দঙ্গল: শুধু একটা সিনেমা নয়, একটা অনুভূতিও

মহাবীর সিং ফোগাত। মাঝবয়সী, একটু মোটাসোটা, গম্ভীর মানুষ। একসময় কুস্তি লড়তেন।
একদিন তাঁর বড় মেয়ে গীতা ফোগাতকে চ্যালেঞ্জ করলেন কুস্তিতে নামার জন্য। কারণ, গীতা সোজাসাপ্টা বাবাকে বলে দিয়েছিল, তাঁর শেখানো কুস্তির কৌশল পুরোনো হয়ে গেছে। এখন সে পাটিয়ালার ন্যাশনাল স্পোর্টস একাডেমিতে পড়ে। দেশের নামী কোচদের অধীনে অনুশীলন করে। বাবার শেখানো কৌশল নাকি আজকের দুনিয়ায় সেকেলে।

বাবা-মেয়ের কুস্তি শুরু হয়। গীতা জিতে যায়। হেরে যান মহাবীর। মেয়ে তখন বলে, ‘কুছ তো ফারাক হ্যায়, পাপা।’ মুখে কিছু না বললেও বাবার চোখে ধরা পড়ে এক অচেনা কষ্ট—নিজের তৈরি মানুষটা যেন আজ তাঁরই থেকে আলাদা হয়ে গেছে।

‘দঙ্গল’-এর গল্প সেই মহাবীর সিং ফোগাতের। হরিয়ানার ছোট্ট গ্রাম বালালির এক কুস্তিগিরের। নিজের বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটা সত্যি করতে না পেরে এক সময় স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন, তাঁর ছেলে হবে, দেশের জন্য সোনা জিতবে। কিন্তু নিয়তির লিখন অন্য। তাঁর ঘরে এল একে একে চার কন্যা।
তারপর একদিন গ্রামের দুটো ছেলেকে বেধড়ক পেটাল দুই ছোট মেয়ে—গীতা আর ববিতা। মহাবীর বুঝলেন, শক্তি আসলে শরীরে নয়, থাকে ইচ্ছায়। আরও বুঝলেন, ‘গোল্ড তো গোল্ড হোতা হ্যায়, ছোরা লায়ে অর ছোরি’—সোনা তো সোনাই, সেটা ছেলে আনুক বা মেয়ে।

‘দঙ্গল’ ছবিতে আমির ও তাঁর সহশিল্পীরা।

সেই থেকে কন্যাদের নিয়ে শুরু হয় এক পিতার সোনার খোঁজ। কিন্তু লড়তে হয় সমাজের সঙ্গে, পুরোনো ধ্যানধারণার সঙ্গে। কারণ, মেয়েদের কাজ নাকি ‘চাক্কি-চৌকা-ঝাড়ু-পোঁছা’, কুস্তি নয়। শুরুতে গীতা-ববিতাকে ছেলেদের সঙ্গেই কুস্তি করতে হয়। কারণ, তখনো মেয়েদের কুস্তি নামে কিছুই নেই। পরে যখন তারাই ইতিহাস লেখে, বদলে যায় সবকিছু।

পরিচালক নিতেশ তিওয়ারি আমির খানের মাধ্যমে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজ, রীতিনীতির বিরুদ্ধে এক পিতার একার লড়াই।  পিয়ুষ গুপ্ত, শ্রেয়স জৈন ও নিকিল মেহরোত্রার চিত্রনাট্যেই লুকিয়ে ছবির আসল শক্তি।
আমির খান নামে কেউ হয়তো এই ছবিতে ছিলেনই না, যিনি ছিলেন তিনি আসলেই হয়তো মহাবীর। তরুণ কুস্তিগির থেকে মধ্যবয়সী পিতা, সব ভূমিকাতেই কী অসাধারণ অভিনয়। আমির এর আগে ক্রিকেট নিয়ে ‘লগান’ বানিয়ে সফল হয়েছেন। এরপর কুস্তি নিয়ে ‘দঙ্গল’ করে ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকেই।

দঙ্গল সিনেমার একটি দৃশ্য

পরিচালক তিওয়ারি গল্পে বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়েছেন, ফোকাস রেখেছেন লড়াই, আবেগ, বাবা-মেয়ের টানাপোড়েনের ওপর। বলিউডের স্পোর্টস ছবির পুরোনো ফর্মুলা ব্যবহার করেও তিনি এনেছেন এক নতুন সতেজতা। ছবিতে জাতীয়তাবাদের সুর আছে, আবার নারীর শক্তির বার্তাও আছে। সঙ্গে আছে হরিয়ানার মাটির গন্ধ, রসিকতা আর চোখে পানি এনে দেওয়া মুহূর্ত।

দঙ্গলে দর্শকপ্রিয় হওয়ার মতো সব উপাদানই আছে। তবে এর আসল সৌন্দর্য অভিনয়ে আর গল্প বলায়। আমির খান এখানে কখনো বিরক্ত করেন তাঁর কঠোর ‘হানিকারক বাবা’ চরিত্রে, আবার চোখ ভিজিয়ে দেন এক অসহায় পিতা হয়ে। যখন গীতা একাডেমির নিয়মের বিরুদ্ধে লড়ছে, তিনি পাশে থাকেন। আবার যখন তাঁর মেয়ে প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেন। পুরোনো গল্প হলেও একটুও একঘেয়ে লাগে না।

দঙ্গল সিনেমার পোস্টার

গীতা ফোগাত চরিত্রে ফাতিমা সানা শেখ দুর্দান্ত। তাঁর কঠোর প্রশিক্ষণের ফল চোখে পড়ে প্রতিটি দৃশ্যে। ধীরগতির শটে তিনি যেন চিতা—দ্রুত, মনোযোগী, নিখুঁত। কুস্তির দৃশ্যগুলো এমন বাস্তব মনে হয়, যেন ক্যামেরা নয়, দর্শকই বসে আছেন মাটির ধারে।

সানিয়া মালহোত্রা (ববিতা) তেমন সুযোগ না পেলেও উপস্থিতিতে প্রাণ দিয়েছেন। দুই শিশুশিল্পী জাইরা ওয়াসিম ও সুহানি ভাটনাগর দুর্দান্ত—একজনের নির্ভীক চোখ, আরেকজনের হাসি থেকে ছিটকে পড়ে জীবনের উচ্ছ্বাস। আমিরের ভাইয়ের ছেলের চরিত্রে অপারশক্তি খুরানা হালকা হাস্যরস এনে দিয়েছেন ছবিতে। প্রীতমের সংগীত গল্পের অংশই হয়ে উঠেছে। আলাদা করে গান ঢোকানো হয়েছে, মনেই হবে না।
সব মিলিয়ে ‘দঙ্গল’ শুধু একটা সিনেমা নয়, একটা অনুভূতি।

দঙ্গল (২০১৬)

পরিচালক: নিতেশ তিওয়ারিঅভিনয়: আমির খান, সাক্ষী তানওয়ার, ফাতিমা সানা শেখ, সানিয়া মালহোত্রা, জাইরা ওয়াসিম, সুহানি ভাটনাগর, অপারশক্তি খুরানা।আইএমডিবি রেটিং: ৮.৩/১০রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৪১ মিনিট