বাবা মজিবর হোসেনের দুই চোখই অন্ধ। শৈশবে চিকিৎসার অভাবে আলো হারানো মানুষটির স্বপ্ন ছিল, মেয়ে সুমাইয়া আক্তার একদিন চিকিৎসক হবে। সুমাইয়ারও ইচ্ছা ছিল বাবার চোখে আলো ফেরানোর। কিন্তু নিয়তির লিখন কে আর বদলাতে পারে!
অভাব-অনটনের ভেতর বড় হওয়া সুমাইয়ার জীবনে একসময় জায়গা করে নেয় ভারোত্তোলন। শুরুতে দ্বিধা ছিল, পরিবার থেকেও আপত্তি এসেছিল। কিন্তু এসএ গেমসে দুই সোনাজয়ী মাবিয়া আক্তারের গল্প তাঁকে অনুপ্রাণিত করে।
জীবনের ভার সয়ে কাঁধে নিলেন লোহার ভার। ২০১৯ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রতিভা অন্বেষণে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন। সেখান থেকেই ডাক পান জুনিয়র জাতীয় দলে। ২০২২ সালে জাতীয় জুনিয়র ভারোত্তোলনে হন সেরা খেলোয়াড়।
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। টানা তিনবার জাতীয় সিনিয়র ভারোত্তোলনে অংশ নিয়ে একবার রুপা, দুবার ব্রোঞ্জ জেতেন। চতুর্থবার এসে আর কারও পেছনে নয়—সরাসরি প্রথম। গলায় ঝুলিয়েছেন সোনার পদক। ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে স্ন্যাচে ৭০ কেজি আর ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ৯৬ কেজি মিলিয়ে তুলেছেন ১৬৬ কেজি।
পদক জেতার পর বাবার কথাই প্রথম মনে পড়ে সুমাইয়ার। যে মানুষটি অনেক দিন প্রাণখুলে হাসেননি, তাঁর মুখেও ফুটে ওঠে স্বস্তি আর আনন্দের ছবি। সুমাইয়ার চোখে সেটাই সবচেয়ে বড় জয়।
আনন্দে ভেসে সুমাইয়া বলেন, ‘আমার বাবা চোখে দেখেন না। আমি কীভাবে খেলি, কী করি—কিছুই দেখার সাধ্য নেই তাঁর। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, তিনি মনের চোখ দিয়ে আমার সাফল্য দেখেছেন। সোনা জেতার পর বাবাকে অনেক খুশি দেখেছি।’
এবারের প্রতিযোগিতায় ২১০ কেজি ওজন তুলে নিজেকে ছাপিয়ে গেছেন মাবিয়া আক্তার। যিনি সুমাইয়ার প্রেরণা, তাঁর আইডল। সুমাইয়ার বিশ্বাস, একদিন তিনিও মাবিয়ার মতো রাজত্ব করবেন এই অঙ্গনে। বলেছেন, ‘আমি ছোটবেলায় টঙ্গীর জিমনেসিয়ামে মাবিয়া আপুর ছবি, পোস্টার দেখতাম। তাঁর গল্প শুনতাম। সেখান থেকেই এই খেলায় আগ্রহ জন্মায়।’
সুমাইয়ার সাফল্যের পেছনে আরেকজনের অবদানও বড়—জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ শাহরিয়া সুলতানা। তাঁর নিবিড় প্রশিক্ষণেই সেনাবাহিনীর এই ভারোত্তোলক আজ সেরার আসনে। কৃতজ্ঞ সুমাইয়া বলেন, ‘শাহরিয়া ম্যাম আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। তাঁর পরামর্শ মেনে অনুশীলন করেছি। সেটারই ফল আজ পেলাম।’
টঙ্গীর মেয়ে সুমাইয়ার পথচলায় এখন সঙ্গী তাঁর ছোট বোন সুরাইয়া আক্তারও। আপুকে দেখে সেও নেমেছে ভারোত্তোলনে। দুই বোনের স্বপ্ন—একসঙ্গে দেশকে কিছু দেওয়া। সুমাইয়ার চোখ এখন সামনে এসএ গেমস, ‘আমার বোনও জাতীয় দলে খেলতে চায়। আমরা দুজন মিলে দেশকে গর্বিত করতে চাই। সামনে এসএ গেমস। আমার বিশ্বাস, সেখানেও ভালো কিছু করতে পারব।’