হাতঘড়ি ধরে

মিরপুর সুইমিং কমপ্লেক্সের ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড শুরু থেকেই অচল। অনুশীলন কিংবা প্রতিযোগিতা—সব ক্ষেত্রে হ্যান্ডটাইমিংই ভরসা। নেই অন্য কোনো প্রযুক্তির ব্যবহারও। অথচ ভারত, পাকিস্তানসহ এশিয়ার অনেক দেশই সাঁতারুদের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করে আন্ডারওয়াটার ভিডিও অ্যানালাইসিস পদ্ধতি ব্যবহার করে। সাঁতারুর গতি ও শক্তির পরিমাপের জন্য ব্যবহার করা হয় মোশন সেন্সর ও বায়োমেকানিকস সফটওয়্যার; বাংলাদেশের সাঁতারে যেসব এখনো অচেনা ‘বস্তু’। থাইল্যান্ডে উন্নত প্রশিক্ষণ নেওয়ায় আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত সাঁতারু সামিউল ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা যদি কিছু প্রযুক্তির সুবিধাও পেতাম, তাহলে অনেক ভালো হতো। নিজেদের পারফরম্যান্স, উন্নতিটা সঠিকভাবে জানতে পারতাম।’

চোখের মাপেই বিচার করা হচ্ছে অ্যাথলেটদের ফিটনেস

‎অ্যাথলেটিকসে ‘চোখে দেখে’ পরিমাপ

প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছর পরও অ্যাথলেটিকসে নেই কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার। ফেডারেশনের একটি ফটোফিনিশ মেশিন থাকলেও সেটির ব্যবহার নেই। মেশিন চালানোর মতো লোকই নাকি নেই তাদের! ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক কিতাব আলী বলেছেন, ‘আমাদের থাকার মধ্যে একটা ফটোফিনিশিং মেশিন আছে। সেটাও চালানোর মতো দক্ষ লোকবল নেই। মেশিন চালানোর প্রশিক্ষণ ও এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা এনএসসির কাছে ৭ লাখ টাকা চেয়েছি।’‎ ফটোফিনিশ মেশিন চলে না বলে চোখে দেখে পরিমাপ করা হয় অ্যাথলেটদের ফিটনেস এবং পারফরম্যান্স। এর পরিণতটা কী, এশিয়ান ইনডোরে ব্রোঞ্জপদক জেতা অ্যাথলেট মাহফুজুর রহমানের কথায় সেটি স্পষ্ট, ‘আমাদের এখানে সবই হ্যান্ডটাইমিংয়ে চলে। যে কারণে একজন স্প্রিন্টার দেশে ১০: ৪৫ সেকেন্ড দৌড়িয়ে প্রথম হলেও বিদেশে গিয়ে সেটা ১০: ৮০ হয়ে যায়। প্রযুক্তির ব্যবহার না থাকায় পারফরম্যান্সে তফাতটা বেশি হচ্ছে। নিজেদের অবস্থানটাও অ্যাথলেটরা বুঝতে পারেন না।’

‎অন্য খেলারও একই দশা

কাবাডি, ভলিবল, হ্যান্ডবল, আর্চারি, রাগবি, জুডো, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টনসহ দেশের অন্য খেলাগুলোতেও লাগেনি প্রযুক্তির হাওয়া। মান্ধাতার আমলের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই চলছে সব। ‎এতে সময়ের হিসাব, তথ্য রেকর্ড ও বিশ্লেষণে ভুলের শঙ্কা থাকে। কিন্তু ফেডারেশনগুলোর এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেই। যার ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গিয়ে অনেক সময়ই অস্বস্তিতে পড়েন খেলোয়াড়েরা। জাতীয় কাবাডি দলের অধিনায়ক মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা নিজেরাই নিজেদের ফিটনেস বাড়াতে কাজ করি। প্রযুক্তির সুবিধা পেলে এটা আরও সহজ হতো।’

কাবাডিতেও পড়েনি আধুনিকতার ছোঁয়া

‎ব্যতিক্রম কেবল ক্রিকেট

দেশের খেলাধুলায় একমাত্র ক্রিকেটেই আধুনিক প্রায় সব প্রযুক্তির ব্যবহার চোখে পড়ে। সেটি খেলাই বলুন, কিংবা অনুশীলন। ফিটনেস ট্রেনিং থেকে শুরু করে ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলনের বিশ্লেষণ, পারফরম্যান্স মূল্যায়ন—সবকিছুই হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কোচ, ফিজিও, ট্রেনাররা সব কাজেই প্রযুক্তির সুবিধা নেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও (বিসিবি) এসব সুবিধা নিশ্চিত করতে কোনো কার্পণ্য নেই।

‎শুধু কি অর্থসংকটই দায়ী

সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেছেন, ‘একটা স্কোরবোর্ডই ঠিক করতে পারলাম না! আমাদের আসলে স্বাদ আছে সাধ্য নেই।’ তবে কেবল আর্থিক সমস্যাই নয়, দক্ষ জনবলেরও ঘাটতি দেখেন অনেকে। ‎যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. নাসিম রেজা বলেছেন, ‘আমরা সব সময় বলি আর্থিক কারণে পারছি না, এটা আসলে ঠিক নয়। আন্তরিকতারও প্রয়োজন আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য এখন পর্যন্ত কোনো জাতীয় ক্রীড়ানীতি গ্রহণ করা হয়নি।’