Thank you for trying Sticky AMP!!

দাবার চালে মগ্ন রানী হামিদ

নারীদের খেলাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার অবস্থা নেই

তিনি শুধু বাংলাদেশের দাবার রানিই নন, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেরই এক কিংবদন্তি। জাতীয় নারী দাবার রেকর্ড ২০ বারের চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের জন্য এক রোল মডেল। বিশ্ব নারী দিবসে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মাস্টারের মুখোমুখি হয়েছে প্রথম আলো। রানী হামিদ কথা বলেছেন এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অতীত ও বর্তমান নিয়ে। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নারী ক্রীড়াবিদদের এগিয়ে চলার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা এবং সেগুলো কাটিয়ে ওঠার উপায়সহ আরও অনেক কিছুই—
প্রশ্ন

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে নারী দিবস পালিত হচ্ছে বাংলাদেশে। এই ৫০ বছরে ক্রীড়াঙ্গনে কতটুকু এগিয়েছেন এ দেশের নারীরা?


রানী হামিদ: মেয়েরা এগিয়েছে তো বটেই। এখন তো অনেক মেয়েই খেলাধুলায় আসছে। তবে আরও অনেক দূর যাবে এ দেশের মেয়েরা, এটাই আশা করি। অনেক সাফল্য পাবে, এটাই চাওয়া।

রানী হামিদ
প্রশ্ন

সত্যিই যদি এগিয়ে থাকে, আমরা আরেকজন রানী হামিদ বা জোবেরা রহমান লিনুর মতো কিংবদন্তি কেন পাচ্ছি না?

রানী হামিদ: আমরা যখন শুরু করেছিলাম, সেই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে সুযোগ-সুবিধা কিন্তু বেড়েছে। আমি যদি দাবার কথাই বলি, আমরা তখন একটা দাবার বই-ই চোখে দেখতাম না। এখন পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়। চাইলেই যে কেউ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেলা দেখতে পারে, দাবার কৌশল নিয়ে পড়তে পারে। এখন কোচিংসহ বিভিন্ন কোর্সও ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, নিজে নিজে অনুশীলন করা যায়। সেই জায়গা থেকে আমি বলব, এই প্রজন্ম ভাগ্যবান। আমরা তো নিজের প্রচেষ্টায় অনেক কষ্ট করে এসব জানার চেষ্টা করতাম। আমি আসলে দেখার অপেক্ষায় আছি, অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার পরও এই সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ওরা কত দূর যেতে পারে। আমি সব সময় এটাই প্রত্যাশা করি, ওরা অনেক দূর যাবে।

প্রশ্ন

এই সুযোগ-সুবিধাগুলো না থাকার পরও কিন্তু পঞ্চাশ-ষাট বা সত্তরের দশকে জিনাত আহমেদ, লুত্ফুন্নেছা হক বকুল, সুলতানা কামাল, ডলি ক্রুজ, সুফিয়া খাতুনদের মতো ক্রীড়াবিদেরা উঠে এসেছেন...

রানী হামিদ: আসলে নিজের ও পরিবারের উৎসাহ এ ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখে। আমি খুব ভাগ্যবান, ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সমর্থন পেয়েছি। আমি তো দাবা খেলা শুরুর আগে স্প্রিন্টেও খুব আগ্রহী ছিলাম। স্কুলে দৌড়াতাম। টাইমিং ভালো ছিল। পরিবার উৎসাহ দিয়েছে। বিয়ের পর স্বামীও খুব উৎসাহ দিয়েছেন। আমি দাবা শুরু করেছি অনেক পরে, আমার তখন চার সন্তান। দাবায় আসার পেছনে স্বামীর সমর্থন আমাকে বড় শক্তি জুগিয়েছে। এ রকম সমর্থন পেলে অনেক প্রতিবন্ধকতা জয় করা যায়। আমি নিশ্চিত, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আমরা যে বড় নারী অ্যাথলেটদের দেখেছি, যাঁরা পুরো পাকিস্তানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পদক জিতেছেন, তাঁদের সাফল্যেও নিজেদের প্রবল ইচ্ছা আর পারিবারিক সমর্থন একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। সে কারণেই ওনারা সব প্রতিবন্ধকতা জয় করেছেন।

রানী হামিদ
প্রশ্ন

মেয়েদের খেলাধুলায় আসার পথে এখন বড় প্রতিবন্ধকতাগুলো কী?

রানী হামিদ: সামাজিক প্রতিবন্ধকতা একটা বড় ব্যাপার। এটা ছিল, আছে। কিন্তু এটার দোহাই দিয়ে বসে থাকলে হবে না। এখন যেমন মফস্বল বা একেবারে গ্রাম থেকে আসা মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলছে। কলসিন্দুরের মেয়েরা এসেছে না! ক্রিকেটে মেয়েরা ভালো করছে। আমার মনে হয়, প্রতিবন্ধকতা বলতে নিরাপত্তা শঙ্কা একটা বড় ব্যাপার। আমাদের ছোটবেলায় আমরা নিশ্চিন্তে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করতে পারতাম, এত টেনশন ছিল না। সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় ফিরলেই হলো। এখন বোধ হয় সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব প্রচণ্ড। মা-বাবাও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন মেয়েদের নিয়ে। একা ছাড়তে চান না মেয়েদের। সেটাই স্বাভাবিক। একটা মেয়ে খেলতে যাবে, সঙ্গে বাবা বা মাকে যেতে হয়। তাঁরা সময় দিতে না পারলে ওই মেয়েদের খেলা বন্ধ। আমার নাতনি যেমন খেলাধুলা করে, তার মা তাকে নিয়ে যায়। এখন তার মা অসুস্থ, তাই তার খেলাও বন্ধ। এই যে মেয়েদের নিয়ে একটা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তা, এটা তো ভালো লক্ষণ নয়। এটা দূর করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

প্রশ্ন

যে মেয়েরা এসব জয় করে খেলায় আসেন, তাঁরা কি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পান?

রানী হামিদ: নাহ। মৌলিক সমস্যা অর্থনৈতিক। নারীরা কোনো খেলাকে যে পেশা হিসেবে নেবে, আমাদের এখানে এখনো সেই অবস্থা তৈরি হয়নি। এক-দুজন ছাড়া আমার মনে হয় না আমাদের এখানে পুরোপুরি পেশাদার নারী খেলোয়াড় আছেন। সেই অবস্থাই তো নেই আমাদের এখানে। ছেলে খেলোয়াড় ও মেয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে বেতন-ভাতার বৈষম্যও কমাতে হবে। যদি অর্থনৈতিকভাবে এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করা যায়, অনেক মেয়ে আগ্রহী হবে খেলায় আসতে। মীনাক্ষী নামে একটা মেয়ে আমার রুমমেট ছিল একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার সময়। বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলেছে আমার সঙ্গে। মাদ্রাজের মেয়ে। এখন গ্র্যান্ডমাস্টার। ওর বড় বোনও গ্র্যান্ডমাস্টার। সে প্রতি মাসে ওদের বিমান অফিস থেকে বেতন পায়। ওর অফিস করতে হয় না, ওর কাজই হচ্ছে খেলা। এটাই ওর চাকরি। ওর আর্থিক দিকটা ভাবতে হয় না। সে তাই সব সময় খেলা নিয়েই ভাবতে পারে। সুতরাং তার উন্নতি না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। সে উন্নতি করেছেও। খেলায় ভালো করলে তার বেতন বাড়বে, এটাই ওর চাকরি। ওর কাছ থেকেই শুনেছি, ওদের এখানে এটা আছে। যে একটু প্রতিভাবান, যার মধ্যে ওরা সম্ভাবনা দেখে, তাকে একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তারা ওকে আর্থিক সাপোর্ট দেয়। ফলে কোথাও খেলতে গেলে তাকে চিন্তা করতে হয় না টিকিটের টাকাটা কে দেবে, যাব কি যাব না। আমাদের তো গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াকেও চিন্তা করতে হয়, টিকিট পাবে কি না, খেলতে যেতে পারবে কি না। মেয়েদের কথা বাদই দিলাম। এভাবে হয় না। এসব কাটিয়ে উঠতে না পারলে আপনি ভালো ফল আশা করতে পারেন না।

প্রশ্ন

অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যাপার তো আছেই। বাংলাদেশে খেলাধুলার মৌলিক অবকাঠামোও কি নারীবান্ধব?

রানী হামিদ: আমাদের এখানে নারীদের জন্য আবাসিক সুযোগ খুব কম। বিকেএসপির মতো একটা একাডেমি নেই শুধু মেয়েদের জন্য, যেখানে থেকে তারা খেলাধুলা করবে। এই অবকাঠামোগত সুবিধাগুলো না দিলে হবে না। বড় দু-একটা ফেডারেশন ছাড়া ছোট ফেডারেশনগুলোর এ ধরনের কোনো অবকাঠামো বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই। এসব ফেডারেশনের কোনো আয়ের উৎস সরকার তৈরি করে দেয়নি বা নিজেরা করতে পারেনি, যে আয় দিয়ে তারা একটা প্রকল্প চালাবে। আপনি একটা প্রোগ্রাম তৈরি করতে চাচ্ছেন, এর জন্য আপনাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বা মন্ত্রণালয়ে চিঠি-চালাচালি করতে হবে। সেখান থেকে ফান্ড পান কি না, কতটুকু পান, এগুলোর ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে হয়। এসব করতে করতেই অনেক উদ্যম নষ্ট হয়ে যায়। আমার মনে হয়, ছোট ফেডারেশনগুলোকে যদি আয়ের উৎস তৈরি করে দেওয়া হয় বা নিজেরা কিছু করতে পারে, তাহলে ওরা অনেক উদ্যোগ নিতে পারবে। দরকার হলে সরকারিভাবে সব ফেডারেশনে একটা পদ তৈরি করে দেওয়া যায়—যিনি দেখভাল করবেন, জবাবদিহি নিশ্চিত করবেন, সঠিকভাবে সব পরিচালিত হচ্ছে কি না, নিশ্চিত করবেন, তাহলে অনেক কিছু এগোতে পারে বলে আমার মনে হয়। সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আমাদের এখানে প্রচণ্ড। এগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।

রানী হামিদ
প্রশ্ন

সামাজিকভাবেও মেয়েদের খেলায় উৎসাহী করার একটা ব্যাপার আছে বোধ হয়...

রানী হামিদ: এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের একটা দায়িত্ব আছে। মেয়েদের খেলাধুলার কাভারেজ আমাদের এখানে কম। হয় না বললেই চলে। মফস্বলের একটা মেয়ে খেলতে এল ঢাকায়, তাকে উৎসাহ দেওয়ারও একটা ব্যাপার থাকে। সাফল্য পেলে পরে লেখা হয়, কিন্তু তার আগে না। একটা অপরিচিত মেয়ে, তার উঠে আসার কথাটাও যদি আসে মিডিয়ায়, সে যদি কিছু করতে না-ও পারে, তাকে দেখে আরও দশটা মেয়ে এগিয়ে আসবে। এই প্রচারটা অন্যদের উৎসাহিত করে। তখন হয়তো আপনি ওদের মধ্যে থেকে কাউকে পেয়ে যাবেন, যে ভালো করবে, অনেক দূর এগিয়ে যাবে।