গাছের ওপর বজ্রপাত, সেখান থেকে কিংবদন্তি পেলেন ‘ওয়ান্ডারবয়’ ব্যাট

ঘটনাটা গত মঙ্গলবার রবার্ট রেডফোর্ডের মৃত্যুর পরদিন। লস অ্যাঞ্জেলেস ডজার্সের মাঠ ডজার স্টেডিয়ামে ব্যাটিং কেজের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাউল ইবানেজ ও চেজ ইউটলে। দুজনই বেসবলের সাবেক অলস্টার। এক দর্শনার্থী তাঁদের সামনে ‘রয় হবস’ নামটা উচ্চারণ করতেই রাউল বললেন, ‘দ্য ন্যাচারাল’, ইউটলে সায় দিলেন, ‘আমার পছন্দের সিনেমা।’

রেডফোর্ড হবস চরিত্রে অভিনয়ের সময় ইবানেজের বয়স ১২ বছর। ইউটলে আরও ছোট। হাইস্কুলে থাকতে প্রতিটি ম্যাচের আগেই নাকি ‘দ্য ন্যাচারাল’ দেখতেন মেজর বেসবল লিগে (এমএলবি) ১৯ বছর কাটানো ইবানেজ। তাঁর মতো যুক্তরাষ্ট্রের হাজারো কিশোর কিংবা তরুণের মানসপটে ছাপ রেখেছেন হবস। বাংলাদেশে বেসবলের পরিচিতি প্রায় নেই। তবে খেলাধুলাপ্রেমী হলে রেডফোর্ডের ‘দ্য ন্যাচারাল’ সিনেমাটা মনে অন্য রকম ছাপ রাখতে পারে।

ফ্যান্টাসি ও বেসবল নিয়ে বানানো এ সিনেমার বিভিন্ন কার্ড রেডফোর্ডের মৃত্যুর পর ভাসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার বাজেটে বানানো এই সিনেমা ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পর ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার আয় করে। নিউইয়র্ক টাইমসের দাবি, এ সিনেমা হিট হওয়ার পরই হলিউডে ফিরে আসে বেসবলভিত্তিক সিনেমার জনরা।

রয় হবস চরিত্রে অভিনয় করেন রবার্ট রেডফোর্ড

‘রেইন ম্যান’ ও ‘গুডমর্নিং ভিয়েতনাম’খ্যাত অস্কারজয়ী পরিচালক ব্যারি লেভিনসন সিনেমার গল্প নিয়েছেন মার্কিন লেখক বার্নার্ড মালামুদের ১৯৫২ সালে প্রকাশিত একই নামের বই থেকে। যদিও চিত্রনাট্যে বইয়ের গল্পের প্রতি তিনি পুরো সৎ থাকেননি। বইয়ে শেষটা নেতিবাচক হলেও সিনেমায় তা ইতিবাচক রাখা হয়—পৃথিবীব্যাপী সিনেমাপ্রেমীরা শেষ বেলায় গিয়ে নায়কের জয় চান বলেই সম্ভবত এ সিদ্ধান্ত এবং তাতে প্রযোজনা সংস্থা সফলও। বিশ্বখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা ট্রাইস্টার পিকচার্সের প্রথম সিনেমাও এটি।

দিগন্তবিস্তৃত সোনালি ফসলের মাঠ। এক কোণে ঝাঁকড়া একটি গাছ। সোনালি চুলের তরুণ রেডফোর্ড, ফসলের সোনালি রঙের সঙ্গে মিলে সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করে—এমন মনোলোভা কিছু দৃশ্য আছে। আর আছে গাছের ওপর একটা বজ্রপাত, যেখান থেকে জন্ম ‘ওয়ান্ডারবয়’ নামে অবিশ্বাস্য এক বেসবল ব্যাটের। ভাবছেন, সেই ব্যাট দিয়ে হবস বিশ্বজয় করে ফেলল?

না, হবসের গল্পটা সুপারম্যানসুলভ নয়; বরং অনেক বেশি মানবিক। উপর্যপুরি ব্যর্থতা, বেসবলে ভালো করতে মাত্র এক বছরের ডেডলাইন এবং সেই পথে একের পর এক প্রিয়জন হারানো—আসলে গল্পটা মানুষেরই, ক্রমাগত স্ট্রাগলের শিকল ছিঁড়ে ধীরে ধীরে সুপারম্যান হয়ে ওঠার। সেই গল্প দেখতে দেখতে অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি এনে দেয় চোখেরও শান্তি।

বেসবল ব্যাট ওয়ান্ডারবয়

তবে আশির দশকের বানানো সিনেমার স্টোরিটেলিং এখনকার চেয়ে একটু অন্য রকম। সিনেমাটি দেখতে গিয়ে কখনো কখনো মনে হতে পারে, গল্প এগোচ্ছে থেমে থেমে। তবে স্লো-বার্নিং স্ক্রিপ্ট ভালো লাগলে ‘দ্য ন্যাচারাল’ আসলে আপনার জন্যই।

মার্কিন চিত্রসমালোচক জেমস বেরারদিনেল্লির চোখে এটা ‘তর্কযোগ্যভাবে বেসবল নিয়ে বানানো সেরা সিনেমা’। ইএসপিএন পেজ টুর মতে, খেলাধুলা নিয়ে বানানো সর্বকালের সেরা সিনেমার তালিকায় এটি ষষ্ঠ। ইএসপিএনেই সাংবাদিক হিসেবে কাজ করে খ্যাতি কুড়ানো মার্কিন সাংবাদিক বিল সিমন্স আরেক কাঠি সরেস। তাঁর মতে, ‘সেরা খেলাধুলার সিনেমা’র তালিকার শীর্ষে ‘হোসিয়ার্স’ অথবা ‘দ্য ন্যাচারাল’ না থাকলে সেটা কোনো তালিকাই নয়!

তবে একটু ভিন্নমতও আছে। সাময়িকী ‘নিউইয়র্কার’–এ লেখা কলামে বেসবলের খ্যাতিমান লেখক রজার অ্যাঞ্জেল মনে করেন, মূল গল্পের লেখক যেহেতু গল্পটা আর্থুরিয়ান লেজেন্ডের ধাঁচে বলে গেছেন, সেটার পুরোটাই ধরে রাখা উচিত ছিল। তাতে অবশ্য সিনেমার শেষে নায়কের গৌরবপ্রিয় দর্শকের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

রয় হবস চরিত্রে অভিনয় করতে বেসবলের স্কলারশিপে ভর্তি হন রেডফোর্ড

অস্কারে ছয়টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল ‘দ্য ন্যাচারাল’। কিছুই না জিতলেও খেলাধুলা নিয়ে বানানো সর্বকালের সেরা সিনেমার ক্যাটাগরিতে এটা অনায়াসেই জায়গা পায়। রেডফোর্ডের ক্যারিয়ারে অসাধারণ সব সিনেমা থাকলেও আইএমডিবিতে তাঁর নামে ‘নোন ফর’ অপশনে এ সিনেমা রাখা হয়। রেডফোর্ড তিন বছর পর কাজে ফিরেছিলেন এই সিনেমা দিয়ে। বেসবলে দক্ষতা বাড়াতে চল্লিশ পেরিয়েও ভর্তি হয়েছিলেন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে বেসবল স্কলারশিপে। সেখানে যা শিখেছিলেন, সিনেমা মুক্তির দুই দশক পরও বাঁ হাতে তাঁর সেই বেসবল ব্যাটের সুইং ছিল। হ্যাঁ, ন্যাচারাল!

সিনেমা: দ্য ন্যাচারাল (১৯৮৪)

পরিচালক: ব্যারি লেভিনসন

চিত্রনাট্য: রজার টাউনি, ফিল ডুসেনবেরি

অভিনয়: রবার্ট রেডফোর্ড, রবার্ট ডুভ্যাল, গ্লেন ক্লোজ, কিম বেসিঙ্গার, রবার্ট প্রস্কি

আইএমডিবি রেটিং: ৭.৪/১০

রানটাইম: ২ ঘণ্টা ১৮ মিনিট